হাই হিল ফ্যাশন এর শুরু যেভাবে হল
হাই হিল জুতার ইতিহাস | হাই হিল জুতা কীভাবে এলো? মূলত হাই হিল যুক্ত জুতা ব্যবহার করত পুরুষ সৈনিকেরা। নারীরা সেটা ব্যবহার শুরু করে অনেক পরে। এর ইতিহাস প্রাচীন পারস্যের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেন গবেষকেরা। প্রাচীন পারস্যের ঘোড়সওয়ার তিরন্দাজ সৈনিকেরা উঁচু হিল যুক্ত জুতা পরত ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করার সুবিধার জন্য।
ষোলো-সতেরো শতকে নারী ও পুরুষের ফ্যাশন অনুষঙ্গে লিঙ্গগত পার্থক্য ছিল না তেমন। পোশাক, অলংকারসহ প্রায় একই রকম ফ্যাশন অনুষঙ্গ ব্যবহার করত তারা। বিভিন্ন গবেষণায় ও লেখাপত্রে আঠারো শতক পর্যন্ত ফ্যাশন অনুষঙ্গকে ‘ইউনিসেক্স’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সময় নারী-পুরুষ উভয়ে ধূমপান করতেন বিশেষ ধরনের পাইপে, তাঁদের জামার শোল্ডারে লাগানো থাকত আর্মি ব্যাচ ইত্যাদি উদাহরণের কথা প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যায়। জুতার ক্ষেত্রেও তাই ছিল।
হাই হিল নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও হাই হিল পুরুষের পা থেকে নারীর পায়ে
তবে নারীদের জুতার হিল ছিল পুরুষদের জুতার হিলের চেয়ে কিছুটা সরু (তবে এখনকার মতো পেনসিল নয়) আর পুরুষদের ছিল মোটা হিল। জুতার হিলের এই চিরাচরিত আকৃতিগত ধারণার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে সতেরো শতকে। এ সময় পুরুষেরা চৌকো, মজবুত ও অনুচ্চ এবং নারীরা সরু, লম্বা ও বাঁকযুক্ত হিল ব্যবহার শুরু করে। এখানে উল্লেখ করা উচিত, সতেরো শতকে ইউরোপে এনলাইটেনমেন্টের ধারণা প্রবর্তিত হয়। এর ফলে শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-কৃৎকৌশল ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। ফ্যাশনও তার বাইরে ছিল না। এ সময় অলংকারের ব্যবহার, কাজের ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক উজ্জ্বল রঙের ধোপদুরস্ত পোশাকসহ অযাচিত ফ্যাশন অনুষঙ্গ ত্যাগ করা শুরু করে পুরুষেরা। এ সময় নারী ও পুরুষ উভয়ের ফ্যাশন পরিশীলিত ও মার্জিত রূপ ধারণ করে।
ধারণা করা হয়, ১৭৪০ সালের দিকে পুরুষেরা পুরোপুরি হাই হিল যুক্ত জুতার ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। কারণ, পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক অবস্থার উত্থানপতনের জন্য এ সময় নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে আগের চেয়ে বেশি সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয় কাজের জন্য। ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে হাই হিল নারীদের পা থেকেও উধাও হয়ে যায় মূলত বাড়ির বাইরে কাজে যাওয়ার প্রয়োজনের জন্য। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর হাই হিল মানুষের চোখের আড়ালে চলে যায়। এ সময় তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের বুট—বিশেষ করে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকা বুট। এই বুটগুলোর বেশির ভাগই ছিল নিচু হিলের।
উনিশ শতকের একটা উল্লেখযোগ্য সময় হাই হিলের পরিবর্তে রাজত্ব করেছে বুট জুতো। বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশনেবল বুট তৈরি হতে থাকে সেসময়। এসব বুটের হিল ছোট থেকে বড় হতে থাকে। এ সময় জুতা কোম্পানিগুলো নতুন ডিজাইনের দিকে নজর দেয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপের নারী ফ্যাশনে হাই হিল আবার ফিরে আসে ব্যাপকভাবে। ১৮৬০–এর দশকে আড়াই ইঞ্চি হিলের প্রচলন হয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ফটোগ্রাফির বিস্তার এবং উনিশ শতকের মধ্যভাগে চলচ্চিত্রের বিকাশ এই দুই ঘটনা হাই হিলকে পুরো পৃথিবীতে জনপ্রিয় করতে সহায়তা করে—বিশেষ করে উনিশ শতকের শেষের দিকে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, নারীদের ছবিসহ পণ্য বিক্রির জন্য তত দিনে পোস্টারের প্রচলন হয়ে গেছে। সেগুলো ছিল হাতে আঁকা। ফটোগ্রাফি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে পোস্টার তৈরির ধারাও শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে পর্নোগ্রাফাররা ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্রের মতো নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ছিল অগ্রণী। তারা পোস্টকার্ডের জন্য নগ্ন নারীদের ছবি তুলতে শুরু করে এ সময়। ছবি তোলার সময় এই সব ফটোগ্রাফার ধ্রুপদি যুগের চিত্রশিল্প অথবা ভাস্কর্যের নগ্ন নারীদের ভঙ্গি অনুসরণ করে তাদের নারী মডেলদের ছবি তুলতে থাকেন। মডেলদের ভঙ্গিতে ধ্রুপদি ছোঁয়া থাকলেও সমকালীন এবং আরও আবেদনময়ী করার জন্য তাদের পড়ানো হতো আধুনিক হাই হিল। উনিশ শতকের শেষের দিকের ‘পিন-আপ’ ফটোগ্রাফিতে এর প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে পর্নো চলচ্চিত্রনির্মাতাদের মধ্যেও। তারাও একইভাবে হাই হিল পরা নারীদের ব্যবহার করতে শুরু করে। হাই হিল পরা এসব নগ্ন, অর্ধনগ্ন নারীদের ছবি এবং চলচ্চিত্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে পৃথিবীজুড়ে। এরপর থেকেই মূলত ফ্যাশন জগতে হাই হিল তার আধিপত্য বিস্তার করে এবং নারীদের ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়।
মনে করা অসংগত নয় যে দুটি প্রবণতা হাই হিলকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। প্রথমটি হলো, বিভিন্ন মাধ্যমে, বিশেষত চিত্রশিল্প, ফ্যাশন ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রশিল্পে ‘আরও বেশি’ আকর্ষণীয় করে নারীদের উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়টি হলো, নারী ফ্যাশন আইকনরাও মনে করেন, হাই হিল তাঁদের ‘আরও বেশি’ আকর্ষণীয় করে তোলে। এই সাধারণ প্রবণতাটির জন্যই হয়তো মেরিলিন মনরো থেকে শুরু করে আমাদের নায়িকা পরীমনির পছন্দের তালিকায় হাই হিল জায়গা করে নিয়েছে।
সূত্র:
১. ‘হোয়াই ডিড মেন স্টপ অয়্যারিং হাই হিলস?’, উইলিয়াম ক্রেমার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৩, বিবিসি অনলাইন।
২. ‘ফ্রম ম্যানলি টু সেক্সি: হিস্টরি অব দ্য হাই হিল’, ড. লিসা ওয়েড, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, দ্য সোসাইটি পেজেস।
৩. প্রথম আলো