প্রাচীন ভারতের ইতিহাস | আর্য রহস্যের অনুসন্ধান পর্ব-১

.

নিবন্ধ

ইতিহাস | History

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস | আর্য রহস্যের অনুসন্ধান পর্ব-১

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বলতে আমরা কী বুঝি? প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বলতে মূলত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন -মধ্যযুগীয় ও প্রাক-আধুনিক কালের ইতিহাসকেই বোঝানো হয়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সূচনায় এই ব্রোঞ্জযুগীয় সভ্যতার পতন ঘটে। সূচনা হয় লৌহ-নির্ভর বৈদিক যুগের।


আর্য নিয়ে আরও জানতে দেখুন থিংকের ভিডিও আর্যরাই কি গড়েছিলো প্রাচীন ভারত?

আর্য কারা, তাদের আদি বাসস্থান কোথায়, ভারতীয় উপমহাদেশে কবে তাদের আগমন, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় তাদের কি অবদান-এই বিষয়গুলি নিয়ে একের পর এক বিতর্ক হয়েছে কিন্তু কোন নিশ্চিত সমাধানসূত্র আজও অধরা। প্রাথমিক পর্বে মনে করা হত যে শ্বেতগাত্রবর্ণ, টিকালো নাসিকা, প্রশস্ত ললাট ও দীর্ঘদেহী ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত মানবপ্রজাতির একটি গোষ্ঠী হল আর্য। এই তত্ত্ব বেশ প্রভাবও বিস্তার করেছিল এবং এর ভিত্তিতে অনেকেই বলতে শুরু করেন যে আর্যরা হলেন নরডিক জাতির মানুষ। কিন্তু এই কাল্পনিক তত্ত্বের ফানুস ফুটো হয়ে যায় ইরান থেকে বেহিস্তান শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর। যিশুর জন্মের প্রায় ৪৮৬ বছর আগে উৎকীর্ণ এই লেখতে পারস্য সম্রাট দারায়ুস নিজকে দাবি করেন-‘’ A Persian, a son of a Persian and an Aryan of Aryan Descent’’ হিসেবে। ব্যাস এরপরই ঐতিহাসিক মহলে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি হল এবং আর্য জাতির সাথে সম্পৃক্ত দেহসৌষ্ঠব সংক্রান্ত তত্ত্ব এক লহমায় বাতিলের খাতায় চলে গেল।


নিঃসন্দেহে আর্য জাতির শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি হল বেদ। সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত বেদ এক বিস্ময়কর গ্রন্থ। ধর্ম ও দৈনন্দিন জীবনের নানা দিকের অপূর্ব সংমিশ্রণ এই গ্রন্থে লক্ষ্য করা যায়। ষোড়শ শতাব্দীর সময়ে ভারতে আগত ইউরোপীয় পর্যটক ও ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে ভারতীয় ধর্ম, বিশেষত বেদ নিয়ে তুমুল উৎসাহ দেখা দেয়। এঁরাই প্রথম সংস্কৃত, ইরানি ও ইউরোপীয় বেশ কিছু ভাষার মধ্যে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করেন। যেমন গোয়াতে আগত ব্রিটিশ জেসুইট পাদ্রী থমাস স্টিফেন্স ১৫৮৩ সাল নাগাদ তাঁর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক চিঠিতে সংস্কৃতের সাথে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। অন্যদিকে ইটালির ফ্লোরেন্সীয় বনিক ফিলিপো সসেটি বানিজ্য সংক্রান্ত কাজে গোয়ায় এসেছিলেন। তিনি এসময় এক স্থানীয় গোয়ান পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত ভাষার অধ্যয়ন করেছিলেন। এরপর ১৫৮৫ তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি বেশ কিছু সংস্কৃত ও ইতালীয় শব্দের সাদৃশ্য উপস্থাপন করেন,যেমন – Deva (Sans.) / Dio (Ita.), Sapta (Sans.)/ Sette (Ita.), Ostta (Sans.)/ Otto (Ita.) ইত্যাদি। যদিও স্টিফেন্স ও সসেটি কেউই এই সামঞ্জস্যের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস করেননি কিন্তু তাঁরা নিজেদের অজান্তেই আর্য সংক্রান্ত গবেষণায় এক নয়া সম্ভাবনাময় দিকের উন্মোচন করেছিলেন। এভাবে ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে আর্যদের ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া শুরু হয় যা প্রায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বজায় ছিল কিন্তু এই পদ্ধতিও শেষ পর্যন্ত সমাধানসূত্র নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়।


 ফরাসি জেসুইট পাদ্রী গ্যাস্টন লরেন্ট দক্ষিণ ভারতে ধর্মপ্রচারকালে তেলুগু ভাষা শিখেছিলেন। তিনি ‘তেলুগু-ফরাসি-সংস্কৃত’ একটি অভিধান রচনা করেন এবং এখানে এই তিন ভাষার মধ্যে ভূরি ভূরি সাদৃশ্য তুলে ধরেন। তাঁর এই অভিধানটি আজও ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে আর্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ‘বাইবেল’ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ম্যাক্সমুলারের মত যশস্বীও তাঁকে ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জনক’ হিসেবে অভিহিত করেন। গ্যাস্টনের পরবর্তীকালীন জেমস পারসনস উল্লেখ করেন যে, ইউরোপ ও এশিয়ার অনেকগুলি ভাষার উৎপত্তি নিহিত আছে এক আদিম ভাষার মধ্যে। একই ভাবে ডাচ ভাষাবিদ মার্কুস জুয়েরিয়াস বক্সহর্ন এই ভাষাগত সাযুজ্যের ভিত্তিতে ‘স্কিথিয়ান’ নামে এক আদিম ভাষার অবতারণা করেন এবং এই থেকেই বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বলে দাবি করেন। এভাবে আর্য সংক্রান্ত যে এক নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় তা হল – আর্য একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সংস্কৃত,গ্রীক,ল্যাটিন,জার্মান,পারসিক ও কেলটিক এই সকল ভাষার মধ্যে যে কোন একটি যদি কোন ব্যক্তির মাতৃভাষা হয়,তবে তিনি আর্য। এই ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দদ্বয় ব্রিটিশ গবেষক থমাস ইয়ং সর্বপ্রথম তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন,বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সমজাতীয়তার ভিত্তিতে। বিস্ময়করভাবে ‘হিব্রু’ ভাষাকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও বর্তমানে হিব্রু ও তামিল ভাষার মধ্যে বেশ কিছু মিল দেখা যায়। যেমন তামিলে ময়ূরকে ‘টোকেই’ রূপে উল্লেখ করা হয়,তেমনই হিব্রু ভাষায় ময়ূরের নাম হল ‘টুকি’।


 জার্মান ভাষাতাত্ত্বিক আন্দ্রেস জাগার ককেশাস অঞ্চলে একদা বিরাজমান এক প্রাচীন ভাষার ধারণা প্রদান করেন, যা থেকে গ্রিক, স্ল্যাভিক, পারসিক ও কেল্টো-জার্মান বা স্কিথিও-কেলটিক ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। ডাচ পণ্ডিত জোসেফ স্ক্যালিগার আবার চারটি প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠীর অবতারণা করেছিলেন এবং সেগুলি হল-সেমাইট (আরবি ভাষাসমূহ ও হিব্রু),হ্যামাইট (ইজিপ্সিয় ও কুশাইট ভাষাসমূহ), জ্যাফেটিক এবং গ্রিক-ল্যাটিন-জার্মান-ভারতীয় ভাষাসমূহ সম্বলিত একটি গোষ্ঠী। ডেনমার্কের গবেষক রাসমুস ক্রিস্টিয়ান রাস্ক নরওয়েজীয়, গথিক, লিথুয়ানীয়, গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে সাযুজ্য উপস্থাপন করেন। প্রত্যেক ভাষাবিদই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভাষাগুলির জন্মদাত্রী রূপে এক প্রাচীন ভাষার উল্লেখ করেছেন এবং এই প্রাচীন ভাষাটিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। তবে ভাষাতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে প্রথম যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেন কলকাতা উচ্চন্যায়ালয়ের পূর্বতন প্রধান বিচারপতি তথা বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স। তিনি সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার ক্রিয়াপদ ও ব্যকরণগত সাযুজ্যের উল্লেখ করে,এই তিন ভাষার উৎস হিসেবে এক আদি ভাষার অবতারণা করেন। ফরাসি পণ্ডিত বার্নফ এবং তাঁর দুই অনুগামী রথ ও ম্যাক্স মুলার বৈদিক সাহিত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন। তাঁরাই প্রথম ‘ইন্দো-এরিয়ান’ বা ‘ইন্দো-আর্য’ শব্দদ্বয়ের উল্লেখ করেন এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাগুলি এই ‘ইন্দো-আর্য’ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আলেকজান্ডার স্লাইকার ‘Genealogical Tree Theory’ বা G.T.T তত্ত্ব উপস্থাপনের মাধ্যমের এক নয়া মাত্রা সংযোজিত করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে একটি প্রাচীন ভাষা ভেঙে কতগুলি নতুন ভাষার উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে প্রতিটি নতুন ভাষা ভেঙে আরও অনেকগুলি ভাষার সৃষ্টি হয়।যদিও প্যাট্রিক ম্যালোরি ও ডগলাস অ্যাডামস, ভাষা বিভাজনের এই অতি সরলীকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেন। এক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে সৃষ্ট ভাষাগুলির প্রকৃতি সব জায়গায় এক নয় এবং এগুলি থেকে উৎপত্তিলাভ করা উপভাষাগুলিও সবক্ষেত্রে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাথে সংযুক্ত নয়। জার্মান ভাষাবিদ জোহানেস স্মিথ আবার ‘Wave Theory’ উপস্থাপন করেছিলেন,যার মূল বক্তব্য ছিল জলে পাথর ফেললে একটি কেন্দ্র বরাবর ঢেউ যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,তেমনই একটি আদিম ভাষা থেকে নতুন নতুন ভাষার উৎপত্তি হয়।


আর্যদের উৎস বিশ্লেষণে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি খুব একটা কার্যকরী হয়নি। এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল আর্যদের বাসস্থান কোথায় ছিল,তা নির্ণয় করা যায়নি। সংস্কৃতের সাথে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার ব্যাপক সাদৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই ভারতকে আর্যদের আদি বাসভূমি রূপে অভিহিত করেন। যদিও ট্রটম্যানের মত অনেকেই মনে করেন যে ল্যাটিন, কেলটিক, ইরানি ও জার্মানের সাথে সংস্কৃতের সাযুজ্য প্রমাণ করে যে, আর্যরা অভারতীয়। একদা এই বিশাল ভাষাগোষ্ঠী একটি অঞ্চলে বসবাস করলেও পরবর্তীকালে তারা বিভক্ত হয়ে যায় এবং একদল ভারতে প্রবেশ করে বৈদিক সভ্যতার জন্ম দেয়।

( ২য় পর্বে-https://www.sabinaislam.com/think/article/arjo-rohossher-anusandhon)


সায়ন দেবনাথ, এম ফিল, প্রথম বর্ষ

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles