ক্ষুদে বামনেরা কি সত্যিই ছিল ?

.

নিবন্ধ

Evolution | বিবর্তন

ক্ষুদে বামনেরা কি সত্যিই ছিল ?

এবু গোগো (ebu gogo), যার মানে দাড়াচ্ছে "the grandmother who eats anything", ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপের গ্রামবাসীদের মধ্যে এবু গোগোর কাহিনী বহুকাল ধরেই প্রচলিত। মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু ছোটখাটো শরীর, অদ্ভুত হাটার ধরন, বিড়বিড়িয়ে কথা বলা আর পেটুক স্বভাব লোককাহিনীর এবু গোগোর বৈশিষ্ট্য। স্রেফ উপকথা হিসেবেই হয়তো একে উড়িয়ে দেয়া যেত, বাধ সাধল ২০০৩ সালে আবিষ্কার করা কিছু জীবাশ্ম। হবিট নিয়ে দেখুন থিংকের বানানো ভিডিও হবিট কি সত্যিই ছিলো?


২০০৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপের লিয়াং বুয়া গুহায় গবেষনা চলাকালীন একদল অস্ট্রেলিয়ান ও ইন্দোনেশিয়ান আর্কিওলজিষ্ট 'LB 1' নামের প্রায় সম্পুর্ণ কঙ্কালটিকে খুঁজে পান। পরবর্তীতে আরও জোরদার খননকার্য চালনার ফলে আরও সাতটি অনুরুপ কঙ্কালের হদিশ পাওয়া যায়। একধরনের হবিট জাতীয় মানুষের এসব জীবাশ্ম প্রায় ১৩,০০০ বছরের পুরোনো। ফ্লোরেস দ্বীপের এসব জীবাশ্ম গত কয়েক বছরের প্যালিও-অ্যানথ্রোপলজির বড় আবিষ্কার গুলোর একটা। এর আগে ধারনা করা হচ্ছিল গত ২৫,০০০ বছর ধরে মানুষের একটাই প্রজাতি জীবিত আছে। ইউরোপে Neanderthal এবং এশিয়াতে Homo erectus-এর অন্তর্ধানের পর আমরা মোটামুটি একাই পৃথিবীতে আছি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে এত ছোট আকারের মানুষ গত কয়েক লাখ বছরে ছিল বলে জানা যায় না, যদিও প্রায় ৩০ লাখ বছর আগে পাওয়া অস্ট্রালোপিথেকাস (যেমন লুসি'র জীবাশ্ম, ইথিওপিয়াতে পাওয়া) অনেকটা এরকম ছিল, কিন্তু এবু গোগোর জীবাশ্ম তো মাত্র ১৩,০০০-৩৮,০০০ বছর পুরোনো।


ফ্লোরেস দ্বীপে অবশ্য এর আগেও আশ্চর্যজনক সব জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। ১৯৯৮ সালে একদল আর্কিওলজিষ্ট আট লক্ষ বছরের পুরোনো পাথরের তৈরী স্থুল হাতিয়ার আবিষ্কার করেন, যদিও সমসাময়িক কোন মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া যায় নি। আধুনিক মানুষ সর্বোচ্চ দেড় লাখ বছর ধরে পৃথিবীতে আছে, তার মানে দাঁড়াচ্ছে এ সব হাতিয়ার Homo erectus-এর তৈরী করা। সংক্ষেপে বললে ৩০-৪০ লক্ষ বছর আগে পুর্ব ও দক্ষিন আফ্রিকায় মানুষের পুর্বপুরুষরা ছিল, এরা অবশ্য বৈশিষ্টে আধুনিক মানুষের কাছাকাছি হলেও অনেক পার্থক্যও আছে, এদের একদল হচ্ছে Homo erectus(ঋজু মানুষ)। প্লিস্টোসিন যুগে (কমবেশি ২০ লাখ বছর আগে) এরা আফ্রিকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে , তবে এদের একদল আফ্রিকায় থেকে গিয়েছিল যাদের থেকে গত ২-৩ লাখ বছর আগে আমাদের উৎপত্তি ঘটেছে, অন্যদিকে যারা আফ্রিকার বাইরে এসেছিল তারা বর্তমান ইউরোপ, চিন, দক্ষিন এশিয়াতে (ইউরোপ, ভারত, জাভা, চীনে এদের জীবাশ্ম আছে) বসতি স্থাপন করে। Homo erectus পাথরের হাতিয়ার বানাতে পারত, সম্ভবত সীমিত ভাষা এবং আগুনের ব্যবহারও জানত। যাইহোক, এদের ইউরোপিয়ান শাখা থেকে কালক্রমে Neanderthal-দের উৎপত্তি। বিজ্ঞানীদের ধারনা, এবু গোগো (Homo floresiensis) দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার Homo erectus থেকে বিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক মানুষ যখন আফ্রিকা থেকে ৭০-৮০ হাজার বছর আগে বের হয়ে ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত বা ইউরোপে বসতি স্থাপন শুরু করে তখন আস্তে আস্তে Homo erectus বা তাদের বংশধররা বিলুপ্ত হতে থাকে। হতে পারে মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনি বা অন্য কোন কারনে এরা বিলুপ্ত হয়েছে।


যাইহোক Homo floresiensis-এর সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দিপক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আকার, পুর্ণবয়স্ক ফ্লোরেস মানবের উচ্চতা ছিল ৩ ফুটের সামান্য বেশী (৪-৫ বছরের শিশুদের সমান) এবং ওজন ৩০ পাউন্ড। স্বাভাবিক ভাবেই এদের মস্তিষ্কের আকারও ছোট তবে, আধুনিক শিম্পাঞ্জিদের চেয়ে সামান্য বড়। অন্যান্য মানব প্রজাতির সঙ্গে একই সময়ে পৃথিবীতে পদচারণা করলেও হবিটদের শরীর ও মস্তিষ্ক আধুনিক মানুষের তুলনায় ছোট ছিল। এদের অ্যানাটমি অর্থাৎ শারীরিক গঠনও খুব প্রাচীন ছিল। প্রথমে এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে Dwarfism বা বামনত্ব, অ্যাকোনড্রপ্লেসিয়া অথবা ডাউন সিন্ড্রোমের লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়েছিল। তবে সেই ধারণা শীঘ্রই নাকচ করে দেওয়া হয়। ফ্রান্সের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের আন্তনিও ব্যালজেও ও ফ্রান্সের প্যারিসের দেকার্ত ইউনিভার্সিটির ফিলিপ শার্লিয়ার হবিটের মাথার খুলির হাড় নিয়ে যৌথ গবেষণা শেষে জানান, এর খুলির আকৃতি স্পষ্টভাবে আধুনিক মানুষের চেয়ে আলাদা। এমনকি তার রোগও মানুষের নয়। হবিট তাই আমাদের প্রজাতির ছোট ও রোগাক্রান্ত সদস্য নয়। এর মাঝে আরো অনেক বহিরাগত বিষয় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। অক্সফোর্ড ব্রুকস ইউনিভার্সিটির সাইমন আন্ডারডাউনের মতে, আধুনিক মানুষের কোনো পরিচিত প্রজাতির সঙ্গেও এর কিছুই মেলে না। যেমন, এর আকৃতি আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ হোমো ইরেকটাস থেকেও ভিন্ন। এর চোখও খুব ছোট হয়। হবিটদের চিবুক গভীরভাবে আবৃত, যেখানে আমাদের চিবুক সামনের দিকে আবৃত। একটি চিবুকের উপস্থিতিই আমাদের প্রজাতির সংজ্ঞা দেওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে, সেখানে হবিটরা অন্য কোনো হোমিনিনে আবিষ্ট।


কোনো কোনো বিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন যে, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস্‌দেরকে আমাদের নিজস্ব গণ হোমোর খুব আদিম কোনো কোনো প্রজাতির সঙ্গে আরোপিত করা যায়। তার কঙ্কালে এসব প্রজাতির মানুষের মতো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। আবার বন্য মানুষের 'আদিম' গ্রুপ অস্ট্রালোপিথেকাস বা বিখ্যাত লুসি'র ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলেও মনে করেন তাকে। তবে লুসির খুলি পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় আর হবিটের খুলি ফ্লোরেসের লিয়াং বুয়া দ্বীপে পাওয়ায় এ মত প্রমাণিত নয়।

তবে, ফ্লোরেস দ্বীপে পাওয়া অন্যান্য পাথরের হাতিয়ার থেকে মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তিতে এরা খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই এরা আগুনের ব্যবহার জানত। সমস্যা হচ্ছে Homo erectus যদি এদের পুর্বপুরষ হয়ে থাকে তাহলে ফ্লোরেস মানবদের আকার এত অস্বাভাবিকভাবে ছোট কেন (Homo erectus-এর অন্যান্য জীবাশ্মের চেয়েও ছোট)? একটা কারণ হতে পারে হবিটরা এই দ্বীপে অনেকদিন ধরে আটকে ছিল, সাধারনত ছোট দ্বীপে প্রাণীদের আকারও ছোট হয়ে যায় (বিবর্তনের কারনে)। ছোট দ্বীপে বড় আকারের মাংসাশী প্রাণী থাকে না, তাই বড় আকৃতি তেমন কোন সাহায্য করে না, অন্যদিকে বড় আকৃতি থাকলে তুলনা মুলক ভাবে খাবার দরকার হবে বেশী, এবং দ্বীপের সীমিত স্থানে খাবারও সীমিত, এসব কারনে প্রাকৃতিক নির্বাচন(Natural Selection) ক্ষুদ্র আকারকে প্রাধান্য দিতে থাকে, কয়েক হাজার প্রজন্মে প্রাণীরা ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। হবিটরা ছাড়াও একই দ্বীপে ক্ষুদ্রাকৃতি হাতির জীবাশ্ম(পিগমি স্টেগোডন, অধুনা বিলুপ্ত)পাওয়া গেছে। পিগমি স্টেগোডন অন্যান্য হাতির তুলনায় কয়েকগুন ছোট, উদ্ধারকৃত হাড়-গোড় থেকে মনে হয়, হবিটরা এই হাতি শিকার করত।

ফ্লোরেস মানব কিভাবে বিলুপ্ত হলো তার উত্তর পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। যে সব জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেগুলো ১০-১৩ হাজার বছরের মধ্যে, এতে মনে হয় ১২,০০০ বছর আগে ওই এলাকায় যে বড় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়েছিল তাতে হবিটরা, পিগমী স্টেগোডন সহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথবা এমন হতে পারে অল্প কয়েকজন হয়তো ফ্লোরেস দ্বীপের পুর্বাংশে এখনও বেচে আছে। এবু গোগোর গল্প বিশ্বাস করলে গত শতকেও এদেরকে দেখা গেছে। মালয় উপকথা অনুযায়ী সুমাত্রাতে একই রকম মানুষ সদৃশ প্রাণী orang pendek দেখা যেত। কে জানে হয়ত ভবিষ্যতে জীবন্ত এবু গোগো কে খুঁজে পাওয়া যাবে, নিঃসন্দেহে সেটা হবে এই শতাব্দীর বড় আবিষ্কারগুলোর একটা।

 

তথ্যসূত্র - 

Homo floresiensis - Wikipedia

 

Homo floresiensis

https://www.britannica.com/topic/Homo-floresiensis

A new small-bodied hominin from the Late Pleistocene of Flores, Indonesia

Revised stratigraphy and chronology for Homo floresiensis at Liang Bua in Indonesia

Revised stratigraphy and chronology for Homo floresiensis at Liang Bua in Indonesia

মানুষের মত, কিন্তু আদেও মানুষ তো? - ANM News | DailyHunt

ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গলে হবিটের সন্ধান

Neanderthals: Bone technique redrafts prehistory

Human remains found in hobbit cave

[সমস্ত ছবির সুত্রঃ-ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া]

 

লেখা- কমলেন্দু সূত্রধর, 

B.Sc. প্রাণীবিদ্যা

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles