আর্যরা কি আমাদের পূর্বসূরি? আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে কারা?

.

নিবন্ধ

ইতিহাস | History

আর্যরা কি আমাদের পূর্বসূরি? আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে কারা?

আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে কারা? আর্যরা কি আমাদের পূর্বসূরি? আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠাতারাই নাকি আমাদের পূর্বপুরুষ আর আর্যরাই নাকি তৈরি করেছিল সেই উন্নত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু সেটা কি ঠিক? পৃথিবী বিখ্যাত বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ জন গবেষক মিলে জানিয়েছেন এটা।


আর্য নিয়ে আরও জানতে দেখুন থিংকের ভিডিও আর্যরাই কি গড়েছিলো প্রাচীন ভারত?


আমরা শুনেছি,আর্যরা আমাদের পূর্বপুরুষ আর আর্যরাই  নাকি  তৈরি করেছিল সেই উন্নত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু সেটা কি ঠিক ? পৃথিবী বিখ্যাত বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ জন গবেষক (জীববিজ্ঞানী, জেনেটিসিস্ট, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদসহ বিভিন্ন শাখার গবেষকরা একসাথে হয়েছেন এখানে) বংশগতীয় (genetic) এই গবেষণাটিতে কাজ করে আসছেন অনেক বছর ধরে। সেই গবেষণার একাংশের উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি এই রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। তাঁরা ইরান, আফগানিস্তান এবং তার উত্তরের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাকাস্তানের মত দেশগুলো থেকে সংগৃহীত ৬১২ জন প্রাচীন পূর্বসূরির ডিএনএর সাথে এখনকার দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ২৪৬টি গ্রুপের মানুষের ডিএনএর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। গবেষণার সারমর্মটা মোটামুটি এরকম:


১) সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল বহু আগে আফ্রিকা থেকে আসা প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী এবং পরে পারস্য থেকে অভিবাসিত গোষ্ঠীর সমন্বয়ে। এদেরকে সিন্ধু উপত্যকার পূর্বসূরি (Indus Valley ancestors) হিসেবে অভিহিত করা হয়। পারস্য থেকে আসা এই নতুন জনগোষ্ঠীদের আগমনের পূর্বেই সম্ভবত ভারতে কৃষি কাজের সূচনা হয়েছিল, তবে এদের আগমনের পরে সিন্ধু উপত্যকায় কৃষিকার্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। এরাই বোধ হয় পশ্চিম এশিয়া থেকে ধানচাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিল।

২) এক-দুই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্তেপ অঞ্চলের প্যাস্টোরাল বা পশুপালক গোষ্ঠীর মানুষেরা উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে আর এদিকে দক্ষিণ-পূর্বে সিন্ধু উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এদেরকেই আমরা আর্য বলে চিনি।

৩) ধারণা করা হয়, সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছরের দিকে বেশ বড় কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু কেন ঘটেছিল সেটা এখনো একটা রহস্য। অনেক গবেষক মনে করেন সিন্ধু নদের গতিপথের পরিবর্তন এবং বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এ অঞ্চল ক্রমশ চাষবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সম্ভবত এ-কারণেই সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাটি ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং এর পরপরই শুরু হয় উত্তর থেকে আসা আর্যদের অভিবাসন।


সে-সময়ে সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের যে অংশটি উত্তরাঞ্চলে স্থায়ীভাবে থেকে যায় তারা আর্যদের সাথে মিশে জন্ম দেয় উত্তর ভারতীয় পূর্বসূরিদের (Ancesteral North Indians-ANI)। আর ওদিকে সিন্ধু উপত্যকার এই পূর্বসূরীদের আরেক অংশ দক্ষিণের দিকে সরে যেতে শুরু করে। এরা তেমনভাবে আর্যদের সাথে মিশ খায়নি; এরাই দক্ষিণ ভারতীয় পূর্বসূরীদের(Ancesteral South Indians-ASI) জন্ম দেন। এদের উত্তরসূরিরাই পরবর্তীকালে আদিম ভারতীয়দের সাথে মিশতে মিশতে আরও পূর্বদিকে বসতি স্থাপন করতে থাকে। পরবর্তীকালে আবার ব্যবসা এবং রাজ্য-জয়ের অভিপ্রায়ে আসা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এদের সবার মিশ্রণ ঘটতে থাকে।

ব্যাপারটা এমন নয় যে, এখান থেকে ANI এবং ASIরা বংশগতীয়ভাবে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এদের নিজেদের মধ্যেও অনেক মিশ্রণ ঘটেছিল। তাই আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশীয়দের সবার মধ্যেই কম বেশি ANI এবং ASI এর সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে, জাতপ্রথার কারণে, গত দুই হাজার বছরে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম-জাতীয় বিবাহ-প্রথা গেড়ে বসার ফলে এই মিশ্রণ কমতে শুরু করে। এখন উত্তর ভারতে ANI-এর প্রভাব আর দক্ষিণে ASI জিনের প্রভাবই বেশি দেখা যায়। মুক্তমনার সদস্য Sarthak একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন, ওনার মন্তব্যের কিছু অংশ এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছিঃ

‘….ANI এর প্রভাব বেশি আর দক্ষিণে ASI এর প্রভাব বেশি কিন্তু এরা (উত্তর বা দক্ষিণের) কেউই আর জিনগত ভাবে শুধুই ANI বা ASI এর জিন বহন করে না। এক মতে ANI আর ASI তৈরি হওয়ার পর প্রথম হাজার থেকে দুহাজার বছর দুইয়ের মধ্যে অনেক মিশ্রণ হয়। কিন্তু তারপর মানে শেষ দুহাজার বছর জিনগত বৈশিষ্ট্য মোটামুটি একই থেকে গেছে। এর কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মে উচ্চবর্ণের মধ্যে সমজাতির মধ্যে বিবাহ-প্রথা গেড়ে বসা।

এছাড়া রিসার্চাররা আরো অনুমান করেছেন, ভারতের যে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্তেপ জিন তুলনায় অনেকটাই বেশী পাওয়া গেছে তারা হয়ত ব্রাহ্মণ্যবাদি ধর্ম ও ভাষা মূল জিম্মেদার ছিল। এবং সমজাতির মধ্যে বিয়ে করে এই ধারাটা তারা ধরে রেখেছিল, এমনকি এখনো ধরে রেখেছে। আমার মনে হয় এই শ্রেণীই এবং এই শ্রেণীর প্রতি ভক্তিই উপমহাদেশের মানুষের মনে ফর্সা চামড়ার ফেটিস তৈরি করেছে যুগ যুগ ধরে।’

(আমার মনে হয় শুধু এই শ্রেণীর প্রতি ভক্তিই নয়, পরবর্তী সময়ে পশ্চিম থেকে আসা সব ভারত-বিজেতারাই আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ‘ফর্সা’ ছিল। এই সব বিজেতাদের প্রতি লালাঝরা-ভক্তিও ওই ফর্সা চামড়ার ফেটিসের সাথে যুক্ত হয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও অপেক্ষাকৃত ফর্সা-কালো নিয়ে একই ধরণের সংস্কার কাজ করতে দেখেছি।)

৪) তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, আর্যেরা আসার আগে সিন্ধু উপত্যকার এই প্রাচীন মানুষেরাই আমাদের সবার পূর্বসূরি। এরাই পরবর্তীকালে আরও অনেক জাতির সাথে মিশ খেতে খেতে আজকের দক্ষিণ এশিয়ার মূল আধুনিক জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীর বেশীরভাগ জনগোষ্ঠীর মতই আমরা সবাইও দিনশেষে একগাদি ‘ভ্যাজালে’ ভরা শঙ্কর বই আর কিছু নই। রবীন্দ্রনাথ এতকিছু না জেনেই কিন্তু লিখেছিলেন, হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন, শক-হূণ-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।



লেখা - বন্যা আহমেদ 

সূত্র- এখান থেকে মূল গবেষণাটি ডাউনলোড করে নিতে পারেনঃ The Genomic Formation of South and Central Asiaঃ https://www.biorxiv.org/content/early/2018/03/31/292581


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles

আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে কারা? আর্যরা কি আমাদের পূর্বসূরি?