কালারিজম- বর্ণবাদের অন্য বর্ণ

.

নিবন্ধ

Evolution | বিবর্তন

কালারিজম- বর্ণবাদের অন্য বর্ণ

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো যারে বলে গায়ের লোকে

গায়ের রঙ ফর্সা না হওয়ার তীব্র গ্লানি, অবজ্ঞা আর অবহেলাতে কবিগুরুর কৃষ্ণকলি অমর হয়ে রয় শুরু গানেকবিতাতে৷ অথচ সমাজ এই গায়ের রংটাকে কালো বলেও সম্বোধন করে নাবলে, মেয়েটার গায়ের রঙ কেমন যেন, ময়লা, চাপা ইত্যাদি ইত্যাদি।  ঘরে-বাইরে, স্কুল-কলেজে, বিয়েতে-অনুষ্ঠানে, বন্ধু- বান্ধবদের কাছে এই গায়ের রঙ কালো বলে মেয়েদের কম হেয় হতে হয় না৷ মজার ছলে হলেও বহু কথা মুখ বুঝে হজম করতে হয় তাদেরএখন হয়তো বলবেন কালো মেয়েদের কথা কেন বলছি শুধু! বলা বাহুল্য, গায়ের রঙ নিয়ে বিড়ম্বনা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি। গায়ের রঙের পার্থক্য নিয়ে দেখুন থিংকের বানানো ভিডিও এতো রঙের মানুষ কেন?


কালারিজম এতো সুক্ষ্মভাবে আমাদের মধ্যে গেঁথে গেছে যে ২০১৫ সালে ছোট পর্দার অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু বিয়ে করেন নাসিরুদ্দিন নাসিমকে, যাঁকে সমালোচনার শিকার হতে হয় গায়ের রঙ কালো হওয়ায়তাঁকে নাকি অভিনেত্রীর সাথে মানায় না! একজন অভিনেত্রীর স্বামীকে যদি এভাবে হেয় করা হয় তাহলে সাধারণ মেয়েদের কি অবস্থা কালারিজমের জঘন্য চাকায় পিষ্ট হয়ে তা একটু হলেও আঁচ করতে পারবেনজিনিসটা ভালমত ধরিয়ে দিতে আরেকটা ঘটনা বলি- 

২০১৯ সালের এপ্রিল নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জে সাথী আক্তার নামে এক গৃহবধূকে পুলিশ উদ্ধার করার পর তিনি পুলিশ কে জানান, কালো খাটো হওয়ার কারণে গত ছয় মাস ধরে তাঁর উপর নির্যাতন করছিলো তার স্বামী ফাহিমতাঁকে জোর করে বিষপান করিয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়এছাড়া আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায়, যে নারীর গায়ের রঙ কালো বা যারা প্রচলিত দৃষ্টিতে সুন্দর না তার পরিবারকে বেশি যৌতুক দিতে হয় আবার নির্যাতন তাদের উপর বেশি হয়৷ এটা তো গেলো নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র৷ 


মনে হতে পারে উচ্চমধ্যবিত্ত, ধনী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে হয়তো কালারিজমের চর্চা নেই যেহেতু তারাই তথাকথিত সুশীল৷ কিন্তু এইযে রংফর্সাকারী ক্রিমের সংখ্যা বিক্রয় হু হু করে বাড়ছে, বাড়ছে বিউটি পার্লারের সংখ্যা; এটার পেছনে উস্কানি দিচ্ছেই এই সুশীল শ্রেণী৷ মূলত কালারিজমে এই শ্রেণীর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদেই বর্ণবাদ আর পুঁজিবাদ এখন একসাথে হাঁটছে৷ কালারিজম আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকেছে যে এটা যাঁরা করছেন আর যাঁরা শিকার হচ্ছেন উভয়েই জিনিসটাকে অতি স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে৷ যেমন যে মেয়েটার গায়ের রঙ কালো তাকে হরহামেশাই কেউ না কেউ পরামর্শ দিতেই থাকে কিভাবে রঙ ফর্সা করা যায়মেয়েটার বাবা মাকেও তারা সাবধান করে দিয়ে যায় যে গায়ের রঙ কালো বলে তার জন্য ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না অথবা তাকে বিয়েই দেওয়া যাবে না৷ বেশিরভাগ মেয়ে এই কালারিজমের ভিক্টিম হয়েও এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় বলেই রং ফর্সাকারী ক্রিমের এতো ছড়াছড়ি৷


প্রসঙ্গত এই মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে সবথেকে বড়ো সমস্যা৷ মেয়েটির যোগ্যতা, শিক্ষা, ব্যবহার, মূল্যবোধ, রুচির চেয়ে বড়ো হতে দাঁড়ায় তার গায়ের রঙ৷ 'মা কালো হলে ছেলেমেয়েও কালো হবে’, তাই পাত্রের ফর্সা সুন্দরী পাত্রী চাই৷ তবে হ্যাঁ সভ্য সমাজ বলে কথা! কালো মেয়েটি যদি চাকরিজীবী হয় তাহলে তার কৃতিত্বে কিছু নম্বর যোগ হয়তখন পাত্রপক্ষ একটু বিবেচনা করার আশ্বাস দেয় আরকি


জ্ঞান, বুদ্ধি চেতনার উন্মেষকালে যে মেয়েটি জেনে যায় সে 'কালো', নিজের প্রতি এক হীনম্মন্যতা আঁকড়ে ধরে তাকে৷ অন্য ছেলে মেয়েদের থেকে তার লড়াইটা পদে পদে বাড়ে৷ এই ধরুন, স্কুল/কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছেঅনুষ্ঠানের প্রধান বিশেষ অতিথিকে ফুল দেওয়ার দায়িত্ব সবসময় পড়ে ক্লাসের সবথেকে ফর্সা সুন্দরী মেয়েটার তা সে পড়ালেখায় যেমন হোক৷ এই বৈষম্যের চিত্রটি খুব পরিচিত আমাদের কাছে৷ কালারিজমের আরেকটা সাধারণ চিত্র দেখা যায় সবসময়; পাঁচ ছয় বছর বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ের গায়ের রঙ যদি কালো হয় তবে শপিং মলে গিয়ে তার অভিভাবকই অবলীলায় বলবে, ‘ এই রঙ ওকে মানাবে না আপনি অন্য রঙের জামা দেখান৷বাচ্চাটার কোন রঙ পছন্দ তাতে কার কী এসে যায়


স্কুলে যখন পড়তাম আমার সহপাঠীরা প্রায়শই নিজেদের হাত পাশাপাশি রেখে বিচার করতো কে কত ফর্সা কে কত কালোএটা খুব সাধারণ আসলে সবার কাছে৷ এমন সূচালোভাবে ঢুকেছে কালারিজম আমাদের মধ্যে যে আমরা অবচেতনভাবে এটার চর্চা করছি বিরামহীন৷ এইযে দেখুন না, রূপকথার গল্পগুলোতে রাজকুমার / রাজকুমারী সে হয় তুষারের মত শুভ্র রঙের অথবা দুধে আলতা গায়ের রঙ হয় তার আর রাক্ষস/ রাক্ষসী হয় কালো মোটা৷ এখানে কালো রংটাকেই উপস্থাপন করা হয় ভয়ঙ্করভাবে৷ আমরা এইগুলো পড়তে পড়তেই তো বড় হয়েছি এজন্য কালারিজম আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। 


এডভারটাইজিং কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া একটি কথা বলেছে। আর তা হল সৌন্দর্যের একক কোনও মাপকাঠি নেই। সৌন্দর্যের একক কোনও মডেল নেই। তাই ফর্সা সুন্দর, কালো অসুন্দর নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এর নেই কোনও যুক্তি।কালারিজমকে  আমাদের সংস্কৃতি থেকে বাদ দেওয়া এত সহজ হবে না তবে এটা নিয়ে কথা বলা জরুরিসবাইকে জানাতে হবে যে এটাও একটা অপরাধ আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এই সামাজিক ব্যধি থেকে।  যতদিন না আমরা আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে না পারবো ততদিন কালারিজম সমাজে বিরাজ করবেই৷ 


লেখা - নওশীন আনজুম নিধি


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles