আর্য রহস্যের অনুসন্ধান পর্ব-২

.

নিবন্ধ

ইতিহাস | History

আর্য রহস্যের অনুসন্ধান পর্ব-২

 

দীর্ঘ দুই শতাব্দী ব্যাপী আর্যদের উৎপত্তি সংক্রান্ত পরিপ্রেক্ষিতে ভাষাতত্ত্বের কচকচানি চললেও কোন সমাধানসূত্র তো দূরে থাক বরং সমগ্র বিষয়টিই আরও জটিল হয়ে যায়।একের পর এক কল্পনা ও তত্ত্বের সমাহারে বিতর্ক ঘোরালো হয়ে ওঠে। এমন এক দিশাহীন পরিস্থিতিতে আনাতোলিয়া বা তুরস্কে ও ভারতে কয়েকটি নতুন সভ্যতার আবিষ্কার আর্য বিতর্কে আবারো নয়া মাত্রার সঞ্চার করে। এশিয়া মাইনরে অবস্থিত ভোগসকাই যা একদা হিত্তিয়দের রাজধানী ছিল,সেখান থেকে প্রাপ্ত একটি লেখাতে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র ও নাসত্য এই চারটি নাম পাওয়া যায়, যাঁরা আবার বৈদিক সাহিত্যে দেবতা হিসেবে স্থান পেয়েছেন। এছাড়া এই লেখাটি থেকে ঘোড়া বা অশ্বের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায় এবং এই সম্পর্কিত একই গ্রন্থের উল্লেখও পাওয়া যায়। 

আর্য নিয়ে আরও জানতে দেখুন থিংকের ভিডিও আর্যরাই কি গড়েছিলো প্রাচীন ভারত?

এই অশ্বের তথ্য এক নতুন সমস্যার জন্ম দেয়। হিন্দু মৌলবাদী ঐতিহাসিকরা আর্যদের ভারতীয় রূপে অভিহিত করলেও,অশ্বের সুপ্রাচীন নিদর্শন ভারতে পাওয়া যায়নি। আর্যরা এমন এক জাতি অশ্ব ও অশ্ব-চালিত রথে অভ্যস্ত ছিল অথচ ভারতীয় সভ্যতার সুপ্রাচীন নিদর্শন হরপ্পা সভ্যতাতে অশ্বের নিদর্শন নেই। ফলে ভারত আর্যদের আদি বাসস্থান নয় এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা ‘আর্য-অশ্ব’ একদম সমার্থক করে ফেলেছেন। ওতে লাভ কিচ্ছু হয়নি বরং এই দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতা প্রকৃত ইতিহাসই বিকৃত করে ফেলেছে। ভোগসকাই লেখর ভিত্তিতে ঋগ্বেদ রচনার যে সময়কাল নির্ণীত হয়েছে তা হল যিশুর জন্মের প্রায় পনেরোশো বছর পূর্বে ও ঋগ্বেদের একদম প্রাথমিক পর্যায় তুরস্কে রচিত হয়েছিল এবং বারোশো খৃস্ট পূর্বাব্দে তুরস্ক থেকে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে। মারিয়া গিমবুটাস ‘কুরগান সংস্কৃতি’-র ওপর ভিত্তি করে ককেশাস অঞ্চলে আর্যদের আদি বসতি ছিল বলে মনে করেন। আসলে কুরগান হল সমাধি সংক্রান্ত এক রীতি; এই রীতি অনুসারে সমাহিত ব্যক্তির সাথে অশ্বসহ অন্যান্য গবাদি পশুও সমাধিস্থ করা হত। তবে ককেশাস আর্যদের আদি বসতি কিনা তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না,কারন এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সমাধিগুলিতে যে মনুষ্য দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তা আবার নরডিক জাতির মানুষের সমজাতীয়।

 দক্ষিন রাশিয়ার কাজাখস্তান থেকে আবিষ্কৃত ‘আন্দ্রনোভো সংস্কৃতি’র ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,এই সভ্যতার অন্তর্গত পশুপালক গোষ্ঠী অশ্বের সাথে সুপরিচিত ছিল এবং এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত গবাদিপশুর দেহাবশেষের মধ্যে আশি শতাংশই অশ্বের।এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এলিনা কুজমিনা উল্লেখ করেছেন যে, পন্টিক-কাস্পিক অঞ্চল হল আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর আদি বাসভূমি এবং এখান থেকেই একটি শাখা ইউরোপে চলে যায় ও আরকটি শাখা ইরানে চলে যায়। ইরানের শাখাটি থেকে ভেঙে আরেকটি শাখা আবার ভারতে প্রবেশ করে। ইউরোপে যে আর্যদের একটি শাখার অভিপ্রয়াণ হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই এবং পরবর্তীকালে হিটলারের সময়ে ‘জার্মানরা আর্য’ এই জাতীয় ধারনা গড়ে উঠেছিল।

সমস্যা হল আর্যদের যে শাখাটি ইরান বা তদানীন্তন পারস্যে প্রবেশ করেছিল তাদের নিয়ে। প্রাচীন পার্সিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ‘জেন্দ আবেস্তা’ যার সাথে বৈদিক সাহিত্য সম্ভারের প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে যেখানে ‘দেব’ শব্দটি বেদে অত্যন্ত পবিত্র সেখানে আবেস্তাতে ‘দেব’ শব্দটি নেতিবাচক অর্থ বহন করে এবং সেখানে ‘অসুর’ সত্তার প্রতি স্তুতি বর্ষিত হয়েছে। সর্বোপরি বৈদিক দেবতা বরুণের সম্বন্ধে আবেস্তা ঋণাত্মক মনোভাব প্রকাশ করেছে।

সম্ভবত ইরানে প্রবেশের পর আর্যদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল, তাই একটি গোষ্ঠী ভারতে চলে এসে ইরানীয় আর্যদের বিপরীত এক ধর্মীয় ব্যবস্থা পত্তন করে। যদিও এই বিষয়টি এতটা সরল নয়। কারণ বেদে অনার্য, মুণ্ডারী ও দ্রাবিড় ভাষার প্রায় তিনশোটি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই অনেকেই মনে করেন আর্যরা ভারতীয় এবং ভারত থেকেই তারা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। জেন্দ আবেস্তা ও ঋগ্বেদের সময়কাল প্রায় একই হওয়ায় এই প্রশ্নের সমাধান বেশ কঠিন।

আর্যরা ভারতীয় না অভারতীয় সেই বিতর্কে ঐতিহাসিক মহলে নানা মুনির নানা মত। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠই আর্যরা অভারতীয় এই মতে বিশ্বাসী। জ্যোতির্বিদ রাজেশ কোচাহার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’ গ্রন্থের বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, এই গ্রন্থে সর্বদীর্ঘ দিন ও ক্ষুদ্রকালীন রাতের যে তথ্য রয়েছে,তার অনুপাত করলে হয় ৩:২। এই প্রকার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অঞ্চলের সম্ভাব্য অবস্থান হতে পারে ৩৫ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা। একমাত্র হরপ্পা সভ্যতার শোরটুগাই ছাড়া আর অন্য কোন অঞ্চল এত উচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত নয়,সুতরাং সামগ্রিক ভাবে আর্যরা ভারতীয় হতে পারে না। আবার কলিন রেনফ্রিউ-এর মতে, ঋগ্বেদে কোথাও বলা হয়নি যে আর্যরা বহিরাগত। সুতরাং এটার সম্ভাবনাই প্রবল যে আর্যরা বেদ রচনার বহু পূর্বেই ভারতে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। কিন্তু আর্যরা অভারতীয় এই তত্ত্বটা সর্বজনগ্রাহ্য নয়, কারণ এর পেছনে বেশ কিছু যুক্তি আছে, যা অস্বীকার করার মত নয়। 

বেদে বার্চ গাছের উল্লেখ পাওয়া যায় আর এই গাছ আবার ককেশাস ও স্তেপ অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ। অন্যদিকে নব্য প্রস্তরযুগীয় কাশ্মিরের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের নাম হল বুর্জাহাম, যেখান থেকে যিশুর জন্মের পূর্ববর্তী প্রায় দু-হাজার পাঁচশো বছরের প্রাচীন বার্চ গাছের অবশেষ পাওয়া গেছে। সর্বোপরি আমুদরিয়া নদীর উচ্চ উপত্যকায় প্রাপ্ত ‘অক্সাস সভ্যতার’ সাথে হরপ্পার বস্তুগত সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক অ্যাসকো পারপোলা, ভিক্টর সরিয়ানিধি এরা মনে করেন যে দু-হাজার খৃস্ট পূর্বাব্দে অক্সাসের বাসিন্দারা হল আর্য ও তারা মেহেরগড়ে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এই মেহেরগড়ই হরপ্পা সভ্যতার পটভূমি রচনা করেছিল। বিস্ময়কর ভাবে অক্সাস অঞ্চলে অশ্বের কোন অবশেষ পাওয়া যায়নি, কেবল  একটি মৃৎপাত্রে অশ্বের চিত্র পাওয়া গেছে। সুতরাং আর্য আর অশ্ব পরস্পরের সাথে কতখানি সম্পৃক্ত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। 

ঋগ্বেদের ভাষ্যে দেখা যায় যে নদীগুলির নামোল্লেখ রয়েছে সেগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী। তাই এই থেকে অনুমান করা যায় যে, আর্যরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে গমন করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে ভারত যদি আর্যদের আদি আদি বাসভূমি হয়,তাহলে ভারতের কোথায় তাদের বাসস্থান ছিল তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ মনে করেন হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চল ও তিব্বত, আবার কারো মতে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা, আবার অনেকে মুলতান ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে আর্যদের বাসভূমি রূপে অভিহিত করেছেন। একইভাবে আর্যরা যদি বহিরাগত হয়, তাহলে কোথায় তাদের বসতি ছিল তা নিয়েও ভিন্নতার অভাব নেই। কেউ দক্ষিণ রাশিয়া ও ইউক্রেন, কেউ পামির উপত্যকা আবার কেউ পোল্যান্ড ও ইউরেশিয়া অঞ্চল আর্যদের আদি বাসভূমি রূপে বিবেচনা করেছেন।

আর্য বিতর্ক ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় যা’র সঠিক সমাধানসূত্র নির্ণয় অত্যন্ত দুরূহ, তবে অসম্ভব নয়। সর্বপ্রথম সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে এই সমস্যাটি আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। আর্যরা যে অভারতীয় এই বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে মধ্য এশিয়ায় এদের উৎস অনুসন্ধান করলে তা সফল হবে। 

আর্য সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হল নিরবচ্ছিন্ন অনুভূমিক উৎখনন, বিশেষত তুরস্ক, ইরান, ইরাক এসব অঞ্চলে আর্য সভ্যতার প্রচুর উপাদান এখনও লুক্কায়িত রয়েছে। এটা কোন কাল্পনিক অবতারণা নয়। সাম্প্রতিক কালে তুরস্কের গোবেকেলি টেপে অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রায় সাত হাজার বৎসরের প্রাচীন মন্দির ও ইউক্রেনে প্রাপ্ত স্বস্তিকা প্রতীক আর্য ইতিহাসকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। সর্বোপরি হরপ্পা সভ্যতায় আর্য প্রভাব খোঁজার প্রয়াস বৃথা। কারন বেদে ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ রূপে অভিহিত করা হয়েছে,কারন তিনি ‘হরি-গুপয়’ এর যুদ্ধে পুর বা নগর ধ্বংস করেছিলেন;আর এই হরি-গুপয় হল হরপ্পা। হরপ্পার বেশ কিছু সাইটে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির আঘাত পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে অতর্কিত আক্রমণে এদের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া অনেক জায়গায় কঙ্কালের স্তূপ পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায় রীতি মেনে তাদের সৎকার হয়নি। হরপ্পার পতনের পেছনে যে বৈদেশিক আক্রমণকে দায়ী করা হয়, সেই আক্রমণকারীরা আর অন্য কেউ নয়, তারাই হল আর্য। সুতরাং আর্যরা বিদেশী এবং শুনতে খারাপ লাগলেও মেনে নিতেই হয় যে বৈদিক সভ্যতার জন্মদাতারা ভারতের সুপ্রাচীন নগরসভ্যতার নির্মম ধ্বংসকারী ছিল এবং তারা কোনদিনই নগর সভ্যতার নিরিখে প্রাচীন ভারতীয়দের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি।


প্রথম পর্ব ১- https://www.sabinaislam.com/think/article/arjo-rohossher-anusandhon

 

সায়ন দেবনাথ, এম ফিল, প্রথম বর্ষ

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles