কেন মানুষের মধ্যে এত রকমের গায়ের রং দেখা যায়?
ফর্সা মানেই সুন্দর, আর কালো হয়ে জন্মেছেন মানেই অসুন্দর, খারাপ। কালো মেয়ের বিয়ে হবে না ভেবে আমাদের দেশের বাবা মায়ের আজো সে কী চিন্তা! শুধু আমাদের কথাই বলি কেন, এই গায়ের রঙের অজুহাত দিয়ে মাত্র কয়েকশ' বছর আগেও, ইউরোপ, আমেরিকাতে হালাল করা হয়েছিল আফ্রিকার কালো মানুষদের দাসত্ব। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও সত্যি যে গায়ের রঙের ভিত্তিতে আমেরিকাতে ষাটের দশক পর্যন্ত, সাউথ আফ্রিকাতে ৯০-এর দশক পর্যন্ত, কালোদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছিল। কাগজে কলমে সমানাধিকার পেলেও এখনো তাঁরা লড়াই করে চলেছেন এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে।
গায়ের রঙের পার্থক্য নিয়ে দেখুন থিংকের বানানো ভিডিও এতো রঙের মানুষ কেন?
কিন্তু কেন মানুষের মধ্যে এত রকমের গায়ের রং দেখা যায়? গায়ের রঙের এই সাদা-কালো বলতে আসলে কী বোঝায়? এর ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের বা সামাজিক নিপীড়নের কি আসলেই কোন ভিত্তি আছে?
মানুষের গায়ের রঙের, এত বৈচিত্র্যের পেছনে লুকিয়ে আছে আফ্রিকা মহাদেশে আমাদের প্রজাতির বিবর্তন এবং সূর্যের সাথে মানুষের নিবিড় শারীরবৃত্তীয় সম্পর্ক আর সেই সাথে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, বিভিন্ন পরিবেশে, জলবায়ুতে আমাদের ছড়িয়ে পড়ার গল্প। আমরা জানি, বিবর্তনের ধারায় আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হল শিম্পাঞ্জি। মনে করা হয় প্রায় ১২ লাখ বছর আগে, মানুষের পূর্বসূরিরা যখন আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করত, তাদেরও ছিল শিম্পাঞ্জির মতই কালো লোমে ঢাকা সাদা চামড়া।
যখন তারা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় দ্বিপদী হয়ে , আফ্রিকার খোলা তৃণভূমিতে বিচরণ শুরু করে, তাদের শরীরও পুড়তে শুরু করে প্রখর রোদে। লোমশ শরীরে তো আর সহজে ঘাম শুকায় না - তাই শরীরকে বেশি গরম হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারায় ধীরে ধীরে তাদের লোম বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ওদিকে আবার বিষুব অঞ্চলের চড়া সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির মধ্যে যে UV-B রশ্মি আছে তা চামড়ার ডিএনএ-কে ভঙ্গুর করে তোলে, যা থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। আর UV-B রশ্মি আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিটামিন বি-৯ বা ফোলেট-কে নষ্ট করে। গর্ভস্থ শিশুর ঠিকমত বেড়ে ওঠার জন্যও, এই ফোলেট অপরিহার্য। এই UV-B রশ্মি থেকে অরক্ষিত সাদা চামড়ার নিরাপত্তা দিতে পারে মেলানিন - যে-রঞ্জক পদার্থটি আমাদের দেহে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়। গাঢ় রঙের মেলানিন তৈরি করে কালো চামড়া, তা সূর্যের আলোর সাথে UV-B রশ্মিও শুষে নিয়ে এক ধরনের প্রাকৃতিক ছাতার মত কাজ করে।
তাই ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায়, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কালো চামড়ার উদ্ভব ঘটে। এর পর ৭০-৫০ হাজার বছর আগে, তারা আফ্রিকা থেকে, বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এদের মধ্যে যারা মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল তাদের উত্তরসূরিদের এখনো দেখা যায় ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের নেগ্রিটো, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে। তারপর ৬০-৫০ হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে যারা বাস করতে শুরু করেছিল তাদের একাংশ উত্তর দিকে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। অর্থাৎ, কালো বা বাদামি রঙের মানুষেরাই ছিল ইউরোপের প্রথম অধিবাসী।
তবে তখন সেখানে দেখা গেল এক্কেবারে উল্টো আরেক সমস্যা। বিষুবরেখা থেকে আপনি যত দূরে যাবেন ততই সূর্যের তেজ কমতে থাকে। ফলে উত্তরের দুর্বল সূর্যালোক থেকে আমাদের ঘন কালো রঙের চামড়ার পক্ষে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি তৈরি করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। ভিটামিন ডি-এর অভাবে তাদের হাড়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করল। তাই ৩০ হাজার বছর আগে মানুষ যতই উত্তরে বসতি স্থাপন শুরু করে ততই তাদের চামড়ায় মেলানিনের পরিমাণও কমতে থাকে। দেখা গেল, যাদের চামড়ায় গাঢ় মেলানিনের পরিমাণ কম, তারাই বেশি ভিটামিন ডি তৈরি করতে পারছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় তারাই নির্বাচিত হতে শুরু করল বেশি করে এবং পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তার ঘটতে থাকলো তাদেরই জিনের। এভাবেই উত্তর গোলার্ধে, টিকে-থাকার দায়েই, আবার শুরু হলো ফর্সা চামড়ার বিবর্তন। আধুনিক বংশগতীয় গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, ৩০ থেকে ১০ হাজার বছর পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে ঘটেছে এই বিবর্তন।
আবার, এই বিবর্তনের আগেই যেহেতু মানুষ ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ায় ভাগ হয়ে আলাদাভাবে বসবাস শুরু করেছিল, তাই এদের মধ্যে ফর্সা চামড়ার বিবর্তনও হয়েছিল আলাদা আলাদাভাবেই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং চিন, জাপানের মত পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সাদা চামড়ার বিবর্তনের বংশগতীয় পরিবর্তন ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। ড. কৌস্তুভ অধিকারী ও তাঁর গবেষক বন্ধুরা সাম্প্রতিক একটা গবেষণাপত্রে এমন একটা জিন দেখিয়েছেন যা শুধু পূর্ব এশিয়ার মানুষদেরই চামড়ার রঙ হালকা করায় ভূমিকা রাখে।
এবার আসি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এত রকমের গায়ের রং কেন দেখা যায় সেই প্রসঙ্গে। থিংক-এর 'আর্যরাই কি গড়েছিল প্রাচীন ভারত ' ভিডিওতে, আমরা ভারতে বহু জাতির আগমন নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আদি ভারতীয়রা, যাঁরা ৭০-৫০ হাজার বছর আগে, আফ্রিকা থেকে এসে এখানে বসতি গড়েছিলেন, তাঁদের গায়ের রং ঘন বাদামি বা কালোই ছিল। উত্তরের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাবসীরা মিশেছেন ইরানিদের সাথে তারপর উত্তর থেকে আসা স্তেপবাসী আর্যদের সাথে যাঁরা ছিলেন সেই ইউরোপীয় সাদা চামড়ার অধিকারী। ক্রমে ক্রমে সেই মিশেল ছড়িয়ে পড়েছে সারা উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মাত্রায়। এছাড়াও পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বহু জাতির সাথেও মিশ খেয়েছি আমরা যেখান থেকে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এত ধরনের, এত রকমের গায়ের রং। আমরা আক্ষরিকভাবেই বর্ণসঙ্কর।
তবে আজকের আলোচনাটা শেষ করার আগে চলুন ডঃ অধিকারীর কাছ থেকে জেনে নেই আপনাদের করা কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর।
- বাবা মায়ের সাথে বাচ্চাদের গায়ের রং এর সম্পর্ক কী?
গায়ের রঙের বংশগতি খুবই জটিল। এটা নির্ভর করে অনেক গুলো জিনের অনেক রকমফের এর উপর। কোনো সন্তান তার মা বা বাবার থেকে ঠিক কোন কোন জিনের কোন প্রকারভেদটা পাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে সন্তানের গায়ের রঙ। এজন্যই দেখা যায়, একই দম্পতির বিভিন্ন বাচ্চার গায়ের রঙ প্রায়ই নিজেদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি বাবা মায়ের চেয়েও খানিকটা আলাদা হয়।
- গায়ের রঙের জিনের সাথে বুদ্ধিমত্তার কী কোন সম্পর্ক আছে?
- না নেই। এরকম কোন জিনগত সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ধারণাগুলো মূলত এসেছে গত কয়েক শতাব্দীতে, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সময়ে, আফ্রিকা থেকে ধরে আনা কালো মানুষদের উপর চাপিয়ে দেওয়া দাসত্বের বৈধতা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বর্ণবাদী মতবাদের জন্ম দেওয়া হয়েছে।
- অনেকে প্রশ্ন করেছেন, শুধু সাদাদের মধ্যে কেন উন্নত সভ্যতা দেখা যায়?
- তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমরা কি শুধু গত কয়েকশ বছরের পৃথিবী দিয়েই উন্নত সভ্যতার বিচার করব? প্রাচীন মিশরীয়, ভারতীয়, চৈনিক সভ্যতা, আফ্রিকার কুশ, আমেরিকার মায়া, আজতেক বা ইনকা সভ্যতার কথা ভুলে যাব? গত কয়েকশ বছরের পুঁজিবাদের উত্থান, বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপন এবং শোষণের কারণেই গড়ে উঠেছে আজকের সাদাদের তথাকথিত উন্নত সভ্যতা।
- ফর্সা রং এর প্রতি আমাদের এত লালাঝরা অনুরক্তি কেন?
সাদা চামড়ার প্রতি আমাদের এই অনুরাগ সম্ভবত এসেছে আর্থসামাজিক কারণে। ভারতে যখন ফর্সা আর্যরা এসে ধীরে ধীরে নিজেদের উঁচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বলে ঘোষণা দিয়ে গেড়ে বসল, অন্যদিকে ভারতের তৎকালীন গাঢ় চামড়ার মানুষদের শূদ্র, চণ্ডাল এসব নিচু জাতের তকমা দেওয়া হল, তখন থেকেই হয়তো আমাদের মনে এই যোগাযোগটা তৈরি হয়ে গেছে যে ফর্সা মানুষ মানেই উঁচু জাত, ভালো বংশের ইঙ্গিত। এই ধারণাটা হয়তো আরো পোক্ত হয় ব্রিটিশ আমলে।
সত্যি বলতে, এই মনোভাব যে শুধু ভারতেই আছে তা-ও না। ল্যাটিন আমেরিকায়ও যেহেতু ইউরোপীয়রা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেখানেও দেখা যায় সমাজে ফর্সাদের সমাদর বেশি - স্প্যানিশদের বংশধর তারা, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থানও সাধারণত তুলনামূলকভাবে ভাল।
চলুন বাংলার লোককবির গানের পংক্তি দিয়ে শেষ করি , নানান রঙের গাভিরে ভাই, একই গাইয়ের দুধ। জগৎ ভরমিয়া দেখি, একই মায়ের পুত। আমরা সবাই একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত, আমাদের মধ্যে গায়ের রং এর এই বাহ্যিক পার্থক্য ঘটেছে জীবতাত্ত্বিক কারণে। হয়তো একদিন আমরা সেটা বুঝতে পারব এবং মানুষ হিসেবে বেরিয়েও আসব এসব বৈষম্য, বিভাজন ছেড়ে ।
লেখা- কৌস্তুভ অধিকারী, বন্যা আহমেদ