১৯৭০ থেকে ২০২০--এই ৫০ বছরে পৃথিবীর বুক থেকে "হারিয়ে গেছে" প্রায় চৌদ্দ কোটি কন্যা শিশু সন্তান। এর মধ্যে কেবল চীনেই "লাপাত্তা" সাত কোটির বেশী কন্যা শিশু সন্তান; ভারতে সাড়ে চার কোটির অধিক। না, আসলে এরা "হারায়নি" - এর কারণ পুত্রের তুলনায় কন্যা সন্তানের প্রতি বাবা-মার অনীহা এবং লিঙ্গ বৈষম্য এর কারণে এসব কন্যা সন্তানদের কাউকে ভ্রুনাবস্থায় পক্ষপাতমূলক গর্ভপাত এর মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, কাউকে বা ইচ্ছা করে মেরে ফেলা হয়েছে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে - দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থায় এধরণের ঘটনা বিরল নয়।
দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এখনও অনেকে মনে করেন যে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারন করেন মা। এজন্য অনেক নারীকে বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়, এমনকি এই কারণে ডিভোর্স বা ছেলেদের একাধিক বিয়ের ঘটনাও বিরল নয়!
কিন্তু আসলেই কি মা সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করেন নাকি এর পিছনে প্রধান ভূমিকা বাবার? আসুন আজকে জেনে নেই, ঠিক কীভাবে নির্ধারিত হয়, মায়ের গর্ভের সন্তানটি ছেলে হবে না মেয়ে হবে?
অন্যান্য জীবের মত মানুষের দেহ ও কোষ দিয়ে তৈরী -- একটা, দুটা নয়, কয়েক ট্রিলিয়ন কোষ। তবে আমাদের সবার জীবনের শুরু হয়েছে একটা মাত্র কোষ থেকে। এই প্রথম কোষ বা জাইগোটে রয়েছে ৪৬টি, মানে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের একটি পূর্নাংগ "সেট"। "সেট" বললাম কেন?
এই ৪৬টি বা ২৩ জোড়ার অর্ধেক বা ২৩টি এসেছে বাবার শুক্রাণু থেকে, আর ২৩টি এসেছে মার ডিম্বাণু থেকে। নারী এবং পুরুষের শরীরে একমাত্র শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুই জোড়াবিহীন, তাই এগুলিকে হ্যাপ্লয়েড বা জেনেটিক বিচারে হাফ কোষ বলা হয়, বাকি সব কোষই কিন্তু ডিপ্লয়েড অর্থাত তাতে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। এখন বাবা মার মিলনের ফলে এই দুই হ্যাপ্লয়েড কোষ, শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু এক হয়ে জাইগোট তৈরি করে, তখন ২৩ আর ২৩ যোগ হয়ে সেট সম্পূর্ন হয়, আর জাইগোটকে বলা হয় ডিপ্লয়েড কোষ।
আদি ডিপ্লয়েড জাইগোট কোষটি মাইটোসিস নামক কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় দুই ভাগ হতে থাকে একটা থেকে দুটা, তারপর চারটা, আটটা এভাবে এক সময় ভ্রূণে রূপ নেয়। ভ্রূণ থেকে এক সময় মানব সন্তান।
কিন্তু ছেলে হবে না মেয়ে হবে সেটা কীভাবে নির্ধারিত হয় ?
কোষের নিউক্লিয়াসের ভিতরের সেই ক্রোমোজোমই বলা হয় জেনেটিক বা বংশগতিয় মেটেরিয়াল এর বাহক, অর্থাত বাবা মার বৈশিষ্ট্য সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত করে। ক্রোমোজোমের গায়েই কুণ্ডলী আকারেই প্যাঁচানো থাকে ডিএনএ।
তবে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের ২৩তম জোড়াটি নারী এবং পুরুষের কোষে আলাদা। এদের বলা হয় সেক্স বা লিঙ্গ ক্রোমোজোম কারণ সন্তানের লিঙ্গ কি হবে তা নির্ভর করে এদের ওপর।
নারীর ক্ষেত্রে দুটো সেক্স ক্রোমোজোম দেখতে একই রকম। এক্স এবং এক্স (XX) । পুরুষের ক্ষেত্রে তা নয়। সেক্স ক্রোমোজোমের একটি এক্স (X), একটি ওয়াই (Y)। এই ওয়াই (Y) ক্রোমোজোম আকারে এক্স (X) ক্রোমোজোমের তিন ভাগের এক ভাগ।কিন্তু খর্বাকার এই ওয়াই ক্রোমোজোমের ওপর নির্ভর করে সন্তানের লিঙ্গ কী হবে।
নারী এবং পুরুষের জনন কেন্দ্র অর্থাৎ শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয়ে যে কোষ বিভাজন হয় একে বলা হয় মিয়োসিস। সেটা শরীরের অন্যান্য সব কোষ বিভাজন বা মাইটোসিস থেকে একেবারে আলাদা। জনন কেন্দ্রে এই মিয়োসিস বিভাজনের সময় ডিপ্লয়েড সেল অর্ধেক হয়ে হ্যাপ্লয়েডে পরিণত হয় এবং ক্রোমোজোম এর সংখ্যা ৪৬ থেকে বা ২৩ এ নেমে আসে।
তার মানে এক্স এক্স (XX) জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম ধারী নারীর ডিম্বাণুতে সর্বদা থাকবে কেবল একটি এক্স (X)। পক্ষান্তরে এক্স ওয়াই (XY) জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম ধারী পুরুষের শুক্রাণুর ক্রোমোজোমটি হতে পারে এক্স (X), আবার হতে পারে ওয়াই (Y)। মানে শতকরা ৫০% সম্ভাবনা।
অন্যভাবে বললে, ছেলেদের কোটি কোটি শুক্রাণুর অর্ধেক সংখ্যক এক্স, অর্ধেক ওয়াই। অন্যদিকে মেয়েদের ডিম্বাণুর ক্রোমোজোম সর্বদাই একটা এবং তা এক্স (X)।
বাবার এক্স (X) শুক্রাণু যদি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, তাহলে জাইগোটটি হবে এক্স এক্স (XX) মানে, মেয়ে। বাবার ওয়াই (Y) শুক্রাণু যদি ডিম্বাণুকে ভেদ করে, জাইগোটটির লিঙ্গ হবে এক্স ওয়াই (XY), মানে ছেলে।
ওয়াই ক্রোমোজোম এর মধ্যে আছে পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারনকারী জিন যাকে বলা হয় SRY জিন। এর ফলে ভ্রূণে পুরুষ ইন্দ্রিয়ের এর বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ সন্তানটি ছেলে হয়ে ওঠে।
তবে মাঝে মাঝে কোষ বিভাজনে ও ভ্রম বা ব্যতিক্রমও ঘটে ফলে ক্রোমোজোম গুলি সমান ভাগে বিভক্ত হয় না তবে সেই আলোচনা আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো?
যেহেতু ছেলে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারনকারি ওয়াই ক্রোমোজোম শুধু বাবার শরীর থেকেই আসতে পারে, তার মানে - মেয়ে সন্তান জন্মালে সেটার কারন হচ্ছে বাবার এক্স শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করেছে।
তার পরেও কেন আজও সমাজে মায়েদেরকে দোষারোপ করা হয়?
এটার কারন, অজ্ঞতা এবং সমাজ বদলাতে সময় লাগে। আজকাল বেশির ভাগ দেশেই ছেলে এবং মেয়ের সমানভাবে বাবা মার দায়িত্ব নেওয়ার এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে তাই হয়তো এই মানসিকতারও দ্রুত পরিবর্তন হবে।
আশার কথা, বাংলাদেশে ছেলে শিশুর প্রতি মোহ মায়েদের মধ্যে এবং সমাজেও কিছুটা কমছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে এখনো মা হননি, এমন মহিলাদের মধ্যে ছেলে বা মেয়ে শিশুর প্রতি কোন পক্ষপাত নেই। ছেলে শিশু আছে, এমন পরিবারে মেয়ে শিশুর চাহিদা বেশি, যদিও মেয়ে শিশু আছে এমন পরিবার ছেলে শিশু চায়।
আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যখন সমাজ এবং বাবা মা জন্ম নেয়া কিংবা অনাগত একটি শিশুর মূল্যায়ন করবে শিশুটির লিঙ্গ কি তা দেখে নয় বরং মনোযোগ থাকবে শিশুটিকে কি ভাবে একজন সচেতন, শিক্ষিত এবং দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে দিকে। জন্মের স্বার্থকতা হোক কর্মে, লিঙ্গে নয় ।