মাসিক কি এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ ?
মেয়েদের মাসিক কী? মেয়েদের মাসিক হলে করণীয় কি মেয়েদের মাসিক হলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা ব্যথা নিরসনে দরকার পুষ্টিকর খাবার আর যথাযথ পরিচর্যা। মেয়েদের মাসিক হলে শরীর থেকে ভিটামিন ও খনিজ বের হয়ে যায় - এজন্য চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সাথে কথা বলে সুষম খাদ্যের তালিকা করে তাকে খাওয়াতে হবে।
মাসিক! Menstruation কথাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ menstrua থেকে যার অর্থ মাস।
মাসিক নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও মেয়েদের মাসিক কেন হয়?মেয়েদের মাসিক কেন হয়?
মেয়েদের জীবনে একটি অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু প্রাণিকুলের মধ্যে কেবল মানুষের মত স্তন্যপায়ী গোত্রের কতিপয় প্রাণী, যেমন আফ্রিকার Rhesus macaques বানর, গ্রেট এপ মাসিকের অভিজ্ঞতা পায়। শিম্পাঞ্জি, ওরাং ওটাং, গিবনের মধ্যেও খুব অল্প পরিমাণে মাসিকের রক্ত দেখা যায়। এছাড়াও Cebus, Ateles, Alouatta, Lagothrix গোত্রেও মাসিকের দেখা পাওয়া যায়।
মাসিক আসলে কী? মেয়েদের শরীরে এস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টরোন হরমোন কাজ করে। প্রতি মাসে এই হরমোনের ফলে মেয়েদের জরায়ু গর্ভধারণের উপযোগী হয়ে উঠে। জরায়ুর একেবারে অভ্যন্তরীণ আবরণী স্তরকে বলা হয় endometrial। এই endometril (endometrium) স্তরটি প্রায় ২ থেকে ৪ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরু হয়। এই স্তরটি কয়েকটি লেয়ারে বিভক্ত থাকে এবং সমগ্র রক্তনালীর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে। যদি কোন নারী গর্ভধারণ না করে তবে প্রজেস্টরোন হরমোন হ্রাস পায় এবং পুরু স্তরটি সংকুচিত হয়ে রক্ত অপসারণ করে। এই রক্তই মূলত মাসিক।
স্তন্যপায়ী গোত্রের অন্যান্য প্রাণীর চাইতে মনুষ্য নারীর দেহে বিশেষ পার্থক্য হচ্ছে এর hemochorial প্লাসেন্টা (অমরা)। আমাদের দেহে যে প্লাসেন্টা থাকে সেইটি মাতৃদেহের রক্তনালীর সংগে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং endometrial-এর মাধ্যমে এটি রক্ত, গ্যাসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান সরাসরি ভ্রূণের দেহে সরবরাহ করে। অন্যান্য স্তন্যপায়ী গোত্রীয় প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে ভ্রূণের দেহতে সরাসরি মাতৃদেহে রক্ত প্রবাহ হয় না।
কেন কেবল মানুষসহ কতিপয় স্তন্যপায়ী প্রাণীর গোত্রের দেহেই এই hemochorial প্লাসেন্টা তৈরি হয়েছে তা ব্যাখ্যার জন্য আমাদেরকে মা এবং ভ্রূণের মধ্যকার সঙ্ঘর্ষটি বুঝতে হবে। এই মাতা এবং ভ্রূণের মধ্যকার সংঘর্ষটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে। ভ্রূণের জিনোম এবং মাতার জিনোম এক নয়। ভ্রূণের জিনোম এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাতার কাছ থেকে যত বেশি উপাদান নিয়ে নিজে বাড়তে পারে। আর মাতা জিনোম সর্বদাই ভ্রূণ যাতে পরিণত হয় সেইটি চায়। এই হাইপোথেটিক্যাল সংঘর্ষ থেকেই এই প্লাসেন্টা তৈরি হয়েছে বিবর্তনের নিয়ম অনুসারে।
তার মানে এক কথায় বলা যায়, স্তন্যপায়ী গোত্রের কতিপয় প্রাণীসহ মানুষের প্লাসেন্টার তৈরি হওয়াই মাসিকের জন্য দায়ী। কারণ এই প্লাসেন্টাই জরায়ুর মধ্যে থাকা endometrialকে হরমোন উদ্দীপক তৈরি করেছে যাতে সে মাতৃদেহ থেকে ভ্রূণে রক্ত প্রবাহ করতে পারে সরাসরি। আর তাই হরমোন উদ্দীপনায় endometrial স্তরটি প্রতি মাসে মাসিকের সুচনা ঘটায়। মাসিকের চক্র হচ্ছে ২৮-৩৫ দিনের।
এই পুরো আলোচনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এই যে মাতৃত্বকে আরও পরিণত করতেই মাসিকের আগমন। অথচ আমাদের সমাজে মা হওয়া লজ্জার বিষয় না হলেও, মাসিকের রক্ত লজ্জার বিষয়।
মাসিকের রক্ত নিয়ে নানা ধরণের কুসংস্কার তৈরি করা হয়েছে এই সমাজে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মাসিকের রক্ত দুষিত বলা হয়েছে। আব্রহামিক ধর্ম তিনটি ইহুদি, খ্রিস্ট এবং ইসলামে মাসিক হওয়া নারীকে কোন ধর্মীয় কাজ করতে মানা করা হয়েছে, তাকে অপবিত্র হিসেবে গণ্য করে ধর্মীয় স্থানে যাওয়া মানা করা হয়েছে। এই ধর্মগুলোতে এইসময়ে শারীরিক সম্পর্ককে নিষেধ করা হয়েছে। হিন্দুধর্মের মতে, একটি ঋতুমতী নারীকে অপবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং কিছু নিয়ম দেওয়া হয় অনুসরণ করার জন্য| একজন হিন্দু ঋতুমতী নারীকে রান্নাঘর, পুজোর ঘর এবং মন্দিরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয় না| তার জোরে জোরে কথা বলা, ফুল দিয়ে সেজে ওঠা ও কোনো ব্যক্তিকে স্পর্শ করা নিষেধ। এই ধর্মগুলোর এই নির্দেশনার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে মাসিক নিয়ে কিছু কুসংস্কার এবং প্রথা। নেপালে ছৌপদী প্রথাতে একজন প্রথম ঋতুবতি মেয়েকে মাসিকের সময়কালীন একটি অন্ধকার ঘরে রাখা হয়, সেখানেই খাবার দাবার দেওয়া হয়। মেয়েটি মাসিকের দিনগুলোতে পরিবারের পুরুষ সদস্যের সাথে দেখা করতে পারবে না, স্পর্শ করতে পারবে না, এতে পুরুষ সদস্যদের অমঙ্গল হবে! ঠিক এমনি ভাবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ভাবা হয়, মাসিকের রক্ত দেখলে পুরুষ অন্ধ হয়ে যাবে। মাসিকের সময় আচার ছুঁলে আচার নষ্ট হয়, মাসিকের রক্তের ফলে ঘরে ইঁদুর সাপ আসে এমনটাও ভাবা হয়ে থাকে।
মাসিকের সময় একজন নারীর দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে রক্ত বের হয়। তাই সময়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি। বাংলাদেশে মাত্র ৩৬% স্কুলপড়ুয়া কিশোরী মাসিক হবার আগে মাসিক কথাটির সম্পর্কে পরিচিত হয়। ৮৫% নারী পুরানো কাপড় অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ব্যবহার করে। চা বাগানে এই অস্বাস্থ্যকর উপায়ে কাপড় ব্যবহার করার সংখ্যা শতকরা ৯২ ভাগ।
পুরানো কাপড় মাসিকের রক্ত শোষণের ক্ষেত্রে কার্যকরী। কিন্তু একে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর উপায়ে ব্যবহার করতে হবে। মাসিকের কাপড়কে গরম পানিতে ফুটিয়ে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে কড়কড়ে রোদে শুকালেই কেবলমাত্র তা ব্যবহারের পূর্ণ উপযোগী হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ৮৫% মেয়েরাই এইভাবে কাপড় ব্যবহার করেন না। তারা অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে জায়গায় কাপড় শুকায়। যার ফলে অস্বাস্থ্যকর কাপড় ব্যবহার তাদের যৌনাঙ্গে ইনফেকশন এবং পরবর্তীতে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রকোপ তৈরি করে।
মাসিককে নিরাপদ এবং ঝামেলামুক্ত করার জন্য আধুনিক বিশ্বে স্যানাটেরি প্যাড, ট্যাম্পুন, মেনস্ট্রুয়াল কাপের প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে মাসিকের রক্ত শোষণকে বেশি কার্যকরী করে তুলতে, অনেক স্যানেটারি প্যাডে এবজরভেন্ট জেল ব্যবহার করা হচ্ছে যা শরীরের জন্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। একদম প্রাকৃতিক অর্গানিক তুলা থেকে তৈরি প্যাড জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। এই প্যাড মাটির সাথে মিশে যায় বলে পরিবেশের ক্ষতিও করেনা। তবে মাসিকের রক্ত ৪-৬ ঘণ্টার মধ্যেই ফেলে দিতে হবে, অর্থাৎ ৪-৬ ঘণ্টার বেশি রক্তাক্ত কাপড়, প্যাড ব্যবহার করা যাবে না । নারী কোন পদ্ধতি বেছে নিয়ে নিজেদের মাসিক জীবন যাপন করবে সেই সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে।
মাসিকের সময় যেহেতু প্রচুর তরল দেহ থেকে যায় তাই এইসময় নারীকে প্রচুর পানি খেতে হবে। সঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্য। মাসিকের সময় যেহেতু endometrial সংকুচিত হয় সেহেতু পেটে ব্যথা তৈরি হয়। গরম পানির ছ্যাঁকা দিয়ে এবং ডাক্তারের পরমার্শে ওষুধ খেয়ে এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অনেকের মাসিকের আগে বা পরে সাদা স্রাব নির্গত হয়। এটি স্বাভাবিক।