কৃষ্ণ বিবরের বাস্তব অস্তিত্ব
বিগ ব্যাং কাকে বলে? বিগ ব্যাং অর্থাৎ মহা বিস্ফোরণ হচ্ছে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে এ পর্যন্ত চলে আসা ধারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। বিগ ব্যাং নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা, ১৫ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি অসীম অথবা অতি ক্ষুদ্রাকার ভরসম্পন্ন অতি উত্তপ্ত বিন্দুতে পুঞ্জীভূত ছিল। বিগ ব্যাং সংগঠিত হবার ঠিক পরমুহূর্তে বিভিন্ন ধাপে সময়কে ভাগ করা হয়, যে সময় গুলোতে মহাবিশ্বের অনেককিছুর পরিবর্তন ঘটে।
১৯৬০-এর দশকে জ্যোতির্বিদরা Cygnus X-1 নামে একটি খগোল বস্তু আবিষ্কার করেন যেটি প্রচুর পরিমাণে এক্স-রে বিকিরণ করছিল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন এই সিস্টেমটিতে ২০ সৌর ভরের একটি অতিদানব নীল তারা ও ১৫ সৌর ভরের একটি ক্ষুদ্র তারা (যাকে দৃশ্যমান আলোয় দেখা যাচ্ছিল না) একে অপরের চারদিকে ঘুরছে। তাঁরা ১৫ সৌর ভরের তারাটিকে কৃষ্ণ বিবর বলে চিহ্নিত করলেন। এই হল প্রথম সম্ভাবনাময় ব্ল্যাক হোল। আমার মনে পড়ে ১৯৭৪/৭৫ সালে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় দেশ পত্রিকায় আমি প্রথম কৃষ্ণ বিবর নামটি দেখি যেখানে Cygnus X-1 নিয়ে একটা আলোচনা ছিল। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনার সময় দূরবীন দিয়ে Cygnus X-1-কে কয়েক রাত্রি ধরে পর্যবেক্ষণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল।
ব্ল্যাক হোল নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও ব্ল্যাক হোলের রহস্য জানুন
১৯৭০-এর দশকে জ্যোতির্বিদরা বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে দানবীয় কৃষ্ণ বিবরের সন্ধান পান যেগুলির ভর কয়েক লক্ষ থেকে কয়েকশো কোটি সৌর ভরের সমান। তবুও অনেক বিজ্ঞানীই কৃষ্ণ বিবরের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে আইনস্টাইনের মতই সন্দিহান ছিলেন। এরপর, কয়েক বছর আগে, এলো LIGO পর্যবেক্ষণ যা কিনা দুটি কৃষ্ণ বিবরের সংঘর্ষে উৎপন্ন মহাকর্ষ তরঙ্গ নিরূপণ করল। কিন্তু যেহেতু কৃষ্ণ বিবরের সংঘর্ষ মহাকর্ষ তরঙ্গ ছাড়া তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ (অর্থাৎ দৃশ্যমান আলো, বেতার তরঙ্গ, এক্স-রে, গামা রশ্মি ইত্যাদি) সৃষ্টি করে না তাই স্বাধীনভাবে LIGOর ফলাফলকেও অনেকে পুরোপুরি মানতে পারছিলেন না। বিশেষত যখন বলা হচ্ছিল ওই কৃষ্ণ বিবরগুলোর ভর সূর্যের চাইতে ৩০ কি ৪০ গুণ বেশি। সূর্যের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি ভরের ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি করতে হলে আদি তারাকে বিশাল ভরের হতে হবে। শুধুমাত্র তখনই, ২০১৭ সনে যখন LIGO দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষের ফলাফলে মহাকর্ষ তরঙ্গ মাপতে পারল, যেই সংঘর্ষ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গেও দেখা গেল, তখন LIGOর কৃষ্ণ বিবরের পর্যবেক্ষণকে পুরোপুরি মেনে নেয়া গেল। আর এখন EHT দূরবীনের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের ছায়াকে সরাসরি দেখা গেল। কাজেই কৃষ্ণ বিবরের যে বাস্তব অস্তিত্ব আছে সেটা আজ প্রায় সব বিজ্ঞানীই মানছেন। আমাদের সাধারণ বোধ যেমন প্রকৃতির কোয়ান্টাম কার্যকলাপে বিস্মিত হয়, প্রকৃতির খেয়ালিপনায় সিংগুলারিটি সৃষ্টিতেও চমৎকৃত হয়।
আইনস্টান নিজে খেয়ালিপনায় সেরকম বিশ্বাস করতেন না, যদিও তাঁর অগোছালো চুলের যে ছবিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, তাতে তাঁকে মন-ভোলা খেয়ালী বিজ্ঞানী হিসেবেই আমরা দেখি। কোয়ান্টাম তত্ত্বে ভরসা না রেখে তিনি জীবনের শেষ ২৫টি বছর আপেক্ষিকতা ও তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রতত্ত্বের সংমিশ্রণে পদার্থবিদ্যার চূড়ান্ত নীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। ‘প্রকৃতি জুয়া খেলবে না’ এই জীবন দর্শন তাঁকে এমন এই পথে পরিচালিত করে; তাঁর সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। এই প্রসঙ্গে আমি সত্যেন বসুর কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সত্যেন বসু আইনস্টাইনকে গুরুদেব বলে মানতেন, আমার মনে হয় গুরুদেবের কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে আস্থাহীনতা সত্যেন বসুকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় গবেষণায় অনুৎসাহিত করে। তাই ১৯২৪ সনে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান বিদ্যার জনক হয়েও সত্যেন বসু পরবর্তীকালে আর এই নিয়ে গভীর গবেষণা করেননি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে আমরা একটা স্বাধীন, অনপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া ভাবি, কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত দর্শন ও মতামতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শেষাবধি অবশ্য বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠা পাবে, শুধু তার পথটা বন্ধুর হবে।