পারসেভিয়ারেন্স মঙ্গলে নাসার পাঠানো পঞ্চম রোভার
মঙ্গল অভিযান নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও মঙ্গল গ্রহে মানব বসতি কি এখনই সম্ভব?
পারসিভিয়ারেন্স? পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলে নাসার পাঠানো নতুন মঙ্গলযান। পারসিভিয়ারেন্স পরিভ্রামক যানটি নাসার পাঠানো পঞ্চম রোভার। পারসিভিয়ারেন্স যানটি মঙ্গল গ্রহে পৌঁছাতে প্রায় সাত মাস সময় নেয় এবং এটি ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলের মাটিতে অভিযান শুরু করে।
মঙ্গলে মানুষ প্রেরণের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ২০২০ সালের জুলাইয়ের ৩০ তারিখে লাল গ্রহ মঙ্গলের উদ্দেশ্যে নতুন রোবটযান বা রোভার পাঠিয়েছে নাসা। সবঠিক থাকলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে একটি মঙ্গলের বুকে অবতরণ করবে। প্রতিবারের মতোই এবারের অভিযানটিতেও কিছু অভিনবত্ব আছে।
প্রথমত, মঙ্গলে চাইলেই যে কোনো সময় যে কোনো কিছু পাঠানো যায় না। মঙ্গল ও পৃথিবী উভয়েই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। গতির ভিন্নতার কারণে মঙ্গল কখনো পৃথিবী হতে অনেক দূরে সরে যায় আবার কখনো কখনো পৃথিবীর খুব কাছ ঘেঁষে চলে। পৃথিবী হতে মঙ্গলে সাশ্রয়ে এবং সংক্ষিপ্ততম সময়ে কিছু পাঠাতে হলে তাই পৃথিবী যখন মঙ্গলের কাছাকাছি থাকে তখনই তা পাঠাতে হয়। তাতেও সময় লেগে যায় প্রায় সাত মাস। আর এমন একটি মহেন্দ্রক্ষণ আসে প্রতি ২৬ মাস পর পর। সেই নির্দিষ্ট সময়ে অভিযান না চালানো গেলে আবার ২৬ মাস বসে থাকতে হয়। তবে নাসার কর্মীদের কঠোর পরিশ্রম এবং পেশাদারিত্বের কারণে ব্যক্তিগত নিরপত্তা এবং অন্যান্য সবকিছু যথাযথভাবে নিস্পন্ন করা সম্ভব হওয়ায় মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করা গেছে।
পারসেভিয়ারেন্স মঙ্গলে নাসার পাঠানো পঞ্চম এবং সবচেয়ে উচ্চপ্রযুক্তির রোভার। এটি ছয় চাকা বিশিষ্ট একটি বাহন যাতে মঙ্গলের ভূমির প্রকৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রয়েছে। কাঠামোগত দিক থেকে এটি এর পূর্বতন কিউরিসিটি রোভারের মত এবং এর অবতরণের প্রযুক্তিও কিউরিসিটির অবতরণের মতোই। বিশেষতঃ কিউরিওসিটি রোভারের সময় হতে নাসা Flying crane পদ্ধতিতে মঙ্গলযান ভুমিতে নামাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে রোভারসহ ক্রেনটি মঙ্গলপৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে এলে দড়ির মাধ্যমে ঝুলিয়ে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে দড়ি কেটে দেওয়া হয়। পদ্ধতিটি একটু জটিল হলেও এতে কাঙ্খিত জায়গার কাছাকাছি রোভারটিকে নামানো যায়। ইতিপূর্বে স্পিরিট বা অপারচুনিটিকে নামানো হয়েছিল বায়ুব্যাগ ফুলিয়ে। এই ব্যাগগুলো প্যরাশুট হতে ছেড়ে দেওয়ার পর প্রায় ২০ থেকে ৩০ টি ড্রপ খেয়ে ভুমিতে স্থির হতো। তারপর রোভার বের হয়ে আসত। এতগুলো ড্রপ খেতে খেতে এরা কাঙ্খিত অবতরণ স্থান হতে অনেকটাই সরে যেত।
স্পিরিট ও অপারচুনিটির সাথে কিউরিওসিটি এবং পারসেভিয়ারেন্সের আরেকটি পার্থক্য হলো এগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সোলার প্যানেল দেওয়া হয়নি বরং এতে রয়েছে পারমানবিক ব্যাটারি। ইতিপূর্বে অপারচিউনিটি রোভারের সোলার প্যানেল মঙ্গলের ধূলিঝড়ে ঢেকে গিয়ে ব্যাটারি চার্জ করা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ব্যবস্থা।
তবে কিউরিওসিটির সাথে মিল থাকলেও পারসেভিয়ারেন্সের রয়েছে সম্পূর্ণ অভিনব কিছু অবতরণ বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে একটি হলো Terrain Relative Navigation বা TRN। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে রোভার বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে অবতরণের সময় মঙ্গলের ভুমি স্ক্যান করে কোনো বাধা-বিপত্তি থাকলে সেটি পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে এবং উপযুক্ত সমতল ভুমি খুঁজে বের করে অবতরণ করতে পারবে। ইতিপূর্বের প্রতিটি অবতরণের ঘটনায় এভাবে যথাযথভাবে অবতরণের সুযোগ ছিল না। তাছাড়া পারসেভিয়ারেন্সের রয়েছে রেঞ্জ ট্রিগার নামের একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি। পূর্বতন রোভারগুলো সঠিক স্থানে নামতে না পারায় এগুলোকে অবতরণের পরে লক্ষস্থলে নিয়ে যেতে হতো যাতে সময় লাগত দিনের পর দিন। রেঞ্জ ট্রিগারের মাধ্যমে পারসেভিয়ারেন্সের প্যারাশুটটি যথাযথ সময়েই খুলবে যেন এটি কাঙ্খিত অবতরণ বিন্দুর খুব কাছাকাছি নেমে আসতে পারে।
উদ্দেশ্য ও কর্মকান্ডে পারসেভিয়ারেন্স অন্য যেকোনো রোভারের চেয়ে ভিন্ন। অন্য রোভারগুলো ইতিপূর্বে তাদের অবতরণ এলাকায় নেমেছে, সেই এলাকার ভূমিরূপ, শিলার গঠন, কিংবা মঙ্গলের ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনা যেমন অনুজীবের উপস্থিতির সম্ভাবনা কিংবা পানির প্রবাহ ইত্যাদি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে। তবে পারসেভিয়ারেন্স একই কাজ করবে, পাশাপাশি মানুষের ভবিষ্যৎ মঙ্গলাভিযানের পথ মসৃণ করতে কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাবে। মঙ্গলে মানুষ যদি যেতে হয় এবং সেখানে অবস্থান করতে হয় তাহলে শুরুতেই প্রয়োজন হবে অক্সিজেন এবং তা মঙ্গলের মাটিতেই উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। পারসেভিয়ারেন্স মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাই অক্সাইড হতে অক্সিজেন নিষ্কাশনের একটি নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করে দেখবে। আর মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ৯৬% ই কার্বন-ডাইঅক্সাইড।
পারসেভিয়ারেন্স অবতরণ করবে জেজেরো (Jezero) ক্রেটারে। কয়েকশ’ কোটি বছর আগে একটি উল্কার আঘাতে এটি সৃষ্টি হয়েছিল এবং অতপর এটি পানিপূর্ণ হ্রদে পরিণত হয়। উল্কার আঘাতে যে তাপ উৎপন্ন হয় তাতে মঙ্গলের এই হ্রদে উষ্ণ প্রস্রবণ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই উষ্ণ প্রস্রবণ অঞ্চল প্রাণের বিকাশের জন্য বেশ অনুকুল। পারসেভিয়ারেন্স সেই সম্ভাব্য প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে দেখবে।