ডার্ক ম্যাটার + ডার্ক এনার্জি = মহাবিশ্বের ইন-ইয়াং

.

নিবন্ধ

Astronomy | জ্যোতির্বিজ্ঞান

ডার্ক ম্যাটার + ডার্ক এনার্জি = মহাবিশ্বের ইন-ইয়াং

ডার্ক ম্যাটার কী? ডার্ক ম্যাটার ডার্ক এনার্জি কি একই? ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি আসলে কী সেটা আমরা এখনও জানি না। এরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু! মহাবিশ্ব জুড়ে ডার্ক ম্যাটারের রহস্যময় অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই শনাক্ত করা যাচ্ছেনা।


আমাদের দেখা মহাবিশ্বের বেশিরভাগই আসলে অদেখা রহস্য। যদিও অদেখা বিষয়গুলোকে আমরা স্পর্শ করতে কিংবা দেখতে অক্ষম, তবুও অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই মনে করেন, আমাদের এই বেশিরভাগ অদেখা মহাবিশ্ব আসলে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির সমন্বিত রূপ। তবে এদের ভেতর রয়েছে দিবা-রাত্রির পার্থক্য। আসুন আজ এটাই জানার চেষ্টা করি।
ডার্ক ম্যাটার নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও ডার্ক ম্যাটার কী?

সংক্ষেপে ডার্ক ম্যাটার মূলত একটি আকর্ষণমূলক শক্তি। বাস্তবিক তুলনার মাধ্যমে বিষয়টি খোলোসা করা যাক। একটি ভবনের নির্মাণকাজে যেমন সিমেন্ট ইটগুলোকে একত্রিত রাখে, ঠিক তেমনই ডার্ক ম্যাটার 'কসমিক সিমেন্টের' মতো কাজ করে মহাবিশ্বকে একত্রিত রেখেছে। বলা যেতে পারে, এটি মহাকর্ষের মতোই কাজ করে মহাবিশ্বের নিত্য সম্প্রসারণকে স্তিমিত করে। কিন্তু এটি আলোর সাথে কোনো রূপ মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না। অর্থাৎ প্রতিফলন, প্রতিসরণ কিংবা শোষণ কোনোটাই করে না। অন্যদিকে, ডার্ক এনার্জি হলো সম্পূর্ণটাই বিকর্ষণমূলক। মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে এটি মহাবিশ্বের নিত্য প্রসারণকে আরও বেগবান করে।


বিশ্বতত্ত্বের আধুনিক ল্যামডা-সিডিএম মডেল অনুসারে, মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির শতকরা ৫ শতাংশ হলো দৃশ্যমান সাধারণ ভর ও শক্তি, শতকরা ২৭ শতাংশ হলো ডার্ক ম্যাটার এবং অবশিষ্ট ৬৮ শতাংশ হলো ডার্ক এনার্জি নামে শক্তির একটি অজানা রূপ। শুধু ভরের হিসেবে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের শতকরা ৮৫ শতাংশ হলো ডার্ক ম্যাটার। অন্যদিকে ভর-শক্তির হিসেবে, ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি মিলিতভাবে মোট ভর-শক্তির শতকরা প্রায় ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিষয়টা এমন দাঁড়ালো যে, আমরা নিজের চোখে কিংবা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত যা যা দেখেছি তা কেবল এই ৫ শতাংশেরই অধীন। এবার আমরা ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে আরও একটু বিস্তারিত জানি।


♥ডার্ক ম্যাটার♥


ডার্ক ম্যাটারের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৮৮৪ সালে পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মোট ভর গণনা করতে যেয়ে তাঁর নির্ণেয় ভরের সাথে দৃশ্যমান ভরের একটা অমিল খুঁজে পান। পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে ফরাসি গণিতবিদ হেনরি পয়েনকেয়ার তাঁর লিখিত "দ্য মিল্কিওয়ে এ্যান্ড থিওরি অব গ্যাসেজ" বইয়ে কেলভিনের এ কাজ সম্পর্কে উল্লেখ করতে যেয়ে প্রথম "ডার্ক ম্যাটার" পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। এরপর ১৯২২ সালে ওলন্দাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জে সি ক্যাপটেন নাক্ষত্রিক বেগ ব্যবহার করে প্রথম ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের বিষয়ে প্রকল্প প্রদান করেন। এর ঠিক ১০ বছর পরে আরেক ওলন্দাজ জ্যোতির্বিদ জ্যান ওর্টও একই পথে হাঁটেন। 


এদিকে ১৯৩৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনলোজির (ক্যালটেক) গবেষক সুইস জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটস জুইকি "কমা" নামক ছায়াপথ স্তবকের আগের শনাক্তকৃত হাজারখানেক ছায়াপথের অস্বাভাবিক বেশি মহাকর্ষ প্রভাব আবিষ্কার করেন। তিনি আরও নির্ণয় করেন, ওই পরিমাণ মহাকর্ষ প্রভাব অর্জন করার জন্যে স্তবকটিতে কমপক্ষে আরও ৪০০ গুণ অধিক ভর থাকা আবশ্যক। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় এই ভর দৃশ্যমান ছিলো না। ফলস্বরূপ এই অদৃশ্য ভরকে তিনি "ডার্ক ম্যাটার" বলে সম্বোধন করেন। ডার্ক ম্যাটার বা তমোবস্তু সম্পর্কে বিশদ ও সুস্পষ্ট এ গবেষণার জন্যে জুইকিকে "ডার্ক ম্যাটারের জনক"ও বলা হয়। 


যেটা আগেই বলেছি, ডার্ক ম্যাটার আলো কিংবা তাড়িত-চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে কোনো রূপ মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না। ফলশ্রুতিতে আমরা একে দেখতে পারি না। কিন্তু অদেখা এই ভরের মহাকর্ষ প্রভাবের কারণে, সরাসরি না হলেও আমরা এর অস্তিত্বের ঠিকই আন্দাজ পাই। এটা মনে করা হয়, ডার্ক ম্যাটার দুর্বল মিথস্ক্রিয় ভারী কণিকা সংক্ষেপে "উইম্পস" নামক প্রকল্পিত মৌলিক কণিকা দ্বারা গঠিত। উক্ত কণিকাটি শনাক্ত করতে এখন পর্যন্ত বেশকিছু পরীক্ষা সম্পাদন করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এদের একটিও সফলতার মুখ দেখেনি। মহাকর্ষ প্রভাব জনিত গতিবেগ অনুসারে ডার্ক ম্যাটারকে 'ঠান্ডা', 'উষ্ম' এবং 'গরম' এই তিনভাগে শ্রেণিবিন্যস্ত করা হয়। 


যদিও বিজ্ঞানী মহলে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়, তবুও কিছু কিছু পদার্থবিদদের এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। তাঁরা সাধারণ আপেক্ষিকতার মতো বিদ্যমান কিছু তত্ত্বের সংস্কারের কথা বলেন। যেমন বিশেষায়িত নিউটনিয়ান গতিবিদ্যা, টেন্সর-স্কেলার-ভেক্টর গ্রাভিটি অথবা এনট্রপিক গ্রাভিটি মডেল। এই সংস্কার হওয়া মডেলগুলা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ উইম্পস কণিকাকে অস্বীকার করে।


♥ডার্ক এনার্জি♥


ভৌত বিশ্বতত্ত্ব এবং একইসাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানে, ডার্ক এনার্জি তথা তমোশক্তি হলো শক্তির এমন অজানা রূপ, যা বৃহত্তর কাঠামোতে মহাবিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলে। ১৯৯৮ সালে "টাইপ ওয়ান-এ" নামের একটি সুপারনোভা পরিমাপ করতে যেয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথম এর অস্তিত্বের পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণটি পান। তাঁরা দেখেন, মহাবিশ্ব কোনো ধ্রুবক গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে না। বরং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সম্প্রসারণের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহাবিশ্বের এ বিবর্তনকে বুঝতে জ্যোতির্বিদদের প্রয়োজন ছিলো মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের শুরুদিকের রসায়ন সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, সুপারনোভা পরিমাপের পরীক্ষাটির পূর্বে বিজ্ঞানীদের কাছে সাধারণ পদার্থ, বিকিরণ ও প্রকল্পিত তমোপদার্থ তথা ডার্ক ম্যাটারই ছিলো ভর-শক্তির একমাত্র বৈশ্বিক ধারণা।


মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ/ সিএমবি এর পরিমাপ থেকে বিশ্বতত্ত্ববিদেরা জ্ঞাত হন যে, মহাবিশ্বের সূত্রপাত হয়েছিলো একটি উষ্ণ-বৃহৎ বিস্ফোরণ তথা হঠাৎ মহাসম্প্রসারণ থেকে। এক্ষেত্রে "ডার্ক এনার্জি" নামক শক্তির একটি নতুন রূপের অবতারণা ব্যতীত বিজ্ঞানীদের কাছে নিত্য প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার আর কোনো উপায়ই অবশিষ্ট ছিলো না। ফলশ্রুতিতে ৯০'এর দশক থেকে মহাবিশ্বের ত্বরিত এই সম্প্রসারণ ব্যাখ্যাহেতু ডার্ক এনার্জি সর্বগ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। এমনকি ২০২০ সালে আজও বিজ্ঞানের কিছু সক্রিয় গবেষণার কাজে শক্তির এই রূপের প্রকৃতি নির্ধারণের কাজ চলছে। 


ডার্ক ম্যাটারের মতোই কিংবা আরও বাড়িয়ে বলা যেতে পারে, ডার্ক এনার্জির বৈশিষ্ট্য তথা রাসায়নিক গঠন ডার্ক ম্যাটারের চেয়ে আরও প্রকল্পিত। এটা ধরা হয়ে থাকে, ডার্ক এনার্জি অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের এবং অধিক মাত্রায় সমসত্ত্ব। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সবখানেই এটি বেশ সুষমভাবে ছড়িয়ে আছে। ডার্ক এনার্জির অতিমাত্রায় কম ঘনত্বের (মোটামুটি প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ১০^-২৭ কিলোগ্রাম) কারণে এটি অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য। মহাকর্ষ ছাড়া প্রকৃতির বাকি তিনটি মৌলিক বলের ওপর এর কোনো প্রভাব আদৌও আছে কীনা তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। ডার্ক এনার্জিকে যেহেতু মহা সম্প্রসারণের জন্যে দায়ী করা হয়, সেহেতু এর অবশ্যই একটি নেতিবাচক চাপ থাকার কথা, যা মহাকর্ষ শক্তির বিপরীতে বিকর্ষণমূলকভাবে কাজ করবে। অনেকসময় তাই মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণকে "মহাকর্ষীয় বিকর্ষণ" হিসেবে সম্বোধন করা হয়।


পরিশেষে এটাই বলবো, তাত্ত্বিকভাবে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিকে বলা যেতে পারে "মহাবিশ্বের ইন এবং ইয়াং"। ইন এবং ইয়াং হলো একটি চৈনিক দর্শন যা বোঝায়, দেখতে বিপরীত শক্তিসমূহ আসলে একটি অন্যটির পরিপূরক, সম্বন্ধীয় এবং পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। অদৃশ্য ডার্ক এনার্জি যেখানে বিশ্ব জগতের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে, সেখানে অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটার আমাদের মহাবিশ্বের ভেঙে পড়া আটকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, আমরা এখন পর্যন্ত এদের একটিরও যথাযথ অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারিনি। তবে অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই ডার্কযুগলের রহস্য উন্মোচন করতে পারবো না, এমন তো কোথাও লেখা নেই?!


তথ্যসূত্রঃ

https://www.discovermagazine.com/the-sciences/whats-the-difference-between-dark-matter-and-dark-energy

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Dark_matter

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Dark_energy


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles