মাসে একবার কিন্তু চাঁদ পুরোই উধাও হয়ে যায়, আবার কিছুদিন পরেই পূর্ন চাঁদের আলো ঝরে পড়ে। তার আকৃতি যেন প্রতিদিন বদলে যেতে থাকে।
প্রায় সাড়ে ২৯ দিনের চাঁদের কমা-বাড়া এতই নিয়মিত যে সেটা দিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ক্যালেন্ডারও বানিয়েছে - চাঁদ, পৃথিবী আর সূর্যের কক্ষপথ বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার অনেক আগেই।
কিন্তু... কিন্তু মাঝেমাঝে যে হঠাত করে চাঁদ হারিয়ে যায় আমাদের দৃষ্টি থেকে?
চাঁদ ঢাকা পড়ে এক অদ্ভুত আধারে, যেটাকে আমরা চন্দ্রগ্রহণ বলে জানি।
আর শুধু চাঁদই নয়, মেঘ ছাড়াই আমাদের সূর্যও তো কখনো কখনো ঢাকা পড়ে চায়। দিনের বেলা অদ্ভুত এক অন্ধকার নেমে আসে পৃথিবীজুড়ে! আর একেই আমরা বলি সূর্যগ্রহন।
আমাদের পূর্বপুরুষরা এগুলির ব্যাখ্যা করেছিল বিভিন্ন মিথ দিয়ে, যেমন, কোন দৈত্য গিলে ফেলছে চাঁদকে, অথবা চাঁদ আর সূর্যের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে। এছাড়াও কত ধরনের কুসংস্কার জন্ম নিয়েছে এদের ঘিরে। কিন্তু আজ আমরা জানি কে গিলে ফেলে চাঁদকে, এমনকি মাঝে মাঝে আমাদের সূর্যকেও!
কী ঘটে গ্রহণের সময়? এই যে সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের কথা শুনি, এই যে কয়েকদিন আগেই কয়েকশ বছরের সবচেয়ে বড় চন্দ্রগ্রহণ ঘটে গেল, ঠিক কী ঘটেছিল সেখানে?
চলুন প্রথমেই চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞাটা একটু দেখে নেই।
ছায়া ব্যাপারটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আমরা এও জানি, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই, আমাদের পৃথিবীরও না - আলো আসে সূর্য থেকে।
পৃথিবী যখন সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আর চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থানে চলে আসে, তখন পৃথিবীর ছায়া পড়ে চাঁদের ওপর, সেটাকে আমরা বলি চন্দ্রগ্রহণ।
আর যখন চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আর পৃথিবীর মাঝামাঝি অবস্থান নেয়, তখন সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে পারে না, সেটা হচ্ছে সূর্যগ্রহণ।
ধরা যাক আজকে পূর্ণিমা, এর মানে হল সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ মোটামুটি একটি সরলরেখায় আছে এবং চাঁদের পুরো অংশটাই সূর্যের আলো প্রতিফলন করছে।
এই চাঁদ সূর্য পশ্চিমে ডোবার সময়ে পুবে উদিত হবে। চাঁদ কিন্তু ২৭.৩ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসবে, তাহলে তো ২৭.৩ দিন পরে আর একটি পূর্ণিমা হওয়ার কথা, কিন্তু তা তো হয় না।
কারণ সেই সময়ে পৃথিবী তার কক্ষপথে এগিয়ে গেছে। তাই আবার সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবীকে একটি সরল রেখায় আনতে আমাদের পুরো দুটি দিন অপেক্ষা করতে হবে। চাঁদের তার কক্ষপথে আর একটু এগিয়ে আবার পৃথিবীর পেছনে সূর্যের সঙ্গে একটি সরলরেখায় আসতে অর্থাৎ একটি চান্দ্রীয় মাসের লাগে ২৯.৫ দিন।
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে?
চাঁদ প্রতি সাড়ে ২৯ দিনে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে থাকে, আর পৃথিবী সেই সাড়ে ২৯ দিনে একবার সূর্য আর চাঁদের মধ্যে থাকে, তাহলে প্রতি সাড়ে ২৯ দিনে সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদ এক রেখায় থাকলে তো চন্দগ্রহন হওয়ার কথা। তা কেন হয় না?
কিংবা প্রতি ২৯.৫ দিনে অমাবস্যার সময় চাঁদের ছায়া পৃথিবীর ওপর পড়ে না, অর্থাৎ সূর্যগ্রহণ হয় না?
কেন? রহস্যটা এখানেই।
সূর্যকে পৃথিবী যে সমতলে প্রদক্ষিণ করে, সেটাকে প্লেইন অফ একলিপ্টিক, বা বাংলায় অয়নবৃত্ত বলা হয়। চাঁদ কিন্তু সেই একই সমতলে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। চাঁদের কক্ষপথ সুর্যের চারদিকে পৃথিবীর অয়নবৃত্তের সাথে প্রায় ৫ ডিগ্রি কোণ করে আছে। ফলে যদিও চাঁদ প্রতি সাড়ে ২৯ দিনে দিনে একবার সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে, আর পৃথিবী সেই সাড়ে ২৯ দিনে দিনে একবার সূর্য আর চাঁদের মধ্যে থাকে, এই পাঁচ ডিগ্রি তফাতের জন্য চাঁদ সব সময় সুর্য আর পৃথিবীর সাথে এক সরল রেখায় থাকে না। পৃথিবী থেকে দেখলে চাঁদ কখনো সূর্যের নিচে, কখনো বা উপরে থাকে।
এক পাক ঘুরে আসার সময় চাঁদের কক্ষপথ অয়নবৃত্তকে দুইবার ছেদ করে। এই ছেদবিন্দুগুলিকে বলা হয় লুনার নোড বা চন্দ্রযোগ। আর এই চন্দ্রযোগে চাঁদ থাকার সময় যদি চাঁদ, পৃথিবী আর সূর্য একই রেখায় পড়ে, শুধু তখনি হতে পারে গ্রহণ।
এই ব্যাপারটা, অর্থাৎ এই মহাকাশীয় রেখায় আসা ঘটে বছরে দুবারের মত। তার মানে কি আমরা বছরে অন্তত দুটা গ্রহণ দেখতে পাব? সেটাও কিন্তু নাও হতে পারে।
কেন, সেটা বোঝার আগে চাঁদের কক্ষপথ সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া দরকার। সূর্যের ব্যাস চাঁদের ব্যাসের থেকে প্রায় ৪০০ গুন বড়। কাকতালীয়ভাবে, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের প্রায় ৪০০ গুন। তাই আমাদের চোখে চাঁদ আর সূর্যের আকার প্রায় একই মনে হয়।
চাঁদের কক্ষপথ বৃত্তাকার নয়, এটা উপবৃত্তাকার। এই কক্ষপথের যে বিন্দুতে চাঁদ পৃথিবীর সবচাইতে কাছে থাকে, তাকে বলা হয় পেরিজি বা অনুভূ। আর যখন সবচাইতে দূরে থাকে, তখন সেটাকে বলা হয় অ্যাপোজি বা অপভূ। এই দূরত্বের কম বেশির জন্য আমরা কখনো চাঁদকে বড় বা কখনো ছোট দেখি। এই ছোট-বড় হওয়ার পরিমাণ প্রায় ১৪%।
সূর্যগ্রহন কেমন হবে, সেটার সাথে কিন্তু এই চাঁদের আকারের সম্পর্ক আছে
একই সমতলে না থাকায় চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে না দিয়ে সূর্যের তলের আংশিক নিচ বা উপর দিয়ে যেতে পারে। ফলে তখন একই রেখায় থাকলেও গ্রহণ হয় না।
আর যদি একই সমতলে থাকে?
চাঁদ যদি অপভূতে থাকার ফলে ছোট থাকে, তবে সেটা সূর্যকে পুরোপুরি ঢাকতে পারবে না। ফলে তখন গ্রহণ হলেও আংটির মত সূর্যের রশ্মি দেখা যায়। একে অ্যানুলার সূর্যগ্রহণ বা বাংলায় বলয়গ্রাস বলা হয়।
আর চাঁদ যদি অনুভূতে থাকে, তবে আমাদের কাছে সেটা বড় থাকবে, এবং সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারবে। আর সেটাকেই আমরা বলি পূর্নগ্রহণ ।
তার পরেও কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। সেই গ্রহণ দেখার জন্য আমাদেরকে থাকতে হবে ঠিক জায়গামত। শুধু প্রচ্ছায়াতে থাকলেই সূর্যের পূর্ন গ্রহণ দেখা যাবে। উপচ্ছায়াতে থাকলে দেখা যাবে আংশিক গ্রহণ, তার তার বাইরে থাকলে কোন গ্রহণই দেখা যাবে না। আর এটা ক্ষণস্থায়ী, খুব বেশি হলে সাত মিনিট।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর খুব একটা ছোট সরু রেখায় ভ্রমণ করে, যার প্রস্থ হল ২০০ কিলোমিটারেরও কম,এবং অনেক সময়ই সেটি সমুদ্র বা মেরু অঞ্চলের ওপর দিয়ে যায় তাই বছরে দুবার-তিনবার কোথাও সূর্যগ্রহণ হলেও সেটি খুব কম মানুষই দেখতে পারে।
অন্যদিকে চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়ার আকার বেশ বড় হয় এবং পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময়কাল যেমন বড় হয় আবার পৃথিবীর একটা বড় অংশ পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ দেখারও সুযোগ পায়।
চন্দ্রগ্রহণের প্রক্রিয়াও অনেকটা একই রকম, কিন্তু এখানে ছায়া পড়ে পৃথিবীর। অথবা বলা যেতে পারে পৃথিবী সূর্য এবং চাঁদের মাঝখানে থাকার ফলে চাঁদে সূর্যের আলো পৌছাতে পারে না।
পৃথিবীর যে দিকে রাত, সেখান থেকেই গ্রহণ দেখা যায়, এবং এই গ্রহণ কয়েক ঘন্টা লম্বা হতে পারে। এইতো কিছুদিন আগে হয়ে গেল কয়েক শতাব্দীর দীর্ঘতম গ্রহণ। তবে পূর্ণ গ্রহণের সময়েও সূর্যের আলো কিছুটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতিসারিত হয়ে চাঁদে পড়ে - তাই তখন চাঁদকে লালচে দেখায়; ইংরেজিতে আমরা যেটাকে বলি ব্লাড মুন।
সৌরজগৎ ও জোয়ার-ভাটা নিয়ে আমাদের আগের ভিডিওগুলিতে নিশ্চয় শুনেছেন, চাঁদ প্রথিবী থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এই দূরত্ব যত বাড়বে, চাঁদের ছায়া ও আমাদের চোখে চাঁদের আকার তত ছোট হবে। ধারনা করা হয়, আজ থেকে ১০০ কোটি বছর পরে হয়তো পৃথিবী থেকে কোন গ্রহণই আর দেখা যাবে না।