ঘূর্ণিঝড় | ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ংকর ঘূর্ণন কীভাবে সৃষ্টি হয়? | Cyclone

.

ঘূর্ণিঝড় কিভাবে সৃষ্টি হয়? ঘূর্ণিঝড় বা ঘূর্ণিবাত্যা হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সংবলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়।


প্রকৃতি ফুঁসে উঠছে বারেবারে, ->আঘাত হানছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। pause

ভোলার সাইক্লোন গোর্কি, হারিকেন ক্যাট্রিনা বা টাইফুন হায়ানের মতো মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়গুলোর ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি  আমরা। সাইক্লোন, টাইফুন, হারিকেন যে নামেই ডাকেন না কেন এই ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড়। 


কিন্তু কেন এভাবে ক্ষেপে ওঠে আমাদের সমুদ্র-মহাসমুদ্রগুলো? কিভাবে, ->কেন সৃষ্টি হয় এই ঘূর্ণিঝড়? বা তাদের এই সর্বনাশা ঘূর্ণন? 


আজকে এই ভিডিওতে আমরা থিংকের বন্ধু, ডিসাস্টার মেনেজমেন্টের এসোসিয়েট প্রফেসর ডঃ তানভীর ইসলামের সাথে জানব এই প্রশ্নগুলোর উত্তর।


ঘূর্ণিঝড় হলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলগুলোতে, মানে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মাঝখানের যে অঞ্চলটা সেখানে  নিম্নচাপের ফলে তৈরি সামুদ্রিক ঝড় -  যাদেরকে আবার ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বা ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ও বলা হয়। সাধারণত গরমকালে বা গরমের শেষে উষ্ণ পানিতে সৃষ্টি হয় বায়ুমন্ডলের এই উত্তাল অবস্থার।  


আপনি হয়তো ভাবছেন এরা সবাই যদি একই ঘূর্ণিঝড় হয় তাহলে এদের এতগুলো নাম কেন?  কারণ, -> 

উৎপত্তিগতভাবে এরা সব্বাই একইরকমের হলেও পৃথিবীর একেক অঞ্চলের মানুষ  এদেরকে  একেক নামে ডাকে। আমাদের  ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এদের নাম সাইক্লোন। ইংরেজ জাহাজি হেনরি পিডিংটন গ্রিক শব্দ ‘kyklos’ , যার মানে হচ্ছে - 'সাপের কুণ্ডলী' ->শব্দটির সাথে মিল রেখে সাইক্লোন নামটি রাখেন। আবার আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকার ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় হারিকেন -  আদিবাসী মায়াদের ঝড়বৃষ্টির দেবতা ‘হুরাকানের’ নাম থেকে।  অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বলা হয় ‘টাইফুন’। চৈনিক ভাষায় এর কাছাকাছি শব্দ হলো taaifung বা tai feng -  ‘শক্তিশালী বায়ু’।  আমরা যে 'তুফান' বলি সেটাও  এসেছে আরবদের থেকে - তারা পেয়েছিল গ্রিক মিথলজির বায়ুদৈত্য tuphon থেকে।


ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল অনুযায়ী এই ক্রান্তীয় সমুদ্র অঞ্চলকে   সাতটি বেসিনে ভাগ করা হয়।  


প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে গড়ে প্রায় ৮০টি  ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলেও তাদের বেশিরভাগই মিলিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে। তাদের  মধ্যে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে এসে যারা আঘাত করে তাদের কথাই মূলত শুনতে পাই।  


বাতাসের গতি বেগের উপর  নির্ভর করে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উত্তর আটলান্টিক এলাকায় হারিকেনের শক্তিমাত্রা অনুযায়ী এগুলোকে ক্যাটাগরি-১, ক্যাটাগরি-২—এভাবে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত ক্যাটাগরি-৩ বা তার ঊর্ধ্বমাত্রার হারিকেনকে (বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ মাইলের বেশি) খুবই শক্তিশালী গণ্য করা হয়। প্রকৌশলী হার্বাট সাফির ও বিজ্ঞানী রবার্ট সিম্পসন যৌথভাবে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিমত্তা নির্ণয়ের এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন বলে এর নাম ‘সাফির-সিম্পসন স্কেল’। 


সে না  হয় গেল এদের নাম, ঠিকানা, মাত্রার ঠিকুজি,  চলুন এবার দেখা যাক,  এই ভয়ংকরী  ঘূর্ণিঝড়গুলো সৃষ্টি হয় কিভাবে, কেন? 


 পৃথিবীর মহাসমুদ্রগুলো, গরমকালে সূর্যের প্রখর তাপ শুষে নিয়ে উত্তপ্ত হতে শুরু করে। সমুদ্রের এই উষ্ণ পানি থেকে বের হওয়া তাপকেই  ঘূর্ণিঝড়ের ইঞ্জিন বা শক্তির অন্যতম মূল উৎস বলা যায়। ->এবার এর সাথে জুড়ে দিন বাতাস  - ব্যাস,  প্রকান্ড ঘূর্ণিঝড় তৈরির মূল উপাদানগুলো  রেডি।  

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বা ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের  বেশি হতে হয়।  


তখন সমুদ্রের এই উত্তপ্ত পানি থেকে বাস্পীভবন শুরু হয় -  ->প্রচুর জলীয় বাষ্প উপরে উঠে ঠান্ডা হতে শুরু করে-   তৈরি করে মেঘ - যা আবার বৃষ্টি ও বাতাস হিসেবে শক্তি নির্গত করে। 


এদিকে আবার উষ্ণ বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যাওয়ার ফলে ওই জায়গায় ফাঁকা হয়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। 

আর তাতে করে কী হয়? 

আশেপাশের সব অপেক্ষাকৃত  উচ্চচাপের এলাকা থেকে  বাতাস এবং মেঘগুলো সাগরের উপরের  এই নিম্নচাপ এলাকার দিকে ছুটে আসতে শুরু করে।

 

পৃথিবীর ঘোরা নিয়ে থিংকের ভিডিওতে দেখেছিলাম আমাদের পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর কীভাবে ঘুরছে আর সেই ঘূর্ণনের কারণেই,  চারদিকের এই ধেয়ে আসতে থাকা বাতাস  সোজাসুজি না এসে কিছুটা বেঁকে যায়।

এখন বিভিন্ন দিক  থেকে আসা বাতাস,   এই নিম্নচাপের চারপাশে  বেঁকে যেতে থাকলে,  কী হয় দেখুন - সৃষ্টি হয় প্রচন্ড ঘূর্ণনের। 


একে বলে  কোরিওলিস প্রভাব (Coriolis effect) - এর ফলেই  উত্তর গোলার্ধে বাতাস ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। তাই উত্তর গোলার্ধে ঘূর্ণিঝড়গুলো ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে (anti-clockwise) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে (clockwise) ঘোরে। 


চারদিকের বাতাসে যত মেঘ, যত আর্দ্রতা আছে সব এসে, পড়িমরি করে জড়ো হতে শুরু করে আর তৈরি হতে থাকে ভয়ংকর এক ঝড় -  ঘূর্ণিঝড়। পানির তাপমাত্রা যত বেশি হয় এবং এই নিম্নচাপ এলাকায়  চাপ যত কম থাকে ততই সম্ভাবনা বাড়তে থাকে আরো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির। 

বিষুবরেখার কাছে পৃথিবীর ঘূর্ণন বা কোরিওলিসের প্রভাব অতি সামান্য, তাই ঘূর্ণিঝড়গুলো সাধারণত সৃষ্টি হয়, নিরক্ষরেখা থেকে কিছুটা দূরে দুইপাশে ১০ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি ক্রান্তীয়রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ।


ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে যে বৃত্তাকার বলয়টি আমরা দেখি, তার নাম চোখ বা eye এবং তার চারপাশে যে খুব শক্তিশালী বাতাসের বলয় তাকে বলা হয় 'আই-ওয়াল'। আপনি হয়তো ভাবছেন,  এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে কী না জানি ভয়ংকর অবস্থা থাকে-   কিন্তু মজার ব্যাপার হলো,  ->এটা ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে শান্ত অংশ,  যেখানে কোনো ঝড়ঝঞ্ঝার চিহ্নই থাকে না। ঘূর্ণিঝড়ের গবেষকদের মাঝে মাঝে প্লেন নিয়ে এই চোখের ভেতরে ঢুকে যেতেও দেখা যায়। 

তবে এই চোখ উপকূলের যে অংশ দিয়ে অতিক্রম করে, হ্যাপা পোহাতে হয় তাদেরই সবচেয়ে বেশি। কারণ, সে এলাকাকে দু'বার করে শক্তিশালী বাতাসের দেয়াল বা আই-ওয়ালের মুখোমুখি হতে হয়। 


আই-ওয়াল বলয়ের পাশে সর্পিলাকার বিশাল যে কুণ্ডলী থাকে, সেগুলোকে বলে রেইনব্যান্ডস বা বৃষ্টির কুণ্ডলী। আকারে বিশাল হলেও এই আই-ওয়ালের বাইরের অংশে রেইনব্যান্ডস যত বড়ই হোক না কেন, সেখানে বৃষ্টি ছাড়া আর তেমন কিছু হয় না, বাতাসের গতিবেগও অপেক্ষাকৃত কম থাকে। তবে অনেক সময় স্থলভাগে কিছু টর্নেডো সৃষ্টি  হওয়ার আশঙ্কা থাকে।


আমরা প্রায়ই,  বঙ্গোপসাগরে বিধ্বংসী সাইক্লোনের কথা শুনি। তবে  সংখ্যায় এবং মাত্রায় তারা সাধারণত আটলান্টিক বেসিনের হারিকেন বা প্যাসিফিক বেসিনের টাইফুনগুলোর চেয়ে কিছুটা দুর্বল। কিন্তু  আবার  আমাদের  সমুদ্রতীরের আকৃতি ফানেল বা চোঙ-এর মতো হওয়ায় প্রায়ই বঙ্গোপসাগরের তৈরি ঘূর্ণিঝড়গুলোর  শিকার হয় বাংলাদেশ এবং ভারতের উপকূল। তার উপরে আবার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং  দুর্বল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কারণে এখানে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি। অগভীর মহীসোপানের কারণে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা অপেক্ষাকৃত বেশি  হয় এবং নীচু মানের উপকরণে তৈরি  দুর্বল বাড়িঘরের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হয়  ব্যাপক।  

যেমন ধরুন ১৯৭০ এর ভোলা সাইক্লোনে আধুনিক সমরের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক  মানে  প্রায় ৩ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। অথচ,  এটা ছিল ক্যাটেগরি ৩ বা ৪ মাত্রার সাইক্লোন, তারই কিছুদিন আগে  ১৯৬৯ সালে আমেরিকায় বিধ্বংসী ক্যাটাগরি ৫(পাঁচ)  হারিকেন ক্যামিলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও মারা যায় মাত্র  ২৫৯ জন । জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি ভোলা সাইক্লোনে এত বেশি লোক মারা যাওয়ার কারণ সে সময়ের  পাকিস্তান সরকারের ঝড়ের কোন পূর্বাভাস না দেওয়া এবং উপকূলবাসী মানুষের জীবন রক্ষার জন্য ব্যবস্থা না নেওয়া। দূর্বল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কারণেই ১৯৯১ সালে সাইক্লোন গোর্কিতেও প্রায় এক লাখ ৩০ হাজারের মত মানুষ মারা যায়। 

তবে আশার কথা হচ্ছে, এখন বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আমরা ঘূর্নিঝড় সৃষ্টির পিছনের কারণগুলো আগের চেয়ে ভালোভাবে বুঝতে শিখছি।  মহাশূন্য গবেষণার অগ্রগতির ফলে আবহাওয়া উপগ্রহগুলির সাহায্যে মডেল তৈরি এবং পূর্বাভাসও পাওয়া যায়।  যে কারণে, আজকাল যথাসময়ে,  উপকূলবর্তী মানুষদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা সম্ভব হচ্ছে - এর ফলে প্রাণহানির সংখ্যাও কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে, যা আমরা সাইক্লোন সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯) বা সাম্প্রতিক আম্পানের  (২০২০) ক্ষেত্রে দেখেছি। 


ভবিষ্যতে  বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এই ঘূর্ণিঝড়গুলো কীভাবে দিনে দিনে আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠছে সে নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রইলো আরেকটি থিংকের  ভিডিওতে। 

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles

ঘূর্ণিঝড় হল ক্রান্তীয় সমুদ্র অঞ্চলে সৃষ্ট প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি রুপ, যেখানে বৃষ্টি, বজ্র এবং প্রচন্ড গতিতে বয়ে চলা বাতাসের একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া।