জলবায়ু পরিবর্তন: কার্বন ডাই-অক্সাইডের অপসারণ

.

নিবন্ধ

পরিবেশ ও প্রকৃতি | Environment

জলবায়ু পরিবর্তন: কার্বন ডাই-অক্সাইডের অপসারণ

কার্বন ডাই-অক্সাইডের অপসারণ, নিঃস্বরণ এবং সংরক্ষণ করা হয় কীভাবে? কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে কি বিছানার গদি, খাবারের পাত্র কিংবা কাটলারিতে রূপ দেয়া সম্ভব? কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ, যা কিনা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমরা কতোটা দায়ী?


ইন্টারগভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (IPCC) অনুসারে, ১৮৫০ সালে শিল্প বিল্পবের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই গতিতে চলতে থাকলে একবিংশ শতাব্দীর শেষ হওয়া নাগাদ আমাদের গ্রহের তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে।  

বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো আমাদের বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকা উপস্থিতি। এটি এমন একটি গ্যাস, যা পৃথিবীর ভূখন্ড থেকে বিকিরিত উষ্ণতাকে মহাকাশে ছড়িয়ে দিতে বাধা প্রদান করে বায়ুমন্ডলে আটকে রাখে এবং ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে। কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া-ই বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউজ প্রভাব নামে পরিচিত। মূলত আমাদের কারণেই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের আধিক্য হচ্ছে বায়ুমন্ডলে। আমরা যা কিছুই করি, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকে খনিজ হাইড্রো-কার্বন জ্বালানির দহন অর্থাৎ খনিজ তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি পুড়িয়ে জ্বালানির চাহিদা মেটানো। এসব উৎস থেকে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বায়ুমন্ডলে দ্রুত গতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছি, যা জলবায়ু পরিবর্তন করছে। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো যেমন বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি খুব দ্রুতই দেখা যাচ্ছে। 



১৮৫০ সালে আমাদের বায়ুমন্ডলে এই গ্যাসের অণু ছিলো প্রতি লিটারে ২৮৮ মিলিগ্রাম (২৮৮ পিপিএম); ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত এই গ্যাস প্রতি লিটারে ৪১৭ মিলিগ্রাম (৪১৭ পিপিএম)। এই বৃদ্ধি যে কতোটা ভয়াবহ তা বুঝা যায়, গত ২০ হাজার বছরের তথ্য পর্যবেক্ষণ করলে। কেননা আমাদের এই শিল্প বিপ্লবের পূর্বে প্রাকৃতিকভাবে বায়ুমন্ডল কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের বৃদ্ধি হয়েছে ১৮৫ পিপিএম থেকে ২৮০ পিপিএম তথা মাত্র ৯৫ পিপিএম, যেখানে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আজ পর্যন্ত বেড়েছে ১২৯ পিপিএম। অর্থাৎ হাল কালের এই ১৭১ বছর ব্যবধানে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস আমাদের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করেছে তা বিগত ২০ হাজার বছরের বৃদ্ধিকেও হার মানিয়েছে।



কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের এই ভীতিকর বৃদ্ধি রোধে জ্বালানি হিসেবে হাইড্রো-কার্বন তথা অনবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ব্যবহার কমিয়ে জ্বালানি উৎসের বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য উৎসের ব্যবহার বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। এখানে ইন্টারগভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (IPCC) অনুসারে, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস কমিয়ে আনার ৫ টি উপায় উল্লেখ করা হলো:


১. বনায়ন বৃদ্ধি: গাছ প্রাকৃতিকভাবেই পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস করে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর বিভিন্ন বনাঞ্চল বায়ুমন্ডলে থাকা প্রায় ১ বিলিয়ন টন থেকে ২ বিলিয়ন টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস কমিয়ে ফেলে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন কমাতে পরিবেশ বাঁচাতে বৃক্ষ রোপণ শুধুই নয়, নিত্য নতুন বনভূমিও সৃষ্টি করতে হবে। 


২. মাটিতে হিউমাস বৃদ্ধিকরণ: মাটির হিউমাস প্রচুর পরিমাণ কার্বন সঞ্চয় করে রাখতে পারে। এই কার্বন হলো পোড়ালেই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের সৃষ্টি হয়। মাটিতে হিউমাস বাড়াতে গেলে আমাদের দ্রুত ফলনশীল চাষাবাদে জোর দিতে হবে। এছাড়া মাটির অনেক গভীরে মূল যায় এমন ফসল উৎপাদন করতে হবে; গভীর হলকর্ষণ হ্রাস করতে হবে এবং কৃষিকাজে অবশিষ্টাংশ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। 


৩. বায়োচার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা: বায়োচার মূলত জৈব সারের মতোই কাজ করে। এটি শূন্য অথবা খুবই কম অক্সিজেন সম্পন্ন একটি পরিবেশে কোনো জৈব উপাদানকে তাপ-চাপ দিয়ে তৈরি করা হয়৷ এই বায়োচারকে আবাদযোগ্য জমিতে ছড়িয়ে দিলে মাটিতে কার্বন উপদান বৃদ্ধি পায়। জার্মান একটি গবেষণা সংস্থা (SWP) এর তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী এই বায়োচার প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রতি বছর ০.৫ টন থেকে ২ বিলিয়ন টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমাতে পারে। 


৪. মাটির গভীরে কার্বন ডাই-অক্সাইড সঞ্চয়: যদিও এই প্রযুক্তিতে আরও গবেষণা করতে হবে, তবুও ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এটি হতে পারে একটি উল্লেখযোগ্য চাবিকাঠি। বর্তমানে এই প্রযুক্তি নরওয়ের তেল ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড কমানোর এই উপায়ে প্রতি টন গ্যাস সরাতে খরচ বর্তমানে ৬৫০ ডলার, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যদিও ২০৫০ সাল নাগাদ এই খরচ কমিয়ে প্রতি টনে ৬০ ডলারে কমিয়ে আনা হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। 


৫. পাথরের ব্যবহার: শুনতে একটু অদ্ভুত শোনালেও এই পদ্ধতিতে কেবল কার্বোনেট আর সিলিকেট সমৃদ্ধ পাথর খুঁড়ে, তা টুকরো করে আবাদ জমিতে এবং সমুদ্র উপকূলে ছড়িয়ে দিতে হবে। বেশকিছু বছরের ব্যবধানে এই পাথরগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিবে। গবেষকদের মতে, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রতি বছর এই পদ্ধতিতে প্রায় ২-৪ টন পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব।



তথ্যসূত্র: ১. Ineke Mules. DW. How can we remove CO2 from the atmosphere? ২. Global Climate Change. NASA. Carbon Dioxide ৩. Livia Albeck-Ripka, Henry Fountain and Lisa Friedman. Can We Really Scrub Carbon Dioxide From the Atmosphere? The New York Times.


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles

কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে সেটাকে শিলায় রূপান্তরিক করে মাটির নিচে চাপা দেওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে আইসল্যান্ডে।