হিমালয় কিভাবে বদলে দিল পৃথিবী? | How India Crashed into Asia and Changed the World | Think Bangla

.

আচ্ছা, ব্রেক ফেল করা একটা গাড়ির মতো অপ্রতিরোধ্য ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট যদি, জগদ্দল ইউরেশিয়ান প্লেটে জোরে ধাক্কা মারে, তাহলে কী ঘটতে পারে বলেন তো? ছোটোখাটো কোন ঘটনা হলেতো কথাই ছিলো না, কিন্তু এর ফলে ঘটে গেছে মহা প্রলয়, চিরতরে বদলে গেছে আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর বুক চিরে উঠে এসেছে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। সেই সংঘর্ষের কারনেই আজো ঘটে চলেছে নেপালের সেই ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মত ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা। প্লেট টেকটনিকসের কারণেই ভারত মহাদেশীয় পাতটা সেইইইই দক্ষিণ মেরুর কাছ থেকে, মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে এসে, ৫ কোটি বছর আগে, ইউরেশীয়  পাতের সাথে ধাক্কা খেতে শুরু করে। আর কোটি কোটি বছর ধরে সেই দুনিয়া কাঁপানো সংঘর্ষে দেড় হাজার মাইল জুড়ে গজিয়ে উঠছে হিমালয় পর্বতমালা। 


এই হিমালয় শুধু অচিন্তনীয় রকমের বিশালই নয়, সে কিন্তু অপরূপ সুন্দরও। ও হ্যাঁ আমরা যখন ‘প্লেট টেকটনিকস’ বলি, তখন আমরা, সেই বহুল প্রমাণিত পাত সঞ্চালনের ভূতাত্ত্বিক তত্ত্বটার কথাই বলি। আমরা জানি পৃথিবীর ওপরের ঠাণ্ডা কঠিন অংশ বা ভূপৃষ্ঠ বেশ কটা দুর্দান্তরকমের বড়সড় পাত বা প্লেট দিয়ে তৈরি, তার ওপর আবার গ্যাঁট হয়ে বসে আছে আমাদের আজকের দেখা মহাদেশগুলো। আর এই সবকটা মহাদেশই কিন্তু সরছে অনবরত চলছে। আমাদের থিংক এর বন্ধু, ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নাইজেল হিউজ তাঁর পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন এই ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে গবেষণা করে। তাঁর সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই তৈরি আমাদের আজকের ভিডিও। 


৫৫ কোটি বছর আগে অনেকগুলো মহাদেশ মিলে তৈরি হয় গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামের অতিমহাদেশ। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এন্টার্কটিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার মত ভারতীয় টেক্টনিক প্লেটও এই অতিমহাদেশের ভেতরেই ছিল। এরপরে আবার একসময় ইউরোমেরিকা মহাদেশও এসে জুড়ে গেলো এই  গন্ডোয়ানাল্যান্ডের সাথে - আর তার ফলে এই দুয়ে মিলে, মানে পৃথিবীর প্রায় সবটা মাটি মিলে, তৈরি হলো আরো অনেএএএএক বড় একটা অতিমহাদেশ - প্যানজিয়া।


প্লেট টেকটনিকসের কারণেই আবার একসময় তারা ভাঙতে শুরু করে ১৮ কোটি বছর আগে ভারত মহাদশীয় প্লেটটাও ভাঙতে শুরু করে গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে। আর সেখান থেকেই শুরু ভারতীয় প্লেটের সেই উত্তরমূখী মহাযাত্রা কী গতিতেই না সে পাড়ি দিয়েছিল মহাসাগর! ৭ কোটি বছরে সে পেরিয়েছে নয় হাজার কিলোমিটার!! খুব বেশি মনে হচ্ছে না তাই না? ছুটে আসার এই  গতিটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ভূতাত্ত্বিক স্কেলে চিন্তা করতে হবে। মহাদেশীয় প্লেটগুলো সাধারণত বছরে সরে পাঁচ সেন্টিমিটারের মত। আর সেখানে ভারত ছুটেছে প্রায় চারগুণ বেশি বেগে, সে বছরে এগিয়েছে প্রায় কুড়ি সেন্টিমিটার। আমরা তো জানিই, আপনি যত জোরে এবং গতিতে ধাক্কা দেবেন তার প্রতিক্রিয়াটাও হবে ততই বেশি। আর সে কারণেই এই দুই প্লেটের মহা-সংঘর্ষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা আর অন্নপূর্ণার মত বিশাল সব পর্বতগুলোর। 


ভারতীয় প্লেট লক্ষ কোটি বছর ধরে ভেসে এসেছে, নুহের জাহাজের মতই সে অজস্র জীবন্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ বুকে নিয়ে এই পথ পাড়ি দিয়েছে। তারা নানান পরিবেশ, নানান আবহাওয়ায় বদলেছে, টিকে থেকেছে, আবার কেউ কেউ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং তারই ফলে উৎপত্তি ঘটেছে বিচিত্র সব জীবের। জানেন, এখানেই বিবর্তন ঘটেছে তিমির, হ্যাঁ পৃথিবীর সেই সবচাইতে বড় প্রাণী তিমির কথাই বলছি আমি। ফাটাফাটি এক বিবর্তন ঘটেছিল ভারত, এশিয়ার কাছে ঘেঁষে আসতে শুরু করে এর ডাঙায় ঘুরে-বেড়ানো অনেকটা হরিণের মতন দেখতে প্রাণী থেকেই, বিবর্তিত হয় আজকের এই জলজ স্তন্যপায়ী আধুনিক তিমি।সেই বিশাল টক্করটা যখন লেগেই গেল ওই দুটো পাতে, ভারতের পিঠে যত গাছপালা, প্রাণী ছিল তারা  ইউরেশিয়ার জীবিত বিভিন্ন প্রজাতির সাথে মিলেমিশে যেতে শুরু করলো। প্রফেসর হিউজের মতে প্রাকৃতিক পরিবেশের এই ধরণের বিচিত্র মিশ্রণ এবং পরিবর্তন প্রাণ জগতে যেন অপূর্ব এক উদ্ভাবনের সুযোগ করে দিয়েছিল আর একেই আমরা বলি বিবর্তন|


তবে এই সংঘর্ষে গাছপালা, প্রাণী এবং জমিজমাই শুধু কিন্তু বদলায়নি; স্থানীয় এবং বৈশ্বিক মানে সারাবিশ্বের জলবায় পর্যন্ত বদলে দিয়েছে সে। আমাদের দেশে যে  মহাবর্ষা বা মনসুন হয় প্রতি বছর, তার শুরুও কিন্তু এই হিমালয় আর তিব্বতি উপত্যকা থেকেই। এই পুরো জায়গাটাই এত উঁচুতে যে ওটা একটা বিরাট ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত করে প্রেসার সিস্টেম তৈরি করে এবং, ভারত মহাসাগর থেকে, আর্দ্র বাতাস টেনে নেয় ->  তাতে করে মেঘ জমে। কিন্তু সেই মেঘ তো আর হিমালয় ডিঙাতে পারে না। উঁচু সেই পর্বতে আটকে যায় তারা আর সারা উপমহাদেশ জুড়ে নেমে আসে তুমুল বর্ষার তোলপাড়। সিন্ধু, গঙ্গা, ইয়াংজি আর ব্রহ্মপুত্রের মত মহানদনদীগুলোর জন্ম কিন্তু এই হিমালয়ের গর্ভেই - পৃথিবীর প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষের পানি যোগায় এরা। এই বিপুল জলপ্রবাহে অনবরত ক্ষয় হতে থাকে হিমালয় ... তো গত প্রায় আড়াই কোটি বছর ধরে নদীর স্রোতে ভেসে-আসা এই তলানিগুলো জমে জমে বিশ কিলোমিটারেরও বেশি উঁচু হয়েছে। আর বলুন তো সেখান থেকে কী সৃষ্টি হয়েছে? 


হ্যাঁ, সেই ক্ষয়ে-আসা হিমালয় থেকেই গড়ে উঠেছে আমাদের সমগ্র বঙ্গীয় বদ্বীপ। এই সংঘর্ষ থেকে আরও একটা বিশাল বড় কাজ হয়েছে। এই সংঘর্ষের আগে, পৃথিবী ছিল উত্তপ্ত, একটা গ্রিনহাউজের মত- উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে কোনো বরফের অস্তিত্বই ছিল না তখন। 


আর হিমালয় যখন মাথা তুলে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা কমা শুরু করে দিল, শুরু হল শেষ বরফযুগ। কিভাবে জানেন? বাতাসের যে কার্বন ডাই অক্সাইড সূর্যের তাপ আটকে রেখে পৃথিবীকে গরম রাখে, এই বিশাল পর্বতমালার সিলিকেটগুলো আবহাওয়া থেকে সেই কার্বন ডাই অক্সাইডকে শুষে নেয় আর সেই থেকেই পৃথিবীর আস্তে আস্তে পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। আমাদের ভারতীয় প্লেটের গপ্পো কিন্তু এখনো শেষ হয়নি, সে এখনো ধীর গতিতে ধাক্কা দিয়ে চলেছে ইউরেশিয় পাতটাকে, আর হ্যাঁ সে কারণেই হিমালয় এখনো ক্রমশ বড় হচ্ছে, আরও উঁচু হচ্ছে। আর এই ভয়ানক ঘর্ষণ থেকেই নেপাল আর আশপাশের দেশগুলোয় হচ্ছে বড় বড় সব ভূমিকম্প।


আমরা এখনো হিমালয়ের সব রহস্য কিন্তু বুঝে উঠতে পারিনি, এখনো বোঝার চেষ্টা করছি কিভাবে সে, আমাদের গ্রহটাকে পাল্টে দিয়েছিল চিরতরে। তবে এ নিয়ে কোন সন্দেহই নেই যে, এই মহাসংঘর্ষটা আমাদের গ্রহের ইতিহাসে অন্যতম এক বড় ঘটনা।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles