২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি গান তুমুল হৈ চৈ সৃষ্টি করে আমেরিকা এবং ইউরোপে। গানের নাম ‘বোডাক ইয়োলো’ আর শিল্পীর নাম কার্ডি বি। এই মার্কিন র্যাপার রাতারাতি খ্যাতির শিখরে উঠে যান এই গানটি গেয়ে। গানের কথায় ছিলো নারী, ক্ষমতা আর যৌনতার মাহাত্ম্য, কোরাসে ছিলো ফ্রেঞ্চ ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান লুবৌটিনের বানানো, দামী লাল হাই-হিলের গুণগান। শুধু কার্ডি বি কেন, লাল গালিচার উপর নায়িকা, মডেল থেকে শুরু করে, বহু পেশাদার মেয়েকেই দেখা যায় হাই হিল পরতে। আজকে এই হাই হিল জুতো নারীত্ব, যৌনতা, আভিজাত্য, শহুরেপনা, ফ্যাশন এমনকি, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আপনি কী জানেন, কয়েকশ বছর আগেই এই হাই হিল ছিল পুরুষের জুতো?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এই হাই হিলের যাত্রা শুরু ছেলেদের পায়ে। তাও হয়তো ফ্যাশন হিসেবে নয়, নিতান্ত প্রয়োজন থেকে। সেই প্রাচীন কালে মিশরের কসাইরা নাকি উঁচু জুতা পরতো, পায়ে যেন রক্ত না লাগে, সেজন্যে।তারপর হাই হিল জুতার গায়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগে মধ্য এশিয়ার বর্তমানের ইরান বা পারস্য সাম্রাজ্যে। ঘোড়ায় বসে সৈন্যরা যেন রেকাবে পা দুটো ঠিকমতো ঝুলিয়ে রাখতে পারে, তাই তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এক ধরনের উঁচু জুতো। এই জুতাগুলো শুধু পায়ে আরামই দিত না, বরং অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়েও দাঁড়িয়েছিল। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিলো, আপনার পায়ে ওই উঁচু জুতোটি থাকা মানে আপনি একজন ঘোড়ার মালিক, এমনকি শক্তিশালী যোদ্ধাও বটে। কার সাহস হবে আপনার সাথে উঁচু গলায় কথা বলে!
পনেরো শতকের শেষ দিকে পারস্যসম্রাট আব্বাস তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অটোমান সম্রাটকে হারানোর জন্য সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠান পশ্চিম ইউরোপে। ধারণা করা হয়, তাদের পায়ে ছিল এই উঁচু হিলের জুতা। ষোলো শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ছেলেরাই হিল জুতা পরতো, যদিও শোনা যায় রানী প্রথম এলিজাবেথের জামাকাপড়ের সাথে একজোড়া হিলওয়ালা জুতো পাওয়া গেছে। আর ওদিকে প্রাচীন রোম ও গ্রিক সাম্রাজ্যের মঞ্চ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং মধ্যযুগে ভেনিসের যৌনকর্মীদের মধ্যেও নাকি ছিল এই হিলজুতো পরার প্রচলন।
তবে এই হিলের জুতাকে প্রথম সিংহাসনে চড়ালেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই। দৈহিক উচ্চতা নিয়ে মনে অনেক দুঃখ ছিল রাজা বাহাদুরের। একটু লম্বা হওয়ার আশায় নিজের ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার সাথে যোগ করলেন আরো ৪ ইঞ্চি উঁচু জুতা, যার তলায় ছিলো লাল টুকটুকে কাঠের গোড়ালি। এরপর সবাই রাজার মত উঁচু জুতা পরতে চাইলো, কিন্তু রাজা তো সবাইকে তাঁর কাতারে আসতে দেবেন না। তাই তিনি শুধু রাজদরবারের অভিজাতদের এই হিল পরার অনুমতি দিলেন। কিন্তু সেই হিল কোনভাবেই রাজামশাইয়ের হিলের চেয়ে উঁচু হতে পারবে না, উঁচু হলেই গুনতে হতো জরিমানা।
১৬ শতকের শুরুতে ইউরোপে লাগে নতুন হওয়া। এনলাইটেনমেন্ট যুগের পুরুষেরা তখন যুক্তি আর বাস্তবতা নিয়ে মহাচিন্তিত। বিলাসিতা এবং ফ্যাশনের পরিবর্তে তারা সবকিছুতে ব্যবহারিক সুবিধার দিকটায় প্রাধান্য দিতে শুরু করলো। গয়নাগাটি পরা বাদ দিলো, কাপড়চোপড় থেকে অনর্থক বাহাদুরি ছেঁটে ফেললো, সেই সাথে তাদের হাই হিল পরাও বাদ পড়ল।আর এসময়ের দিকেই নারীরা এই হাই হিল লুফে নিলো তখনকার ফ্যাশন এবং আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। ফ্যাশনের এই অদলবদল ঘটে সে সময়ে যখন ভাবা হতো মেয়েরা খুব ভাবপ্রবণ, আবেগী ও বোকা, আর পুরুষেরা কর্মদক্ষ, বুদ্ধিমান, এবং যৌক্তিকতার সার্থক প্রতিনিধি।
এর পরে হাই হিলের ফ্যাশন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু বিশ শতকের মাঝামাঝি পশ্চিমা মুভির সাথে সে আবার ফিরে আসে নতুন উদ্যমে, নতুন মোডকে, ম্যারিলিন মনরোর মতো বিলাসী অভিনেত্রীদের আবশ্যকীয় ফ্যাশনসঙ্গী হয়ে যিনি বলেছিলেন, "আমি জানি না কে হাই হিল আবিষ্কার করেছিলেন, তবে তাঁর কাছে মেয়েদের ঋণ অনেক।"হাই হিল কোথা থেকে এসেছে সেটা যেমন আমরা এখন জানি, আবার মেয়েরা এর কাছে ঠিক কয় পয়সা "ঋণী" , সেটা হিসাব করাও খুব কঠিন নয়।
যে-জুতোটা তৈরি হয়েছিল ঘোড়সওয়ারি বা কসাইদের প্রয়োজনে, সেটাই এখন কালের সাথে পাল্টে গেল পুরো অন্য কিছুতে। অর্থাৎ, সময় বদলেছে, সেই সাথে হাই হিল জুতোর লিঙ্গপরিচয় বদলেছে। রাজা চতুর্দশ লুই থেকে এখন মেরিলিন মনরো, কিম কার্দাশিয়ান, বিয়ন্সে বা কার্ডি বি-দের আদরের জিনিস হয়ে উঠেছে সে।কিন্তু আপনি এটাকে শুধু খামখেয়ালিপনা বা স্রেফ ফ্যাশন বলে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। কারণ নারীরা এখন হাই হিল পরার পেছনে আরো অনেক ছুতো তৈরি করেছে। পা জোড়া লম্বা দেখাতে, কর্মক্ষেত্রে পেশাদার বা আত্মবিশ্বাসী হতে, খুব প্রিয় পোশাকের মানানসই সঙ্গী হিসেবে অথবা, যৌন আবেদন সৃষ্টির জন্য মেয়েরা উঁচু হিলের জুতা পরেন।
অথচ গায়ে গতরে খেটেখাওয়া মানুষের কাছে উঁচু হিলের জুতার কিন্তু তেমন কোনো উপযোগিতাই নেই। পৃথিবী জুড়ে কৃষক বা শ্রমিকের কাছে এই জুতোর কীই বা মূল্য? শুধু ধনী, প্রতিষ্ঠিত বা শহুরে শিক্ষিত মেয়েদের পায়েই এর উপযোগিতা। আবার ওদিকে পুরুষদের কাছে হাই হিল পরা মেয়েরা কেন এতটা আকর্ষণীয় এ-নিয়ে সেই ফরাসি জুতোর ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান লুবৌটিনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে বললেন, "হিল পরলে মেয়েদের হাঁটার গতি ধীর হয়ে আসে, তাতে করে পুরুষেরা তাদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সুযোগ পায়।” মেয়েদের দ্রুত হাঁটার দরকারই বা কী? ধীরে হাঁটলে তো ছেলেরা তাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে।
হ্যাঁ, এতটাই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত আজকের ফ্যাশন জগত। রাস্তাঘাটে, টিভিতে, অনলাইনে ভোগবাদী বিজ্ঞাপন, হলিউড, বলিউডের মত সিনেমার জগত দেখলে বুঝতে বাকি থাকে না যে হাই হিল কতটা যৌনতা এবং লিঙ্গবৈষম্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখন আবার কর্পোরেট কালচারে মেয়েদের এই হাই হিল পরাটা যেন অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ পুরুষদের আরামদায়ক যে কোনো জুতো পরতে কোন বাধা নেই। জাপানের মত অনেক দেশে তো মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে হিল পরবে এবং সবসময় হিলই পরবে, সেটা খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়, এমনকি যেখানে নারীদের ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সেসব কাজেও। অনেকক্ষণ ধরে প্রতিদিন এই হিল পরে থাকাটা শুধু যে কষ্টকর তাই নয়, এর ফলে পিঠে, কোমরে, পায়ে বা গোড়ালিতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও দেখা দেয়।
জাপানে ইদানীং লিঙ্গবৈষম্যময় কাজের পোশাকের বিরুদ্ধে জন্ম নিয়েছে এক প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলন #কুটুমুভমেন্ট, যেখানে নারীরা কাজে নিজেদের প্রয়োজন মত জুতো বেছে-নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। এতদিন ধরে এই আন্দোলনের ফলে ইদানীং অনেক জাপানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নারীকর্মীদের হিল ছাড়া জুতো পরার অনুমোদন দিচ্ছে।তবে এটা স্বীকার করতেই হয় যে, অনেক নারীই শখ করেই, এই হিল পরেন। আজকের নারীবাদ বলে যে, মেয়েরা তাদের স্বাধীনতা অনুযায়ী যে কোনো জুতা, জামা পরবে, তাতে সমস্যা কোথায়? না, সমস্যা নেই।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো একদিন যদি সমাজ কাঠামো আমূল বদলে যায়, যদি লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ তৈরি হয়, মেয়েদের শরীর এবং যৌনতাকে আর পণ্য না করা হয় বা কোন এক বিশেষ রূপে নিজেদের হাজির করার সামাজিক চাপ না থাকে, মেয়েরা কি তখনো শখ করে এই হাই হিল জুতো পরবেন নাকি তাঁরা ছেলেদের মতোই হিলের 'প্রকোপ' থেকে বেরিয়ে আসবেন?