বামন মানুষ হয় কেন? ছোট বেলায় গল্প শুনেছি বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর কথা। যারা খর্বাকৃতির মানুষ, তাদেরকে সচরাচর বামন মানুষ বলে ডাকা হয়। বিবর্তনের ইতিহাসে বামন মানুষের রয়েছে চমকপ্রদ এক গল্প।
হবিট কি সত্যিই ছিলো? রহস্যময় বামন প্রজাতির গল্প | Homo floresiensis
অনেক অনেকদিন আগের কথা, জানো, আমাদের পাশেই ওই জঙ্গলে বাস করতো এবু গোগোরা। দেখতে-শুনতে মানুষের মতই কিন্তু লম্বায় খুব ছোট্ট, এক্কেবারে বেঁটে বাঁটুল, ফিসফিসিয়ে কথা বলতো নিজেদের মধ্যে, হাঁটতোও কেমনভাবে। বামন হাতি থেকে শুরু করে বিশাল কমোডো ড্রাগন, এমনকি মানুষও খেয়ে ফেলতো তারা।
একদিন ওরা তোমার মত ছোট্ট একটা বাচ্চাকে ধরে নিয়ে চলে গেল, সেদিন রাগে দুঃখে আমরা গিয়ে ওদের গুহায় দিলাম আগুন ধরিয়ে। ধোঁয়ার ভেতর থেকে দেখলাম, দুজন এবু-গোগো কিভাবে যেন জঙ্গলে পালিয়েও গেল। এমন করেই ছোটদের রূপকথার গল্প শোনান ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপের বুড়োরা। এবু মানে দাদিনানি, আর গোগো মানে হল পেটুক - 'যা সামনে পায় তাই খায়'। কিন্তু ২০০৩ সালে ঘটলো অবাক এক কাণ্ড। নৃতত্ত্ববিদেরা ফ্লোরেসের জংগলে Liang Bua গুহায় খুঁজে পেলেন বেশ কিছু আদি-মানুষের ফসিল一ছোট্ট-খাট্ট লিলিপুট মানুষদের হাড়গোড়一সেই রূপকথার গল্পগুলোর সাথে যেন হুবহু মিলে যাচ্ছে। এরা আমাদের দীর্ঘ মানব বিবর্তনের ইতিহাসের কাহিনিতে উত্তরের চেয়ে জন্ম দিয়েছে অনেক বেশি প্রশ্নের। আসুন, আজকে শোনা যাক আমাদের বিশাল এই মানুষ পরিবারের রহস্যময় নতুন এই সদস্যের গল্প।
Liang Bua গুহায় সেই লিলিপুট মানুষের হাড়গোড়গুলো পেয়ে প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই এটা কোনো ছোটো ছেলে বা মেয়ের ফসিল হবে। কিন্তু তারপরই কাছাকাছি জায়গায় পাওয়া গেল আরো অনেকগুলো একই রকমের কঙ্কালের অংশবিশেষ। এদের উচ্চতা মাত্র এক মিটার, মাথার খুলি এবং মস্তিষ্ক অনেকটাই শিম্পাঞ্জির মত, মস্তিষ্কের সাইজ মাত্র ৪০০ সিসির কাছাকাছি, যেখানে আমাদের, আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের মাপ গড়ে ১৩০০ সিসি। এদের পা শরীরের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা। ঘাড়ের হাড়, হাতের কব্জি বা শ্রোণীর গড়ন অনেকটাই আমাদের সেই মানুষের বিবর্তনের ভিডিওতে দেখা, ৩০-৪০ লক্ষ বছর আগের সেই আদি মানুষ প্রজাতি 'লুসি'-র মত। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, এরা হয়তো ক্রেটিনিজমের বা ডাউন সিন্ড্রোমের মত কোনো রোগের শিকার হওয়া আধুনিক মানুষ, তবে সেগুলোও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বহু বৈজ্ঞানিক তর্কবিতর্ক, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বোঝা গেল এরা আসলে মানুষেরই আরেক নতুন প্রজাতি, Homo floresiensis। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এরা ১২ হাজার বছর আগে পর্যন্ত এরা টিকে ছিল ফ্লোরেসে, কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে যে এরা আসলে ৫০,০০০ বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এই গুহাতেই, বিলুপ্ত হয়ে-যাওয়া বামন হাতিদের হাড়ও পাওয়া গেছে, তাদের পাশেই। তার মানে হয়তো, এই দ্বীপে শুধু মানুষ প্রজাতিরই নয় অন্যান্য প্রাণির মধ্যেও বামনত্বের বিকাশ ঘটেছিল। তাহলে কী এটা আইল্যান্ড ডোয়ার্ফিজম না বামনত্বের ফল? সে আলোচনা না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। ফিরে আসি আমাদের গল্পে। সেই গুহায় প্রাচীন সব হাতিয়ারের সাথে ভয়ঙ্কর কমোডো ড্রাগনের ফসিলও পাওয়া গেছে। তাহলে তো তারা হাতিয়ার বানাতে আর দলবদ্ধ হয়ে শিকারও করতে পারতো! এর আগে আর কোন মানুষের প্রজাতিকে এত ছোট মস্তিষ্ক নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে শিকার করতে দেখা যায়নি। তবে এখানে এর চেয়েও বড় একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানী মহলে। আমরা তো বিবর্তনের ইতিহাসে গত বিশ লাখ বছরে এত ছোট মস্তিষ্কের এবং আদিম বৈশিষ্ট্যের কোন মানুষের প্রজাতি দেখিনি। অথচ এই হবিটেরা নাকি মাত্র ৫০ হাজার বছর আগেও টিকে ছিল এই দ্বীপে। তাহলে এরা কোথা থেকে এল?
অনেকে ধারণা করছেন, Homo erectus-দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিবর্তিত হতে হতে হয়তো এরা একসময়ে বামনে পরিণত হয়েছে। এই Homo erectus-রাই আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আরেক দল বিজ্ঞানী ভাবছেন, Homo habilis-দের মত কোনো প্রাচীন প্রজাতি থেকে উদ্ভব ঘটেছে এই Homo floresiensis-দের, যাদের সাথে এদের মস্তিষ্কসহ অন্যান্য শারীরিক গঠনেরও মিল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু Homo habilis-দের আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে-পড়ার বা এশিয়ার এত দূর প্রান্তে বসতি গড়ার প্রমাণও তো পাওয়া যায়নি। তাহলে কি ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, আমাদের পৃথিবীর বুকে আরো অনেক আদি মানুষের প্রজাতি হেঁটে বেড়িয়েছে যাদের সন্ধান আমরা এখনো পাইনি?
আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না কিভাবে এই হবিটেরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। জাভার পূর্বের এই দ্বীপগুলোতে ১২ হাজার বছরের আগে পর্যন্ত কোন আধুনিক মানুষের অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও, দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়াতে কিন্তু আমাদের প্রজাতি ৫০ হাজার বছর আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই এই সম্ভাবনাটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না যে, ইউরোপের নিয়ান্ডারথালদের মতই হয়তো এই বামনেরাও বিলুপ্ত হয়ে গেছিল আধুনিক মানুষের সংস্পর্শে আসার পরপরই। আমাদের কি কোন হাত ছিল তাদের বিলুপ্তির পিছনে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু দিন। ।
References:
FUTUYMA, D. J. & Kirkpatrick, M; Evolution, Fourth Edition, Sunderland, Massachusetts U.S.A : Sinauer Associates, Inc. Publishers, 2017.
বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর প্রকাশনী, ২০০৮
https://www.nature.com/news/did-humans-drive-hobbit-species-to-extinction-1.19651
https://www.researchgate.net/publication/303825251_Face_to_Face_with_Hobbit