সূর্যের শেষ পরিণতি | How Does the Sun Die? | Think Bangla

.

আমাদের মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে দশ হাজার কোটিরও বেশি তারা আর অন্তত সমান সংখ্যক গ্রহ আছে। আর তাদের মাঝে আমাদের এই পৃথিবী একটা ছোট্ট গ্রহ এবং সূর্য একটা মাঝারি আকারের তারা বই আর কিছু নয়। সব তারার মতই সূর্যও নিউক্লিয়ার ফিউশানের মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম ও শক্তি তৈরি করে এবং মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রের মতই আমাদের সূর্যের জ্বালানির এই ভাণ্ডারও একদিন ফুরিয়ে যাবে।আমাদের মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে হাজার হাজার কোটি তারার মতই সূর্যও নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম ও শক্তি তৈরি করে এবং মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রের মতই আমাদের সূর্যের জ্বালানির এই ভাণ্ডারও একদিন ফুরিয়ে যাবে।আমাদের তাপ, আলো, শক্তির আধার আর প্রাণের উৎস এই সূর্যের মৃত্যুর প্রক্রিয়াটা ভয়াবহ এবং দীর্ঘ, যার ফলে পৃথিবীসহ আমাদের পুরো সৌরজগতও বদলে যাবে, চিরতরে। চলুন, থিংক-এর বন্ধু জ্যোতির্বিদ ড. দীপেন ভট্টাচার্যের সাথে আজকে জেনে নেওয়া যাক, আমাদের সূর্যের এই জটিল এবং নাটকীয় অন্তিম পরিণতিটা ঠিক কিভাবে ঘটবে। এর আগে ‘সূর্য কেন নিভে যায় না’ ভিডিওতে আমরা দেখেছিলাম, কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গীকরণ এবং দুর্বল বল সূর্যকে ধীরে ধীরে, বেশি সময় ধরে জ্বলতে সাহায্য করে। সূর্যের কেন্দ্রের দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু অর্থাৎ দুটো প্রোটন তাদের তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে ও কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ তৈরি করে একে অপরের খুব কাছে আসতে পারে কিন্তু জুড়তে পারে না। একটা প্রোটন অন্যটার সাথে সংযোজিত হতে দরকার আরেকটা মহাশক্তিশালী গুরুত্বপূর্ণ বলের, যার নাম স্ট্রং ফোর্স বা সবল বল। প্রকৃতিতে যে চারটি মৌলিক বল আছে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হল এই নিউক্লীয় সবল বল। কিন্তু এত শক্তিশালী হলে কী হবে? দূরপাল্লার কিছুতে সে কিন্তু বড্ড অসহায়। তার ক্ষমতা শুধু কাজ করে খুব কাছাকাছি-থাকা জিনিসের উপর। 


কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গের মাধ্যমে যেই মুহূর্তে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু কাছাকাছি চলে আসে সবল বল তাদের জুড়ে দিয়ে তৈরি করে হিলিয়াম পরমাণুর একটি আইসোটোপ যেটার মধ্যে কোনো নিউট্রন নেই। এর পরে আরো প্রোটন যুক্ত হয়, আর তার উপরে সবল ও দুর্বল বল দুটোই এক সাথে কাজ করে তৈরি করে নিউট্রনসহ হিলিয়াম পরমাণু, নিউট্রিনো ও গামা রশ্মি। আমরা জানি যে, পৃথিবীতে আমাদের প্রজাতির বিবর্তন ঘটে ২ থেকে ৩ লাখ বছর আগে।  আমরা সূর্যকে মাত্র এই ২/৩ লাখ বছর আগে থেকে দেখে আসলেও সূর্যকে কেন্দ্র করেই আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি ঘটে সাড়ে চারশো' কোটি বছর আগে।আর সব তারার মতই আমাদের মাঝবয়সী সূর্যও একদিন নিভে যাবে। তবে কোন নক্ষত্রের পরিসমাপ্তি ঠিক কিভাবে ঘটবে সেটা নির্ভর করে তার ভরের ওপর। আমারা এখন জানি যে, সূর্যের মত মাঝারি একটা তারার নিভে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয় তার জন্মের দশ থেকে বারোশ' কোটি বছর পরে।   সূর্য আমাদের পৃথিবীর মত নিরেট বস্তু নয়। এর সমস্ত গ্যাসীয় কণা, সূর্যের সামগ্রিক মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে, সবসময়ই কেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে চায়। আর ওদিকে আবার সূর্যের কেন্দ্রে ফিউশান প্রক্রিয়া থেকে তৈরি শক্তি সেখানকার কণাদের গতিশক্তি দেয় যেটা ওপর থেকে নেমে-আসা এই মাধ্যাকর্ষণ চাপ প্রতিরোধ করে।  তো এখন সূর্যের কেন্দ্রে পারমাণবিক ফিউশানের ফলে এই শক্তি উৎপন্ন না হলে কী হতো?  


সূর্য বহুদিন আগেই ধ্বসে পড়ত অর্থাৎ তার কেন্দ্রের উপর সমস্ত ভর ভেঙে পড়তো এবং সূর্য একটা শ্বেত বামন বা White Dwarf-এ পরিণত হত। ওই দুই স্তরের এই পারস্পরিক প্রতিরোধ, অন্যান্য সব তারার মতই সূর্যকেও একটা সাম্যাবস্থা দেয়। তার ফলে সে সংকুচিতও হয় না, আবার স্ফীতও হয় না। একে বলে hydrostatic equilibrium, বা ঔদস্থিত সাম্যাবস্থা। গত প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর ধরে আমাদের সূর্য এরকম একটা সাম্যাবস্থায় আছে।কিন্তু এই সাম্যাবস্থার মানে এই না যে এতদিনে সূর্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই সময়ে সূর্যের ব্যাস বেড়েছে শতকরা ১৩ ভাগ, অর্থাৎ এখনকার ব্যাস যদি ধরি ১০০, সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে তার ব্যাস ছিল ৮৮। সূর্যের উজ্জ্বলতা বেড়েছে শতকরা ৪০ ভাগ। এখনকার ঔজ্জ্বল্যের পরিমাণ যদি ধরি ১০০, তবে সূর্যের উৎপত্তির সময়ের ঔজ্জ্বল্য ছিল ৭১। 



আজ থেকে সাড়ে ছশো কোটি (৬.৫ বিলিয়ন) বছর পরে সূর্যের কেন্দ্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি সব ফুরিয়ে যাবে, অর্থাৎ কেন্দ্রের সব হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয়ে যাবে। ভেতরের হাইড্রোজেন সব ফুরিয়ে গেলে, এই সময়ে, কেন্দ্রের ঠিক উপরে কেন্দ্র ঘিরে যে-খোলসটা আছে তার হাইড্রোজেনের মধ্যে শুরু হবে পারমাণবিক ফিউশন। এতে করে hydrostatic সাম্যাবস্থা তো আর থাকবেই না সেই সাথে শুরু হবে এক ভয়ানক দক্ষযজ্ঞ। এই খোলসের ফিউশনের ফলে একদিকে সূর্য যেমন আরও জ্বলজ্বলে হতে থাকবে, এর চাপে সূর্যের কেন্দ্রও ছোটো হতে শুরু করবে, তেমনই বাড়তে থাকবে তার আয়তনও। আর ওদিকে এই বাড়তি অংশে তাপ ছড়িয়ে পড়ার কারণে তার সামগ্রিক তাপমাত্রাও কমতে থাকবে এবং সূর্যের রং আরও লাল হতে শুরু করবে। যে কোনো নক্ষত্রের এই অবস্থাকে বলে রেড জায়েন্ট বা লাল দানব পর্যায়।  



এর পর সূর্যের উপরের স্তরে তৈরি এই হিলিয়ামের অনেকখানি গিয়ে জমা হবে সূর্যের কেন্দ্রে এবং হিলিয়াম কেন্দ্রের ঘনত্ব আর তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। আবার সূর্য যতই বড় হয়ে উঠবে ততই তার তাপমাত্রা কমবে এবং  রং আরও লাল হবে কারণ একই পরিমাণ শক্তি বড় আয়তনে ছড়িয়ে পড়লে তাপমাত্রা কমে যায়। এদিকে সূর্যের সামগ্রিক ঔজ্জ্বল্য আজকের  ঔজ্জ্বল্যের চেয়ে দুহাজার (২০০০) গুণ বেশি হবে। সূর্যের পরিধি বুধ গ্রহের কক্ষপথ ছাড়িয়ে যাবে, এমনকি সে শুক্রের কাছাকাছিও  চলে আসতে পারে। পৃথিবীও পুড়ে যাবে, হয়তো তখনো টিকে থাকবে শুধু তার লোহার কেন্দ্রটা।কিন্তু এই ভয়াবহ পরিস্থিতিটাকে সূর্যের শেষ খেলা ভেবে থাকলে ভুল করবেন। এর অন্তিম পরিণতি এখনো বহুদূর। আমাদের এই সূর্য হচ্ছে সেই দানব যার শেষটা শুধু দানবীয়ই নয়, অত্যন্ত নাটকীয়, দীর্ঘ এবং জটিল।


প্রায় সাড়ে সাতশ কোটি বছর পরে সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা যখন ১০০ মিলিয়ন কেলভিনে পৌঁছাবে তখন হঠাৎ সেখানে শুরু হয়ে যাবে হিলিয়ামের পারমাণবিক ফিউশান বা হিলিয়াম ফ্ল্যাশ। এর ফলে সূর্যের কেন্দ্রে তিনটে হিলিয়াম পরমাণু মিলে একটা কার্বন পরমাণু ও শক্তি তৈরি করবে। কিছু কার্বন আবার হিলিয়ামের সঙ্গে মিলে তৈরি করবে অক্সিজেন। হিলিয়াম ফ্ল্যাশের সময়, কয়েক মিনিটের মধ্যে যে অকল্পনীয় শক্তি বের হয় তা বর্তমান সূর্যের ২০ কোটি বছর ধরে বিকিরিত শক্তির সমান। এর প্রায় পুরোটাই চলে যাবে হিলিয়াম কেন্দ্রের ব্যাস আর ওপরের হাইড্রোজেন খোলসের আয়তন বাড়াতে। অর্থাৎ হিলিয়াম ফ্ল্যাশ থেকে যে শক্তিটা পাওয়া গেল তা সূর্যের ভেতরেই থেকে গেল। অন্যদিকে ওপরের হাইড্রোজেন খোলসের আয়তন বেড়ে যাবার ফলে সেটার তাপমাত্রা কমবে, আর তাপমাত্রা কমলে সেখানে হাইড্রোজেন ফিউশনের মাত্রাও কমে যাবে। ফিউশানের মাত্রা কমে গেলে সূর্যের উজ্জ্বলতাও কমবে। আবার হাইড্রোস্টাটিক সাম্যাবস্থাও রাখা যাবে না, তাই সূর্য বাইরের স্তরের মাধ্যাকর্ষণজনিত চাপের কারণে আবার ছোটো হতে থাকবে। তার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়বে, লাল থেকে সে হতে থাকবে কমলা-হলুদ। একে বলে ছোটো দানব পর্যায়। এই পর্যায়ে সূর্যের ব্যাস হবে আজ থেকে দশগুণ বেশি, উজ্জ্বলতা বেশি হবে প্রায় ৪৫ গুণ। কেন্দ্রের সাথে লাগানো হিলিয়ামের খোলসে তখন ফিউশান শুরু হবে। 


এসময় সূর্যের কেন্দ্রে থাকবে কার্বন-অক্সিজেনের ছাই, তার ওপর হিলিয়াম ফিউশানের খোলস, তার ওপর আবার হিলিয়াম ছাই, যাকে ঘিরে থাকবে একটা হাইড্রোজেন ফিউশানের খোলস আর সবার ওপরে হাইড্রোজেনের আবরণ। কিন্তু সূর্য মাত্র ১৫ কোটি বছর এরকম একটা সাম্যাবস্থায় থাকবে। হিলিয়াম পুড়বে ভেতরে আর হাইড্রোজেন পুড়বে বাইরে।



ভাবছেন এই তো বুঝি শেষ হলো আমাদের সূর্যের কাহিনি? নাহ, আরো আছে... এরপর সূর্য আবার বড় হতে শুরু করবে। কারণ কেন্দ্র থেকে আরো দূরের বড় বড় খোলসে হাইড্রোজেনের ফিউশান হবে। সূর্যের উজ্জ্বলতা বাড়বে এখনকার চেয়ে ৩০০০ গুণ বেশি।  সূর্যের আকার বড় হতে হতে হতে পৃথিবীর কক্ষপথকেও ছাড়িয়ে যাবে। এই সময়কার সূর্যকে বা যে কোনো নক্ষত্রকে বলা হয় asymptotic giant branch বা AGB তারা।এরপর প্রতি এক লক্ষ বছর পর পর চার পাঁচটা ছোট হিলিয়াম ফ্ল্যাশ হতে থাকবে। তখন সূর্যের বাইরের অংশটা-মূলত হাইড্রোজেন-মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হবে। সূর্যের প্রায় ৪৫ ভাগ ভর এইভাবে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে সূর্যের চারদিকে একটা অপূর্ব planetary nebula বা নীহারিকা গঠন করবে। সূর্য হবে এখনকার চেয়ে ৪০০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল। কিন্তু সে তার চারধারের এই নীহারিকাকে এভাবে উজ্জ্বল করে রাখতে পারবে মাত্র কয়েক হাজার বছর।



এরপর আজ থেকে সাতশ নব্বই কোটি বছর পরে, সূর্যের সমস্ত ফিউশান বন্ধ হয়ে আসবে। পুরো সূর্য আপতিত হবে বা মাধ্যাকর্ষণের ফলে নিজের মধ্যে ভেঙে পড়বে। ছোটো হয়ে তার আকার হবে আমাদের আজকের পৃথিবীর মত, যার ভিতরে থাকবে মূলত হিলিয়াম ফিউশান থেকে তৈরি সেই পদার্থগুলো-কার্বন ও অক্সিজেন।  পরিশেষে, আমাদের সূর্য পরিণত হবে শ্বেত বামন, white dwarf-এ। তার ওপরের তাপমাত্রা হবে এক লক্ষ কেলভিন আর তার ভেতরে এক চামচ বস্তুর ভর হবে এক টন! আর সেই সময়ে আমাদের উত্তরসূরিরা-যদি বিবর্তনের ধারায় তখনো টিকে থাকে-হয়তো তাদের আর তখন মানুষ বলা যাবে না, কিন্তু বহুদূরের কোনো গ্রহ থেকে তারা সূর্যের এই শেষ পরিণতি দেখবে।

আর তারপর, হ্যাঁ তারও পরে, প্রায় ১০ লক্ষ কোটি বছর ধরে আমাদের এই শ্বেত বামন সূর্য ধীরে ধীরে, তার সমস্ত উত্তাপ মহাশূন্যে বিকিরণ করতে করতে, পরিণত হবে এক কালো বামনে।  আমাদের মহাবিশ্বের বয়স এখনই ১৪০০ কোটি বছরের কাছাকাছি, আর এত দীর্ঘ সময়ের পরে,  শুধু আমাদের সূর্যই নয়, মহাবিশ্বের কোনো তারাই কিন্তু আর জ্বলবে না, নতুন তারাও সৃষ্টি হবে না।   



সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles