সূর্য কেন নিভে যায় না? | Why Doesn't the Sun Burn Out? | Think Bangla

.

গরমকালের দুপুরে বাইরে কড়া রোদে দাঁড়ালে মনে হয় না, আকাশে জ্বলছে একটা গনগনে আগুনের চুলা? কিন্তু আগুনের চুলা হতে গেলে সূর্যটার যতটা উত্তপ্ত হওয়ার কথা ছিল সে আসলে ততোটা নয়। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। সূর্য আমাদের যে পরিমাণ শক্তি আর তাপ জোগায়, সেটা আগুন জ্বেলে তৈরি করতে গেলে যে উত্তাপের প্রয়োজন, সূর্যের তা নেই।  তাহলে সে এই প্রবল শক্তি, তাপ, আলো সব যোগায় কিভাবে?  উনিশ শতকের সনাতন বা “classical” পদার্থবিদ্যা  নিয়ে বসে থাকলে সূর্য কীভাবে এই শক্তি তৈরি করে তা চিরকাল আমাদের কাছে রহস্যই থেকে যেত। তাই আজকের থিংক ভিডিওতে আমরা ঢুকবো সেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত চমক-লাগানো জগতে, যা দিয়ে সূর্যের এই রহস্য ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করব সূর্য কেন জ্বলন্ত দেশলাইকাঠির মতো পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে না। 


সূর্য ছাড়া পৃথিবীতে কোন জীবেরই অস্তিত্ব সম্ভব হতো না। এখানে প্রতিনিয়ত যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়াবিক্রিয়া চলছে তার কারণ এই সূর্য। সূর্য না থাকলে আমাদের পৃথিবী হয়ে যেতো অন্ধকার, নিষ্প্রাণ, বরফঠান্ডা, এক পাথরের পিণ্ড। আমাদের গ্রহের জল-হাওয়া, তাপ, আলো, গাছপালা, পশুপাখি, প্রায় সবকিছুর পেছনে রয়েছে এই সূর্য। আমাদের পূর্বসূরিরাও সেটা বুঝে গেছিলেন বহুযুগ আগে। তাই সেই আদিকাল থেকেই মানুষ সূর্যকে স্থান দিয়েছিল দেবতার আসনে। তবে এটাও ঠিক যে,  এই 'সূর্য-দেবতা' ঠিক কীভাবে পৃথিবীকে লালন করে চলেছে, সে নিয়ে আমাদের কোনো ধারনা ছিল না গত শতাব্দী পর্যন্তও।প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিরাট আগুন আর গ্যাসের গোলাটা যদি শুধু তাপের মাধ্যমে শক্তি তৈরি না করে, তাহলে করে কীভাবে? আমাদের থিংক-এর বন্ধু, জ্যোতির্বিদ, ড. দীপেন ভট্টাচার্য ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন থিংক এর ভিদিওতে।


সব তারার মতো সূর্যের শক্তিও তৈরি হয় এর পেটের মধ্যে। কিন্তু সেখানে চুলার মতো আগুন জ্বলছে না, বরং আছে একটা বিশাল শক্তিশালী নিউক্লিয়ার ফিউশন চুল্লি। তো, এই নিউক্লিয়ার ফিউশন বা বাংলায় বললে ‘কেন্দ্রিণ সংযোজন’ ঘটনাটা আসলে কী?কোনো পদার্থের দুটো পরমাণু যখন এক হয়ে নতুন একটা ভারি পরমাণু সৃষ্টি করে, তাকে বলে ফিউশন। এই ফিউশন থেকেই বেরিয়ে আসে নিউট্রন, আর গামা রশ্মির বিপুল শক্তি। কিন্তু দুটো পরমাণু পাশাপাশি থাকলেই কিন্তু ফিউশন ঘটে যায় না, এর জন্য সূর্যের কেন্দ্রে দরকার হয় এক বিশেষ পরিস্থিতির। সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি কেলভিন, মানে প্রায় দেড় কোটি সেলসিয়াস বা তিন কোটি ফারেনহাইট। দেড় কোটি কেলভিন, তিন কোটি  ফারেনহাইট এগুলো বললে আসলে বোঝা মুশকিল।কল্পনা করুন, আপনি ফুটন্ত গরম লাভায় হাত রাখলেন। এইবার ঐ গরমকে ১২ হাজার দিয়ে গুণ করুন। ওটাই মোটের ওপর সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা। আবার ওদিকে আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের  চাইতে সূর্যের কেন্দ্রে চাপও প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি গুণ বেশি।  শুনতে ভয়াবহ রকমের বেশি মনে হলেও, নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানোর জন্য সূর্যের কেন্দ্রের এই অকল্পনীয় রকমের তাপ এবং চাপও যথেষ্ট নয়। তাহলে ফিউশনটা ঘটছে কিভাবে? আরেকটু খুলে বলি ব্যাপারটা।


সূর্য প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি, যেটা হচ্ছে তার শক্তির উৎস। আর আমরা জানি, প্রতিটা হাইড্রোজেন পরমাণুতে রয়েছে একটা করে প্রোটন এবং এই প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক। আমরা এও জানি, একই রকমের চার্জ একে অন্যকে বিকর্ষণ করে। তাই এই ধনাত্মক চার্জের প্রোটনেরাও শক্তিশালী চুম্বকের মতো যত কাছাকাছি আসে ততোই বিকর্ষিত হয়। বৈজ্ঞানিকেরা একে বলেন কুলম্ব বিকর্ষণী শক্তি। এই বিকর্ষণের শক্তিটা এতটাই জোরালো যে এদের পক্ষে নিজে থেকে জুড়ে যাওয়া অসম্ভব, যদি না প্রচণ্ড বেশি রকমের তাপমাত্রায় তাদের রাখা হয়, যা মোটামুটি এক হাজার কোটি কেলভিনেরও বেশি! কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা মাত্র তো দেড় কোটি কেলভিন!  এরা জুড়ছে কীভাবে?  এখানে এসেই আমাদের ক্লাসিকাল ফিজিক্সের জ্ঞান দিয়ে আর কুলায় না।  একে ব্যাখ্যা করতে গেলে দরকার হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার। এই কোয়ান্টাম জগতে প্রোটনেরা শুধু কণাই নয়, তারা একই সাথে  তরঙ্গ বা ঢেউয়ের মতোও আচরণ করে। হ্যাঁ ব্যাপারটা আমাদের কাছে অদ্ভুত শোনালেও এটাই কোয়ান্টাম জগতের ক্ষুদ্র কণার জন্য বাস্তবতা। অর্থাৎ, এখানে প্রতিটা পরমাণু একই সাথে কণা এবং তরঙ্গেরও এক একটা প্যাকেট! তা এই হাইড্রোজেন পরমাণুরা কাছাকাছি এলে যা ঘটে তা হলো এদের ভিতরের প্রোটনের তরঙ্গের ঐ ঢেউ একটা এসে পড়ে অন্যটার ওপর। কিন্তু তরঙ্গ মিললেই তো আর প্রোটনেরা জুড়ে যাচ্ছে না! ঐ যে বলেছিলাম একই রকম ধনাত্মক চার্জের কারণে প্রোটনেরা প্রবলভাবে একে অপরকে বিকর্ষণ করতে থাকে? তবে এখানে একটা  খুব বিশেষ ঘটনা ঘটে।

  

এই অজস্র প্রোটনের তরঙ্গের ভিড়ে, দুএকখানা প্রোটন কখনো কখনো অন্য একটা প্রোটনের সেই কুলম্ব বিকর্ষণী শক্তিকে হারিয়ে দিয়ে মাঝখান দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলে। তারপর সে এই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে সিঁধকাটা চোরের মতো ঢুকে গিয়ে অন্য আরেকটা প্রোটনের সাথে জুড়ে যায়। এর গালভরা বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে কোয়ান্টাম টানেলিং এবং প্রোটনের এই সিঁধ কেটে ঢোকার জন্য আর এক হাজার কোটি কেলভিন লাগে না, এর জন্য দেড় কোটি কেলভিনই যথেষ্ট! আর দুখানা প্রোটন যেই জুড়ে যায়, তৈরি হয় শক্তি, সূর্যের ব্যাটারি যায় চার্জ হয়ে! কিন্তু আবার একটা প্রোটনের সুড়ঙ্গ করে আর একটি প্রোটনের সঙ্গে মিলে যাবার সম্ভাব্যতা খুবই কম। মনে করা হয়, গড়ে একটা প্রোটনকে কয়েক শ কোটি বছর অপেক্ষা করতে হয় সুড়ঙ্গিত হতে। তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম কালেভদ্রে যদি এই ঘটনা ঘটে, তাহলে সূর্যের এত শক্তির অবিরত জোগান আসছে কীভাবে? 


আসলে সূর্য একটা মাঝারি তারা হলেও সে তো নেহাত ছোটো মাপের না, তার পেটের ভেতর প্রোটন আছে  অজস্র, অগুনতি, যাদের মধ্যে থেকে অল্প কয়েকজন সফল হলেও প্রতি সেকেন্ডে বহু প্রোটন সংযোজিত হয়ে যায় আর তা দিয়েই আসতে থাকে শক্তির অনবরত জোগান। আবার ওদিকে এত কম একটা দুটো করে প্রোটন জোড়ে ব’লে প্রোটনের ভাঁড়ারও ফুরোয় না হাজার কোটি বছর ধরে! এখন এই সূর্যের কেন্দ্রে, হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রোটনগুলো এইভাবে জুড়ে গিয়ে বানায় হিলিয়াম, আর বিপুল শক্তির গামা ফোটন। ফোটন হল আলোর কণিকা, কিন্তু গামা ফোটন, আমরা যে আলো দেখি তার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। তারপর কেন্দ্র থেকে এই গামা শক্তি বেরিয়ে আসতে শুরু করে, এবং সূর্যের কেন্দ্র থেকে নানান স্তর পেরিয়ে বাইরের পিঠে পৌঁছুতে এর সময় লাগে প্রায় লক্ষ বছর!

 

তো এতটা সময় ধরে পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তার শক্তি কমে যায়, আর সেই ক্ষয় হয়ে-যাওয়া শক্তির বেশিরভাগটাই বেরিয়ে এসেছে ফোটন হ’য়ে আলোর আকারে। আর সেই আলোর সূর্য থেকে পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লাগে মাত্র আট মিনিট। তার মানে হলো এখন রোদে গিয়ে দাঁড়ালে যে আলোটা আপনার মুখে এসে পড়বে, সেটা হয়তো সূর্যের কেন্দ্রে হাজার হাজার বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে, হয়তো পৃথিবীতে আদি মানবেরা যখন আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসতে শুধু করছিলেন, তখন, বা তারও আগে! এই তো গেল কোয়ান্টাম টানেলিঙের মাধ্যমে সূর্যের তাপ, আলো, শক্তি বানানোর গল্প। কিন্তু সূর্য কেন আজও নিভে যায়নি তার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিয়ে একটুখানি বলা দরকার। ওই যে দুটো করে প্রোটন জুড়ে হিলিয়াম তৈরি হচ্ছে, সেই হিলিয়ামের একটা পরমাণুতে আছে দুটো প্রোটন আর দুটো নিউট্রন। তো হিলিয়াম বানানোর সময় একটা প্রোটন ভেঙ্গে তৈরি হয় একটা নিউট্রন, একটা পজিট্রন, আর একটা ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো। এবং এই ভাঙার প্রক্রিয়াটা ঘটে ভীষণ ধীরগতিতে। এখানে যে বলটা কাজ করে তার নাম হচ্ছে weak force বা দুর্বল বল। এবং এই বলের কারণেই হিলিয়াম তৈরির সময় প্রোটন ভাঙার কাজটা ঘটে খুব ধীরে। আর এতো ধীরে ধীরে হয় ব’লে সূর্যের জ্বলেপুড়ে ফুরিয়ে যাওয়ার ঘটনাটাও পিছিয়ে যাচ্ছে। 


সূর্য প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি কিলোগ্রাম ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করছে যে শক্তির একটা অংশকে সূর্যালোক হিসেবে পৃথিবীতে আমরা পাই। তবে এই সূর্যের আলো অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত সূর্য যদি নিউক্লিয়ার ফিউশান প্রক্রিয়ায় এটা না বানিয়ে আগুন জ্বেলে বানাতো এবং সেই সাথে কোয়ান্টাম টানেলিং এবং দুর্বল বলের মত ধীর প্রক্রিয়া দুটি না থাকলে সূর্য বহু আগেই তার জ্বালানি পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিত এবং পৃথিবীর বুকে প্রাণের বিবর্তনেরও কোন  সুযোগ হতো না। সূর্যের শক্তির রহস্যের সমাধান নিয়ে এই যে গল্পটা আপনাদের শোনালাম, হয়তো অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, সেটা জানা গেলো কীভাবে? সূর্যের পেটের ভেতর ঘটে চলা এই নিউক্লিয়ার ফিউশানটা যে স্রেফ রূপকথা নয়, তার প্রমাণ কী? 


প্রমাণ আছে! বলেছিলাম না, ফিউশনের মাধ্যমে হিলিয়াম বানানোর সময় একটা প্রোটন ভেঙে তৈরি হয় একটা নিউট্রন, একটা পজিট্রন, আর একটা ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো? ঐ নিউট্রিনো কণাটা আবার খুবই নাক-উঁচা। কারো সাথে তার বিশেষ বনে না, খুব অল্প কিছু পদার্থের সঙ্গেই সে ক্রিয়াবিক্রিয়া করে। ফলে ফিউশনে প্রতি সেকেন্ডে তৈরি হওয়া কোটি কোটি নিউট্রিনো কণার অধিকাংশই সূর্য থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।  যারা  পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তারা আবার পৃথিবীর শরীর ফুঁড়ে বের হয়ে যায়। এইভাবে প্রতি সেকেন্ডে সূর্য থেকে আসা ১০০ ট্রিলিয়ন বা একশ লক্ষ কোটি নিউট্রিনো আমাদের শরীরের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে যারা আমাদের শরীরের সাথে কোন বিক্রিয়াই করে না। পৃথিবীতে বসেই বিজ্ঞানীরা মাটির নিচে বিশাল detector বানিয়ে এই নিউট্রিনোকে ডিটেক্ট করতে পেরেছেন এবং সরাসরি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে সূর্যের ভেতর  আসলেই এই নিউক্লিয়ার ফিউশান ঘটছে। এটা প্রমাণ করতে আমাদের সূর্যের ভেতরে যেতে হয়নি।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles