মেয়েদের মাসিক বা পিরিয়ড | মেয়েদের মাসিক হয় কেন? | Period or Menstruation | Think Bangla

.

আপনি কি জানেন, আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে প্রাচীন রোমানরা বিশ্বাস করত, কোন  কুকুর মাসিকের  রক্ত পান করলে জলাতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়, মাদি ঘোড়ার গর্ভপাত হয় এবং শস্যক্ষেতের কাছে ঋতুমতী নারী গেলে, সেই ক্ষেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়! আজ একুশ শতাব্দীতে বসে, জ্ঞানবিজ্ঞানের এত উন্নতির পরে, সেই অবস্থার কি খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে? আজো বহু সমাজেই মাসিক বা পিরিয়ড, ঋতু, ঋতুস্রাব, বা রজঃস্রাব যে-নামেই ডাকেন না কেন, শুধু একটা বিশাল ‘ট্যাবু'ই নয়, একে ‘দূষণ’, অচ্ছুৎ, অপবিত্র বা  বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। এখনো অসংখ্য বাঙালি মেয়ে মাসিকের সময় মাছ, মাংস, ডিম ছোঁয় না, রান্নাঘরে ঢোকে না। অসাবধানতাবশত পোশাকে রক্তের দাগ লেগে গেলে লজ্জার সীমা থাকে না। এই মাসিক নিয়ে ছেলেদের মধ্যে হাসাহাসি, টিটকারি বা নোংরা চুটকিরও অভাব নেই।  দোকানদার স্যানিটারি ন্যাপকিন এমনভাবে কাগজে মুড়ে দেন, যেন নিষিদ্ধ কোন বস্তু। পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন প্রচণ্ড  লজ্জা আর সংকোচের।


অথচ পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের জন্য এটা একটা বাস্তবতা। একজন নারীর প্রতি মাসে ২ থেকে ৭ দিন মাসিক হয়, তাকে গড়ে জীবনের প্রায় ৬ বছরের মত সময় এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই মুহূর্তের কথাই ধরুন না। পৃথিবীজুড়ে  প্রায় ৩০ কোটি মানুষের এখন মাসিক হচ্ছে। মাসিক নিয়ে এই যে এত লুকোছাপা, কুসংস্কার, অজ্ঞানতা, আজকের দিনে এর কি কোনো ভিত্তি আছে? এবং পিরিয়ড আসলে কী, নারীর দেহে কেন কিভাবে হয়, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব আজকের থিংক ভিডিওতে। মাসিক বা পিরিয়ড  নিয়ে আজকের এই আলোচনা শুরু করার আগে একটা ছোট্ট অনুরোধ, আমাদের ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকশন পেতে নিচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।বয়ঃসন্ধিকালে, একজন নারীর ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ফলিকলের ভিতর প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখের মত অর্ধপ্রস্তুত, অনিষিক্ত ডিম্বাণু থাকে। এসময় থেকে আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস এবং পিটুইটারি গ্ল্যান্ড প্রতি মাসে বিভিন্ন ধরনের হরমোন নিঃসৃত করে একইসাথে দুটি চক্রের জন্য প্রস্তুতি নেয়। 

- একটি হচ্ছে ডিম্বাশয় চক্র, এবং অন্যটি হচ্ছে 

- জরায়ু চক্র, যাকে  আমরা মাসিক বা ঋতুচক্র বলি। 


ডিম্বাশয় চক্রের কাজ হচ্ছে প্রতি মাসে যৌন হরমোন নির্গত করার সাথে সাথে সাধারণত যে কোনো একটি ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম্বাণুকে প্রস্তুত করে তোলা। এর ফলে, প্রতি মাসে একজন নারীর ডিম্বাশয় থেকে নিষিক্তকরণের জন্য প্রস্তুত একটি ডিম্বাণু নির্গত হয় এবং এই প্রক্রিয়ার নামই ‘ওভুলেশন’। এই ডিম্বাণুটি ডিম্বাশয় থেকে বেরিয়ে ফিলোপিয়ান টিউবের ভিতর দিয়ে জরায়ুর দিকে এগোতে থাকে। যদি ওভুলেশনের পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যে, যৌন মিলন বা অন্য কোন পদ্ধতিতে, শুক্রাণু দিয়ে ডিম্বাণুটি নিষিক্ত হয় তাহলে ভ্রূণের প্রথম কোষ বা ‘জাইগোট’ তৈরি হয় অর্থাৎ তখন নারীটি গর্ভধারণ করেন। 


ওদিকে আবার জরায়ু চক্র প্রথম দুই সপ্তাহ ধরে গর্ভাশয় বা  জরায়ুকে নিষিক্ত ডিম্বাণুর জন্য তৈরি করতে শুরু করে দেয়। জরায়ুর দেওয়ালের আবরক ঝিল্লি, এন্ডোমেট্রিয়ামের দেওয়াল  মোটা হয়ে রক্তবাহী নালিকায় ভরে উঠতে শুরু করে এবং সেই নিষিক্ত ভ্রূণটি ফেলোপিয়ান টিউবের মধ্যে দিয়ে এসে এন্ডোমেট্রিয়ামের দেওয়ালের গভীরে স্থাপিত হয়। সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত এন্ডোমেট্রিয়াম সাধারণত সপ্তাহখানেকের মত অপেক্ষা করে এই ভ্রূণস্থাপনের জন্য। আর যদি ডিম্বাণুটা সেই মাসে নিষিক্ত না হয়? তখনই শুরু হয় আমাদের মাসিকের গল্প। 

অনিষিক্ত ডিম্বাণুটিও এরই মধ্যে জরায়ুতে এসে পৌঁছে যায় এবং এন্ডোমেট্রিয়ামের সেই পুরু বাইরের অংশটি তখন এই অপ্রয়োজনীয়, অনিষিক্ত ডিম্বাণুসহ ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং রক্তের সাথে নারীর যোনি দিয়ে বের হয়ে যায়। ২ থেকে ৭ দিন লাগে শরীরের এই অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো বের করে দিতে। আর এই রক্তপাতকেই আমরা বলি মাসিক। মাসিকের সময়ে একজন নারীর দেহ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৯০ মিলিলিটার তরল বেরিয়ে যায়। কর্মস্থলে এবং যাতায়াতের রাস্তায় পরিচ্ছন্ন টয়লেট পাওয়া কঠিন এবং আমাদের দেশের অনেক নারীই স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ট্যাম্পন ব্যবহারের সুযোগ পান না। তাই মাসিক চলাকালে মেয়েরা যথেষ্ট কষ্ট করে স্কুল কলেজে যান বা কাজ করেন।


রক্তপাতজনিত ক্লান্তি ও অস্বস্তি ছাড়াও কিছু মেয়ের এই সময়ে মারাত্মক পেটে ব্যথা হয়, যাকে বলে ডিসমেনোরিয়া। হরমোন ও স্নায়ুসন্ধির নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা পরিবর্তনের ফলে প্রতি চক্রে ঋতুস্রাবের আগের কয়েক দিন অনেকের মন বিষন্ন থাকে, অনিদ্রা থেকে শুরু করে স্তনে ব্যথা, জ্বরজ্বর ভাব দেখা যায়। একেই বলে প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম বা পিএমএস এবং এ নিয়ে বহু চুটকি প্রচলিত আছে পুরুষালি আড্ডায় যা অত্যন্ত আপত্তিকর এবং অপমানজনক। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাকৃতিকভাবে এরকম একটা অস্বস্তিকর এবং অপচয়ী প্রক্রিয়ার বিবর্তন ঘটলো কেন? সাধারণত কোনো বিশেষ উপযোগিতা না থাকলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় তো এত্ত অপচয়ী একটা ব্যাপার টিকে থাকতে পারে না!

 

প্রাণিজগতে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে এই মাসিকের বিবর্তন ঘটেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাদুড়, হাতিশুঁড়ো ইঁদুর, কয়েকটি প্রাইমেট বানর এবং নরবানর, যার মধ্যে  মানুষও পড়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের সবার মধ্যেই এই বিবর্তন ঘটেছে আলাদা আলাদাভাবে। মনে করা হয় যে গর্ভধারণের কিছু বিশেষত্বের কারণেই এই প্রাণীদের মধ্যে মাসিকের মত এই রহস্যময় এবং অসুবিধাজনক ব্যাপারটার উদ্ভব ঘটেছে। এদের মধ্যে গর্ভধারণ প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু  সাধারণ বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়। এদের সবারই ভ্রুণ জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের দেওয়ালের অনেক গভীরে গিয়ে প্রোথিত হয়, যেখানে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে ভ্রুণ জরায়ুর গায়ে হাল্কাভাবে লেগে থাকে। তাই হয়তো জরায়ুকে রক্ষা করার জন্য গর্ভধারণের আগেই আমাদের এন্ডোমেট্রিয়ামের দেওয়াল পুরু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় যেটা অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে ঘটে শুধুমাত্র গর্ভধারণের পরে।

 

গর্ভধারণে কোন সমস্যা দেখা দিলে অন্যান্য প্রাণীরা খুব সহজেই প্রাকৃতিকভাবে গর্ভপাত করে ফেলতে পারে কিন্তু মানুষের ভ্রুণ প্ল্যাসেন্টার মাধ্যমে মায়ের রক্তনালীর সাথে এত সরাসরি এবং  জোরালোভাবে যুক্ত থাকে যে বড় রকমের রক্তক্ষয় ছাড়া গর্ভপাত সম্ভব নয়। এ-কারণেই মানুষের ভ্রুণ আবার সোজাসুজি মায়ের দেহ থেকে যথেচ্ছা পুষ্টিও শুষে নিতে পারে, ফলে গর্ভধারণের সময় অনেক মায়েরই উচ্চ রক্তচাপ, দুর্বলতা বা ডায়াবেটিসের মত বিভিন্ন রোগও দেখা দেয়।এই সব মিলিয়ে মানুষের জন্য গর্ভধারণ একটা খুব বিপজ্জনক এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। তাই সে শুধুমাত্র সুস্থ এবং সঠিকভাবে নিষিক্ত ভ্রুণকেই জটিল এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জরায়ুর দেওয়ালে প্রোথিত হয়ে ঠিকমত বেড়ে উঠতে দেয়। আর এখান থেকেই হয়তো মাসিকের বিবর্তন ঘটেছে, যাতে করে এই কঠিন পরীক্ষায় পাশ না-করলে যেকোনো দুর্বল, সমস্যাযুক্ত অসুস্থ ভ্রূণকে সে এন্ডোমেট্রিয়ামের দেওয়ালসহ ঠেলে বের করে দিতে পারে গর্ভধারণের আগেই।

 

অর্থাৎ, মাসিকের সময় এই রক্তপাতের ব্যাপারটা,গর্ভধারণ এবং বংশবৃদ্ধি, মানে আমাদের প্রজনন-প্রক্রিয়ার আবশ্যকীয় একটা অংশ এবং আমাদের সমগ্র প্রজাতির অস্তিত্বই নির্ভর করে আছে এর উপর। গর্ভধারণ যদি কোন লজ্জাকর বিষয় না হয় তাহলে এই মাসিকই বা এত লজ্জার বিষয় হবে কেন?আমরা আগেকার দিনে যখন এই মাসিক সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, ওদিকে আবার মেয়েরাও ঘরের ভিতরে থাকতো, তখন না-হয় এই নিয়ে হাজারো কুসংস্কার, ভীতি, লজ্জা বা লুকোছাপার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এখনো কেন আমরা সেই অজ্ঞানতার ফসল বয়ে বেড়াচ্ছি? তাই এখন সময় এসেছে সামাজিকভাবে এই মাসিককে সাধারণ একটি শারীবৃত্তিক ব্যাপার হিসেবেই গ্রহণ করার। আর সে-কারণেই শুধু মেয়েদের জন্যই নয় প্রতিটি পুরুষেরও উচিত এ-সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা এবং সমাজের ট্যাবুগুলো ভাঙতে সাহায্য করা।


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles