মিশরের পিরামিড কারা বানিয়েছিল? পিরামিড রহস্য! | Pyramids | Think Bangla

.

প্রাচীন একটি আরবি প্রবাদ আছে, “মানুষ ভয় পায় সময়কে, আর সময় ভয় পায় পিরামিডকে”।হ্যাঁ, সেই রহস্যাবৃত পিরামিড, যা মনে করিয়ে দেয় নীল নদের তীরে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার কথা, যার চিন্তা এবং কাজ যুগ যুগ ধরে বিস্মিত করে এসেছে মানুষকে। আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বহু আগেই কীভাবে নির্মাণ করা হয়েছিলো এরকম আশ্চর্যজনক ও বিশাল সব স্থাপত্য? প্রাচীন মিশরীয়রা এত বড় এবং ভারি পাথরখণ্ডগুলো বয়ে এনেছিলেন কীভাবে এতো দূর?  খাঁজে খাঁজে মেলানোর জন্য এত সূক্ষ্মভাবে তাদের কেটেছিলেনই বা কীভাবে? বা এতটা উঁচুতে কেমন করে উঠানো হয়েছিল তাদের? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন: কারা বানিয়েছিলেন এই পিরামিডগুলো, কেন? বছরের পর বছর ধরেই এই প্রশ্নগুলো ভাবিয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক, স্থাপত্যবিদ ও নৃতাত্ত্বিকদের। 


তারা যে শুধু এরকম হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তাইই নয়, সেই সাথে তৈরি করেছে ভিনগ্রহের প্রাণী বা এলিয়েনদের ধারণার, টাইম মেশিনে অতীত পরিভ্রমণ বা কালোজাদুবিদ্যার মত  নানারকমের ভ্রান্ত ধারণা ও উপকথারও।পিরামিড সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাসের লেখায়। তাঁর বর্ণনা অনুসারে এতদিন মনে করা হতো হাজার হাজার ক্রীতদাসদের দিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো পিরামিডগুলো। একারণেই প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের তৈরি এই অতিকায় পিরামিডগুলো পরিচিতি পায় মিশরীয় রাজা ফারাওদের নির্যাতন ও শোষণের প্রতীক হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পিরামিড নির্মাণের কাজ চলেছিলো মাত্র কয়েকশ বছরের মত, যদিও মিশরীয় সভ্যতার মোট বয়স ছিলো প্রায় তিন হাজার বছর!


মিশরে ছোটোবড় মিলিয়ে প্রায় একশোরও বেশি পিরামিড পাওয়া গেছে। আমরা যখন পিরামিডের কথা বলি তখন মূলত গিজার পিরামিডগুলোর কথাই চিন্তা করি, কিন্তু পিরামিড বানানোর শুরু সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ শতাব্দীর দিকে। সাকারায় বানানো ফারাও জোসের (Djoser) পিরামিডকে প্রথম পিরামিডগুলোর একটা হিসেবে ধরা হয় যেটা তৈরি করা হয়েছিলো বিখ্যাত সেই গিজার খুফুর পিরামিডের প্রায় একশো বছর আগে। সেটা দেখতে কিন্তু ঠিক গিজার পিরামিডের মত ছিলো না, বরং ছিলো ধাপে ধাপে উপরে উঠে-যাওয়া সিঁড়ির আকৃতির! আর এর ৮২ ফুট গভীরে তৈরি করা হয়েছে ফারাও জোসের (Djoser) সমাধি। এর পরে আস্তে আস্তে মিশরীয়রা তৈরি করতে শুরু করে আরো নিখুঁত আকৃতির পিরামিডগুলো যার মধ্যেই রয়েছে গিজার সেই বিখ্যাত তিনটি পিরামিড।


সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত হচ্ছে গিজার এই খুফু-র পিরামিড। এর প্রকৃত উচ্চতা ছিল ৪৮১ ফুট যা আজকের ৫০ তালা বিল্ডিংয়ের চেয়েও উঁচু! বিভিন্ন গবেষণা থেকে ধারণা করা হয়, প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ হাজার পাথর-খোদাইয়ে দক্ষ রাজমস্ত্রী একটানা প্রায় বিশ বছর সময় ধরে কাজ করেছিলেন। প্রায় ২৩ লক্ষ বিশালাকার যেসব পাথরখণ্ড দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল তাদের একেকটির ওজন ছিল গড়ে ২ থেকে ১৫ টন পর্যন্ত। পিরামিডের  বাইরের আস্তরণ ছিলো উজ্জ্বল চুনাপাথর দিয়ে আবৃত। সূর্যের প্রতিফলনে মসৃণ, উজ্জ্বল ও চকচকে পিরামিডকে দূর থেকে দেখলে মনে হতো দৈত্যাকৃতির কোন রত্ন যেন।পিরামিড এবং সমাধিগুলোকে পাহারা দেয়ার জন্য গিজায় তৈরি করা হয়েছিল স্ফিংস নামে বিশাল এক দানবীয় সেই মূর্তি, যার মুখ ছিলো মানুষের মত, দেহ সিংহের এবং পাখা ঈগলের মত। 


কেন পিরামিড বানানো বন্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ করে তা নিয়ে মিশর-বিশেষজ্ঞরা এখনো একমত হতে পারেননি। তবে খুব সম্প্রতি গবেষক ও প্রকৌশলী পিটার জেমস বলেন যে এর খুব সম্ভাব্য কারণ ছিলো তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাব। মরুভূমিতে তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে পাথরখণ্ডগুলো সম্প্রসারিত ও প্রসারিত হয়ে যেতো, যার কারণে দেয়ালে ফাটল ধরতো এবং চুনাপাথরের আস্তরণগুলো খসে পড়তো। তাই হয়তো পরবর্তীতে পিরামিড বানানো বাদ দিয়ে মিশরের সম্রাটদের সমাধি তৈরি করা হয় শুরু হয় Valley of Kings বা রাজ উপত্যকায়। আবার ওদিকে কিভাবে বিরাট পাথরগুলোকে দূর থেকে বয়ে এনে এই অতিকায় স্থাপত্য তৈরি করা সম্ভব হলো,এই রহস্য জন্ম দিয়েছে নানা মতবাদের। তবে ডাচ প্রফেসর ড্যানিয়েল বনের নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রাচীন মিশরীয় চিত্রকর্মের ভেতরে খেয়াল করে দেখেন শ্রমিকরা স্লেজের মতো করে কিছু টেনে নিচ্ছে এবং বালিতে পানি ঢালা হচ্ছে যেন এই পথ দিয়ে পাথরগুলো সহজে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। ইজিপ্টোলজিস্ট Mark Lehne পিরামিডের খুব কাছেই আবিষ্কার করেন প্রাচীন নালা এবং জলপ্রবাহের চিহ্ন, যা থেকে ধারণা করা হয় পাথরগুলো বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিলো জলপথে নৌকা দিয়ে! এদের পিরামিডের এত ওপরে কিভাবে ওঠানো হয়েছিল ক্রেন ছাড়া সে-নিয়েও অনেক মতভেদ আছে। 


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন প্রাচীন মিশরীয়রা এত অমানুষিক পরিশ্রম করে তৈরি করেছিল এই পিরামিডগুলো? এর উত্তর লুকিয়ে আছে পিরামিডের ভেতরে এবং গোপন কুঠুরি থেকে উদ্ধার করা প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক লিপির ভেতর। প্রাচীনকালে মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মানুষ মারা গেলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না বরং এরপরও তাদের আত্মার লম্বা আরেকটা জীবন থাকে। মিশরের ফারাওদের দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। তাই তারা মারা গেলে তাদের দেহকে মমি করে রাখা হতো এবং সেই মমিগুলো সংরক্ষণের জন্য তারা বানিয়েছিল পিরামিডের এই বিশাল বিশাল সব সৌধ। মৃত্যুর পর যাতে ফারাওরা অন্যদেরও পরবর্তী জীবনে যেতে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং যেন কোনো কষ্ট না হয় সেজন্য তাঁদের সাথে দিয়ে দেয়া হত অসংখ্য ধনসম্পদ, দাস-দাসী, আসবাবপত্র ও নানা ব্যবহার্য সামগ্রী। আমরা মানুষেরা কত কিছুই না বিশ্বাস করে এসেছি অনাদিকাল ধরে! 


গিজার পিরামিড থেকে পাওয়া গেছে সূর্য প্রতীক সম্বলিত একটি নৌকা। যেহেতু প্রাচীন মিশরীয়রা জন্মান্তরে বিশ্বাসী তাই ধারণা করা হয়, অন্ধকারের দেবতা আপেপের সাথে সূর্যদেবতা রা-এর লড়াইয়ে যেন সঙ্গ দিতে পারেন ফারাও, তাই এই নৌকা রাখা হয়েছিল। প্রচলিত বিশ্বাসমতে, প্রতি রাতে এই নৌকা দিয়ে ফারাও যুদ্ধ করতে যান আপেপের সাথে, ভোরবেলায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে।খুব সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা থেকে আমরা শেষ পর্যন্ত এই পিরামিড নির্মাতাদের সম্পর্কেও পরিষ্কার কিছু ধারণা পেতে শুরু করেছি। গিজার পিরামিডের পাশে খুঁজে পাওয়া যায় পিরামিড নির্মাতাদের সমাধি। তাঁদের দেহাবশেষের উপর ফরেনসিক ও প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় শ্রমিকরা কেউ আসলে বাইরের নন। এছাড়া অনেকের দেহে পাওয়া গেছে ভাঙ্গা হাড় সারিয়ে তোলার এবং সেসময়ের উন্নত চিকিৎসার চিহ্নও। শুধু তাই নয়, তাঁদের সমাধিতে পাওয়া গেছে গরুর মত বহু পশুর হাড় যা সেই সময়ের মিশরে বিলাসী খাবার হিসেবেই গণ্য করা হতো। এসব সুযোগ সুবিধা তো দাসদের পাওয়ার কথা নয়!


এ-থেকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, পিরামিডের প্রস্তুতকারকেরা ছিলেন দক্ষ নির্মাতা, তাঁরা কেউই বাইরে থেকে আনা দাস ছিলেন না। তাঁরা মিশরেরই ছিলেন এবং আশেপাশের এলাকা থেকেই আসতেন। পিরামিডের আশেপাশেই ছিল স্থানীয় শ্রমিকদেরও থাকার জায়গা। এই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি গ্রাম। এখন আমরা জানি যে, দাসদের দিয়ে পিরামিডগুলো বানানো হয়নি। কিন্তু তারপরও স্বীকার করতেই হয় যে, ক্ষমতাধরদের স্বার্থ এবং খেয়াল খুশির জন্য হাজার হাজার সাধারণ জনগণ শ্রম এবং জীবন দিয়ে আসছেন সেই তথাকথিত মানব সভ্যতার শুরু থেকেই। তারই নিদর্শন এই পিরামিডগুলো। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিললেও পিরামিডের ভিতরের অসংখ্য সুড়ঙ্গ, গোপন কুঠুরির ভেতরের রহস্য এখনও অমীমাংসিত। শুধু পিরামিডই নয়, প্রাক্তন ফারাওদের সংরক্ষিত মমিগুলোও আরেক বিস্ময়। যেমন ফারাও রাজত্বের কনিষ্ঠতম শাসক তুতেনখামেনের কথাই ধরুন না। তাঁর মমিসহ সমাধি আবিষ্কারের পরে ঘটে নিদারুণ কিছু ঘটনা। সেখান থেকেই আবার 'ফারাওদের অভিশাপ' নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনা, গুঞ্জন শুরু হয়। তবে মিশরের মমি নিয়ে সেসব গল্পগুলো না হয় তোলা থাক অন্য আরেকদিনের জন্য!

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles