চারদিকে লাল বালির মহাসমুদ্র, পাহাড়, পাথর, মাটি সবকিছু লাল। একজন নভোচারী প্রাণপণে ছুটছে, পেছনে ধেয়ে আসছে অদ্ভুত কোনো মহাজাগতিক প্রাণী, হ্যাঁ, সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস বা সিনেমায় খুব সাধারণ একটি বিষয় এই মঙ্গল গ্রহ। প্রতিবেশী এই গ্রহটিকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ ও কৌতূহলের শেষ নেই সেই প্রাচীন কাল থেকেই। প্রাচীন রোমক, গ্রিক বা ভারতীয়েরা আকাশের এই লাল গ্রহটাকে দেখেছে যুদ্ধদেবতা হিসেবে, শক্তির প্রতীক হিসেবে। তবে এখন, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে, সেই কৌতূহল আর শুধু স্বপ্ন বা রূপকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অজানাকে জানার বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের প্রজাতির। চাঁদের বুকে পা রেখে আজ আমরা পরিকল্পনা করছি মঙ্গল জয় করার এবং ধীরে ধীরে সেখানে বসতি স্থাপনেরও। পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহে আমরা সশরীরে কিভাবে আসা যাওয়া করব সেটা এখনো একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ, তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা বোধ হয় অ-বসবাসযোগ্য এই গ্রহের চরম প্রতিকূল পরিবেশ যেখানে প্রাকৃতিকভাবে নিশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত সম্ভব নয় !
সেই সত্তরের দশক থেকে চলছে মঙ্গল জয় করার পরিকল্পনা এবং চেষ্টা, ছয়টি রোভার বা রোবটযান পাঠানো হয়েছে এর মধ্যেই। এখনো সেখানে মানুষের পা না-পড়লেও এই মিশনগুলো থেকেই গ্রহটি সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে পারছি। নাসার পাশাপাশি প্রায় দুই দশক ধরে গবেষণা করে যাচ্ছে প্রাইভেট কোম্পানি স্পেস এক্স। মঙ্গলে মানুষ পাঠানোই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা নয়, তারচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। চাঁদের দূরত্ব ও অভিকর্ষ অনেক কম থাকায় তেমন ঝামেলা হয়নি। কিন্তু মঙ্গল অভিযানে এই বিশাল দূরত্ব পাড়ি দেয়া ও মঙ্গলের অভিকর্ষ অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি এবং এই জ্বালানি পরিবহনের জন্য দরকার বিশাল বড় রকেট বা মহাকাশযান। স্পেস এক্স মঙ্গলে পাঠানোর জন্য একটি Big Falcon Rocket বা BFR নামের বিশাল এক পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরি রকেট বানাচ্ছে যা এর আগে তৈরি সবচেয়ে বড় রকেট স্যাটার্ন-৫-এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ভার বইতে পারবে। এর ১০০ থেকে ১৫০ টনের পে-লোড বা বহন ক্ষমতার একটা বড় অংশই ব্যয় হয়ে যাবে শুধু জ্বালানি বহন করতে। এত বেশি জ্বালানি নিয়েও সে মাধ্যাকর্ষণ পেরিয়ে যেতে পারবে নিম্নকক্ষপথ পর্যন্ত! তাই বাকি পথের জন্য তাকে পৃথিবী থেকে পাঠানো আরেকটি রকেট থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে হবে এবং তারপরে Big Falcon রওনা হবে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে, ঘন্টায় এক লাখ কিলোমিটারের উপরে গতিতে!
মঙ্গলে আবার চাইলেই যে কোনো সময় রকেট পাঠানো যায় না। পৃথিবী এবং মঙ্গল সূর্যের চারদিকে ঘোরে তাদের কক্ষপথে নিজস্ব গতিতে এবং গ্রহ দুটি একে অন্যের সবচেয়ে কাছাকাছি আসে প্রায় ২৬ মাস পর পর। আর এটাই হচ্ছে রকেট পাঠানোর জন্য সবচেয়ে ভালো সময়! এত কাছাকাছি আসার পরও মঙ্গলে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় চার মাস (১১৫ দিন)! সময়মত যাত্রা শুরু করতে না পারলে আবার অপেক্ষা করতে হবে সেই ২৬ মাস!স্পেস এক্সের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মানুষ বহনের দুই বছর আগেই, ২০২২ সালে, প্রেরণ করা হবে জ্বালানি উৎপাদনের সরঞ্জামসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদ ও যন্ত্রপাতি বহনকারী দুটি রকেট। এতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হবে মিথেন/অক্সিজেনের সমন্বয় যা কম খরচে উৎপাদন করা তো যায়ই, পাশাপাশি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই অক্সাইড ও ভূপৃষ্ঠের ভিতরের পানি থেকে এটি সেখানেই উৎপাদন করা যাবে! এর ফলে এখনকার সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা, ফিরে আসার জন্য জ্বালানি কোথায় পাওয়া যাবে, তার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।এতো গেল না হয় কীভাবে আমাদের প্রতিবেশি এই গ্রহে আসা যাওয়া করা যাবে তার প্ল্যান। এবার চলুন দেখা যাক মঙ্গল গ্রহে বসবাসের জন্য প্রতিকূল পরিবেশের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা হবে কী করে।
মঙ্গল পৃথিবীর মত একই সময়ে সাড়ে চারশ' কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়। এর মাটি, পাথর এবং ধূলার অক্সিডাইজেশনের কারণে একে দেখতে লাল দেখায়। এর বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব পৃথিবীর ১ শতাংশেরও কম। বায়ুতে অক্সিজেন নেই, বরং কার্বন-ডাইঅক্সাইড রয়েছে ৯৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, এই পাতলা বায়ুমণ্ডল সূর্যের ক্ষতিকর রেডিয়েশন বা বিকিরণ বাধা দেওয়ার জন্যও যথেষ্ট নয়। মঙ্গলে সাপের মত এঁকেবেঁকে যাওয়া শুকনো নদী এবং হ্রদের চিহ্ন বলে দেয় যে এখানে আগে পানির অস্তিত্ব ছিল। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে ভূগর্ভে সেই হারিয়ে যাওয়া পানির সন্ধান মিলবে। তার মেরু পৃথিবীর মত বরফে-ঘেরা।মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ আবার পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ, তাই পৃথিবীতে ১০০ পাউন্ডের ওজনের কারো ওজন মঙ্গলে গিয়ে হয়ে যাবে ৩৮ পাউন্ড, এবং এটা মানুষের স্বাভাবিক পেশিগঠনেরও অন্তরায়। মঙ্গলের দিন হয় ২৪ ঘন্টা ৩৯ মিনিটে। পৃথিবীর মত সেও কিছুটা হেলে থাকে বলে সেখানেও বিভিন্ন ঋতু আছে, তবে উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কারণে বছর পৃথিবীর প্রায় দুই গুণ। খুব খুব ঠান্ডাও সেখানে। তাপমাত্রার বিস্তার বেশ বড় হলেও গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে।
তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন যে মঙ্গল ঠিক আমাদের গ্রহের মত নয়। তবে প্রাথমিকভাবে বসবাসের জন্য বহু প্রতিকুলতার সম্মুখীন হলেও ধীরে ধীরে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেমন ধরুন, মাটির নিচে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে বা পরিকল্পনা করা হচ্ছে মাটির উপরে ডোম দিয়ে ঘেরা পরিবেশ-নিয়ন্ত্রিত বাসস্থান বানানোর। পানি আসবে মেরুর বরফ বা ভূগর্ভস্থ পানি থেকে, অক্সিজেন আহরণ করা যাবে গ্রহের কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে, প্রাথমিকভাবে পৃথিবী থেকে নিয়ে যাওয়া গাছপালা বড় হবে গ্রিন হাউসের ভিতরে আর সোলার প্যানেল থেকে তৈরি করা হবে বিদ্যুৎ আর ওদিকে মিথেন গ্যাস দিয়ে চালানো হবে বিভিন্ন ইঞ্জিন। মঙ্গলপৃষ্ঠে বিচরণ করার সময় বিশেষ পোশাক ব্যবহার করে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস এবং সূর্যের বিকিরণ এড়ানো সম্ভব হবে।প্রথমে খুব ছোট কোন বসতি বা বেস বানানো হবে আর সেখান থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে বসতি, শহর, আরো বড় শহর।
এখন মানুষ পাঠানোর পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে গত বছর জুলাইয়ে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে নাসার পঞ্চম এবং সবচেয়ে উচ্চপ্রযুক্তির রোভার পারসেভিয়ারেন্স। এই তো এমাসেই ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করবে। কাঠামোগত দিক থেকে এতে রয়েছে সম্পূর্ণ অভিনব কিছু অবতরণ বৈশিষ্ট্য যেগুলো আগে ব্যবহারের সুযোগ ছিল না।সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যটির কথাই প্রথমে বলি: পারসেভিয়ারেন্স-এর নিচের দিকে প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলকভাবে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে একটি হেলিকপ্টার। ইনজেনুইটি নামের দুই রোটরের ছোট এই হেলিকপ্টার অনেকটা প্রচলিত খেলনা হেলিকপ্টারের মতই কাজ করবে। এত পাতলা বায়ুমণ্ডলে হেলিকপ্টার উড়বে কিনা এ নিয়ে এখনো সন্দেহ আছে। যদি না ওড়ে তাহলে তেমন ক্ষতি নেই আর উড়লে সেটা ভবিষ্যতে মঙ্গলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যারই সমাধান করে দেবে।আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে Terrain Relative Navigation বা TRN যার মাধ্যমে রোভারটি বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে অবতরণের সময় মঙ্গলের ভুমি স্ক্যান করে সামনের সব বাধা-বিপত্তি পাশ কাটিয়ে ঠিকমত সমতল ভূমিতে অবতরণ করতে পারবে। আবার রেঞ্জ ট্রিগারের মাধ্যমে পারসেভিয়ারেন্সের প্যারাশুটটি যথাযথ সময়েই খুলবে যেন এটি কাঙ্ক্ষিত অবতরণ বিন্দুর খুব কাছাকাছি নেমে আসতে পারে।
গ্রহের ভূমিরূপ, শিলার গঠন, কিংবা মঙ্গলের ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনা যেমন অণুজীবের উপস্থিতির সম্ভাবনা কিংবা পানির প্রবাহ ইত্যাদি আবিষ্কারের চেষ্টার সাথে সাথে পারসেভিয়ারেন্স মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের ৯৫% কার্বন-ডাই অক্সাইড থেকে মানুষের জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিষ্কাশনের জন্য পরীক্ষা করে দেখবে একটি নতুন প্রযুক্তি। অবতরণ করবে কয়েকশ’ কোটি বছর আগে একটি উল্কার আঘাতে সৃষ্টি হওয়া জেজেরো (Jezero) ক্রেটারে, যেটি একসময় পানিতে ভরা একটি হ্রদ ছিল। উল্কার আঘাতে তৈরি এই হ্রদ প্রাণের বিকাশের জন্য বেশ অনুকূল। পারসেভিয়ারেন্স সেখানে সম্ভাব্য প্রাণের অস্তিত্বও খুঁজে দেখবে।
দেখাই যাচ্ছে ইলন মাস্কের স্পেস এক্স বেশ তোড়জোড় প্রস্তুতি শুরু করেছে ২০২৪-এর মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠাবার জন্য।তবে অনেকেই এখনো নিশ্চিত নন এত তাড়াতাড়ি মঙ্গলে পা রাখা আসলেই সম্ভব হবে কিনা আমাদের। এখনো নভোচারীদের উপর যাত্রার সময় এবং মঙ্গলের পৃষ্ঠে কসমিক বিকিরণের কারণে ক্ষতির ব্যাপারটা সমাধান করা যায়নি। এছাড়া আরেকটি প্রশ্নও রয়েছে যে, মঙ্গলে পৌঁছানোর পরে ফিরে আসার জন্য অন্ততপক্ষে ছয়মাস অপেক্ষা করতে হবে। প্রথম যাত্রায় এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকার জন্য সবকিছু কি থাকবে তাদের হাতের কাছে? এই প্রশ্নের উত্তর মনে হচ্ছে আমরা পেয়ে যাব এই দশকের মধ্যেই।