২০০৪ সালে সুমাত্রার কাছে হওয়া ৯.৩ মাত্রার
ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল জাপান,
ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা থেকে আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত। সারা পৃথিবী নাকি সেদিন এক সেন্টিমিটার কেঁপে উঠেছিল! এই
ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইন্দোনেশিয়ার কাছে সমুদ্রগর্ভের
৩০ কিলোমিটার নিচে, এবং তা থেকে তৈরি ৩০ মিটার উঁচু সুনামির ঢেউয়ে মারা
গিয়েছিল ২ লাখেরও বেশি মানুষ। এটি ছিল আমাদের রেকর্ড করা ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে
তৃতীয় শক্তিশালী।
ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে সম্ভবত
সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক!
কতটা মারাত্মক?
১৯৯৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এই ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী
প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ ভূমিকম্পে মারা গিয়েছে। এই সংখ্যাটি একই সময়ে ঘটা সবগুলো
প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। সম্পত্তির বিশাল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও
সাড়ে বারো কোটি মানুষ আহত এবং স্থানচ্যুত হয়।
পৃথিবীতে এমন কোনও মহাদেশ নেই যেখানে ভূমিকম্প
হয়না। তবে তুলনামূলকভাবে কিছু অঞ্চলে মারাত্মক ভূমিকম্পগুলো বেশি হয়।
কেনই বা সেসব জায়গায় ভূমিকম্পের এত প্রকোপ? কীভাবে ভূমিকম্প ঘটে এবং তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে? এর সাথে সুনামিরই বা কী সম্পর্ক? আজকে সিরিজের প্রথম ভিডিওতে, থিংকের বন্ধু ড. হাবিবুর রহমানের সাথে জেনে নেব এই প্রশ্নগুলোর উত্তর। পরবর্তী ভিডিওগুলোতে আমরা ধীরে ধীরে জানবো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস ও ক্ষয়ক্ষতি রোধ বা কমানোর উপায়, এবং বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভূমিকম্প সম্পর্কে।
ভূমিকম্প -- ভূমির কাঁপন। আমাদের পায়ের নীচের ভূমি
কিন্তু সারাক্ষণই কমবেশি কাঁপছে। রেললাইনের ট্রেন যাওয়ার সময় আমাদের পায়ের তলার
মাটি একটু কেঁপে ওঠে বা ভারী জিনিস উঁচু থেকে পড়লেও মাটি কাঁপে। আক্ষরিক অর্থে
ভূমির কাঁপন হলেও এরা কিন্তু ভূমিকম্প নয়।
তো, ভুমিকম্প হল বিশেষ কিছু প্রাকৃতিক কারণে ঘটা
ভূমির তীব্র কাঁপন যা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে অনুভব করি আমরা।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাত, গ্রহাণু এবং
উল্কাপিন্ডের আঘাতেও ভূমিকম্প ঘটতে পারে।
তবে সবচেয়ে তীব্র ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পগুলোর কারণ
লুকিয়ে আছে ভূত্বকের পাত সঞ্চালন বা plate tectonics-এর মধ্যে। এই পাত সঞ্চালন
সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম থিংকের ‘মহাদেশ কিভাবে ভাঙ্গছে গড়ছে’ ভিডিওটিতে।
দেখেছিলাম আমাদের ভূত্বকের সবচেয়ে উপরের স্তরে যে লিথোস্ফিয়ার বা অশ্মমণ্ডল
আছে তা বেশ কয়েকটা টুকরোয় বিভক্ত। এরকম প্রতিটি ভাঙা অংশের নাম হচ্ছে পাত বা প্লেট
যারা অনবরত সরছে।
এরকম দুটো পাতের মধ্যকার সীমানা বা discontinuity-কে বলা হয় ফাটলরেখা বা fault line.
মোটামুটি এই ফাটলরেখা ধরে অনেকগুলো কমবেশি লম্বা ফাটল থাকে ।
পাত সঞ্চালনের ফলে পাতগুলো ফাটলরেখা বরাবর কোথাও
কোথাও একটা আর একটার ওপর উঠে যাওয়ার জন্য চাপে থাকে, আবার কোথাও আনুভূমিকভাবে
পিছলে সরে যাওয়ার জন্য চাপে থাকে। শিলার ঘর্ষণ এবং ভাঙ্গন প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে
বলেই কিন্তু এই চাপের সৃষ্টি হয়। পাতের এই সঞ্চালন যেহেতু চলতেই থাকে, তাই
ধীরে হলেও এই চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, ফলে এক সময় তা শিলার প্রতিরোধ ক্ষমতার বাইরে
চলে যায়।
আর তখনই ভেঙ্গে যায় শিলাগুলো, উঠে যায় একটা পাত আর
একটার ওপর বা পিছলে সরে যায় আনুভূমিকভাবে।
আমাদের পায়ের নীচের বিশাল সব শিলাখন্ডের এই হঠাৎ
স্থানচ্যুতি থেকে মুক্তি পায় অনেকদিনের জমে থাকা বিশাল পরিমাণ energy
বা শক্তি! ফলে কেঁপে ওঠে মাটি, ঘটে ভূমিকম্প!
এ কারণেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এবং বড় ভূমিকম্পগুলো
ঘটে ভূত্বকের পাতগুলোর ফাটলরেখা ধরে। এই যে Mid Atlantic ভূশিরা, Alpide
belt বা Circum Pacific Belt বরাবর। সে কারণেই আমরা আইসল্যান্ড, নেপাল, জাপান
বা ইন্দোনেশিয়ার মত দেশগুলোতে বড় বড় ভূমিকম্প ঘটতে দেখি।
এই মুক্তি পাওয়া শক্তির উপরই নির্ভর করে
ভূমিকম্পটি কতটা গুরুতর হবে। শিলার ভাঙ্গন বা পিছলে যাওয়া যত লম্বা এবং চওড়া জায়গা
জুড়ে ঘটবে, এবং যত বড় হবে স্থানচ্যুতি, তত বেশি হবে এই মুক্তিপ্রাপ্ত শক্তি, আর
ততই বেশি মাত্রার এবং সুদূরপ্রসারী হবে ভূমিকম্পটি।
১৯৬০ সালে চিলিতে ঘটা পৃথিবীর এপর্যন্ত সবচেয়ে বড়
ভূমিকম্পটি যে ভাঙ্গনের জন্য ঘটেছিল সেটা ছিল ১৬০০ কিলোমিটার লম্বা আর ২৪০
কিলোমিটার চওড়া। চোখ বুজে একটু কল্পনা করুন কি বিশাল পরিমাণ হতে পারে এই ভাঙ্গন
থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত শক্তি!
তবে ভূমিকম্পের ফলে কতটা ক্ষতি হবে তা শুধু এর
মাত্রার উপর নির্ভর করে না। চিলির ভয়ানক এই ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল
আনুমানিক ১৬৫০ জন, অথচ ২০১৫ সালের নেপালে ঘটা ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল
আনুমানিক ৯০০০ জন।
আবার ওদিকে ১৯৬৪ সালের আলাস্কার ৯.২ মাত্রার
ভূমিকম্পে - যাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয় - বিশাল এলাকা
জুড়ে ক্ষতি হলেও - এত বেশি মানুষ মারা যায়নি।
তো, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে ভূমিকম্পের
আওতায় জনবসতি কতখানি প্রধানত তার ওপর।
এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ভূমিকম্প যেখানে সৃষ্টি
হয়, সেই এপিসেন্টার বা কেন্দ্রবিন্দু থেকে চারদিকে তা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে?
একটা ফাটলরেখায় ভুমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে মুক্তিপ্রাপ্ত শক্তি ভূত্বকের শিলার মাধ্যমে চারিদিকে ঢেউয়ের মত ছড়াতে শুরু
করে, যেমনটি হয় জলে একটি ঢিল পড়লে।
তবে জলে এক ধরণের ঢেউই হয়, যা জলপৃষ্ঠকে ওঠানামা
করায়। কিন্তু ভূমিতে ছড়ায় চার ধরনের ঢেউ।
প্রথমটি হল P-wave (pressure or primary wave)
- এই ঢেউটি শিলাকে ঝাঁকায় সে যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই বরাবর, এবং ছড়ায়
সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ।
দ্বিতীয়টি হল S-wave (shear or secondary wave) -
এখানে ঢেউটি যেদিকে এগুচ্ছে তার আড়াআড়িভাবে শিলাকে ঝাঁকায় এবং P-wave এর চেয়ে বেশ
খানিকটা কম গতিতে ছড়ায়।
P এবং S wave ভূত্বকের গভীর অংশ দিয়ে ছড়ায় এবং
পৌঁছায় অনেকদূর পর্য্যন্ত। এই P-wave এমনকি পৃথিবীর কোর বা কেন্দ্রের মধ্য দিয়েও
এগোতে পারে।
তিন নম্বর ঢেউটি হল Love wave। নাহ,
ভালবাসার ঢেউ নয়!
ভূমিকম্প ভালবাসার ঢেউ ছড়িয়ে দিলে একদিক দিয়ে
কিন্তু মন্দ হত না, কী বলেন?
যাই হোক, ঢেউটির নাম হয়েছে
বৃটিশ গণিতবিদ A.E.H. Love-এর নামে যিনি একে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন।। এই Love wave- S-wave এর মতই ছড়ায় তবে ভূপৃষ্ঠেই
সীমাবদ্ধ থাকে।
আর চতুর্থ রকমের ঢেউ, Rayleigh wave, ভূপৃষ্ঠকে
দোলায় ঠিক পানির ঢেউয়ের মত করেই।
ভূপৃষ্ঠকে আঁকড়ে ধরে থাকা শেষের এই দু’রকমের
ঢেউগুলো অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে ছড়ায় এবং বেশিদূর ছড়াতেও পারেনা। তবে এদের দোলনের
ব্যাপ্তি তুলনামূলকভাবে বড়, এবং সেকারণেই এরা সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক হতে
পারে।
আমরা ভবিষ্যতের আরেকটি ভিডিওতে আরও বিস্তারিতভাবে
দেখে নেব ভূমিকম্পের এই ঢেউগুলো কীভাবে দালান-কোঠা, সেতু ইত্যাদিকে ধ্বংস
করে এবং তা থেকে রক্ষা পেতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
আসুন আজকের আলোচনা শেষে চট করে দেখে নেই এই
ভূমিকম্পের সাথে সুনামির কী সম্পর্ক।
ভিডিওর শুরুতে দেখেছিলাম যে ২০০৪ সালের
ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচের সেই ভয়ানক ভূমিকম্প থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ৩০ মিটার উঁচু
বিধ্বংসী সুনামির।
ভূত্বকের অনেকগুলো পাতের ফাটলরেখার অবস্থানই
সমুদ্রের তলায়। যদি এইসব ফাটলরেখার কোথাও শিলার স্থানচ্যুতি ঘটে, মানে, যদি
ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়, তাহলে সমুদ্রের পানি সেখানে ভীষণভাবে ঝাঁকানি খায় - সৃষ্টি
করে বিশালাকার ঢেউ। আর সেই ঢেউগুলো যখন তীরে আছড়ে পড়ে তখনই হয় আচমকা প্লাবন
সুনামি। সমুদ্রের নীচের আগ্নেয়গিরি বা অন্য কোন বিস্ফোরণ থেকেও সুনামি তৈরি হতে
পারে।
রেকর্ড রাখতে শুরু করার পরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়
সুনামি ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে আলাস্কার ফেয়ারওয়েদার ফল্ট বরাবর - সমুদ্রে ৯১৪ মিটারের
বিশাল এক শিলাখন্ড পড়ে সৃষ্টি করেছিল ৫২৪ মিটার উঁচু অবিশ্বাস্য এক ভয়ংকর
সুনামির।
ভবিষ্যতে সুনামি নিয়ে আরো বিস্তারিতভাবে
জানব থিংকের আরেক ভিডিওতে।
এছাড়া বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যে ভূমিকম্প
হচ্ছে তার কারণ, বড় ভূমিকম্পের কোন সম্ভাবনা এবং প্রভাব কীরকম হতে পারে এবং
সেইসাথে ভূমিকম্প কীভাবে মাপা হয়, কীভাবে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়
এবং কীভাবে এই ধ্বংসের পরিমান কমানো যায়, ইত্যাদি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনার
ইচ্ছে রইলো ভূমিকম্প সিরিজের পরবর্তী ভিডিওগুলোতে।