কোথা থেকে এলো আমাদের এই মহাবিশ্ব? অগুনতি গ্রহ, তারা, মহাশূন্য? এর শুরু কোথায়? নিশ্চয় প্রথমেই আপনার মাথায় আসলো সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপানো বিগ ব্যাং -এর মহাবিস্ফোরণের কথা, তাই না? কিন্তু, এক্কেবারে সেই আদিতে, সেই বিগ ব্যাং-এর সময়, আদৌ কি এরকম কোনো মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল? আজকের এই ভিডিওতে সেটাই জেনে নেব হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক, থিংক-এর বন্ধু জ্যোতির্বিদ ড. শৌনক বোসের কাছ থেকে। জেনে নেব, আমাদের এই বিপুল মহাবিশ্বের শুরুর কাহিনি, আমরা এই বিগ ব্যাং সম্পর্কে ঠিক কতটা জানি, আর কতটুকুই বা এখনো রয়ে গেছে সম্পূর্ণ অজানা। কোথা থেকে এলাম, আমাদের চারপাশের বিশ্বজগতের উৎপত্তি হল কীভাবে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছি আমরা সেই প্রাচীনকাল থেকে। পৌরাণিক গল্পে, ধর্মগ্রন্থে, দর্শনচর্চায় এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা দেখা যায়। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এর গভীরে ঢোকার শুরু一এই তো一মাত্র গত শতাব্দীতে।
হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দীর প্রথমেও সবাই স্থির বা অপরিবর্তনশীল বিশ্বের ধারণাতেই বিশ্বাস করতেন অর্থাৎ আমরা আজকে যেভাবে দেখছি, আদি থেকে সবকিছু ঠিক সেভাবেই, চিরকাল ধরে, একই রূপে বিরাজ করে আসছে। এটাই তো সবচেয়ে সোজা ব্যাখ্যা, তাই না? তবে বেলজিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এবং ধর্মযাজক জর্জ লেমিত্রি (Georges Lemaître) আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণের উপর ভিত্তি করে ১৯২৭ সালে প্রথম প্রস্তাব করলেন, সম্ভবত আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। না না, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি না। বিগ ব্যাং-এর গল্পের সূচনাটাই ঘটেছিল এ-থেকে। তাই মহাবিশ্বের প্রসারণের ঘটনাটা না বুঝলে বিগ ব্যাং ব্যাপারটাও বোঝা সম্ভব নয়।
তবে, লেমিত্রির প্রকল্পটি তখন কিন্তু তেমন পাত্তাই পেল না বিজ্ঞানী মহলে। এমনকি আইনস্টাইন নিজেই এর বিরোধিতা করে বসলেন। কিন্তু ১৯৩০ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ভেস্টো স্লাইফার এবং এডুইন হাবলের পর্যবেক্ষণ পুরো ঘটনাটাই ঘুরিয়ে দিল। তাঁরা মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে তখনকার সবচেয়ে বড় দুরবিনের সাহায্যে দেখতে পেলেন সবগুলো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে অর্থাৎ, আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, বড় হচ্ছে। আমাদের থেকে বেশি দূরের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথগুলো অপেক্ষাকৃত কাছের ছায়াপথগুলোর চেয়ে বেশি গতিতে সরছে। মানে, যে যত দূরে সে ততই পিছিয়ে যাচ্ছে।
তাহলে এবার পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে আমাদের মহাবিশ্বের জন্মরহস্যের এই চলচ্চিত্রটা রিওয়াইন্ড করলে দেখা যাবে যে-ছায়াপথগুলো একে অন্যের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল তারা এখন কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করেছে, ঘনত্ব, উত্তাপ ও বিকিরণও বাড়ছে অকল্পনীয়ভাবে! এবার আরো অতীতে যেতে থাকুন, যতই সময়ের সেইইই শুরুর দিকে যেতে থাকবেন ততই সবকিছু গিয়ে এক ছোট্ট বিন্দুতে মিলে যেতে শুরু করবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিগ ব্যাং-এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, ১৪০০ কোটি বছর আগে, আমরা আমাদের চার পাশে যা কিছু দেখছি一হ্যাঁ সবকিছু-গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, আপনি, আমি一সবকিছুর উৎস হচ্ছে এই ক্ষুদ্র, পুঞ্জীভূত, অসীম শক্তির এক বিন্দু। এর বৈজ্ঞানিক নামই হচ্ছে ‘সিঙ্গুলারিটি’। আমরা আমাদের কল্পনায় যতটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভেবে নিতে সক্ষম, এই সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টটি তার চেয়েও হাজার হাজার গুণ ক্ষুদ্র। হ্যাঁ, চট করে পুরো ব্যাপারটা বুঝে ওঠা বেশ কঠিনই বটে!
বিগ ব্যাং মডেল বলছে, কোনো এক অবস্থায়, কোনো এক কারণে一যদিও সে কারণটা ঠিক কী ছিল তা আমরা এখনো জানি না一এই 'সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টটি খুব দ্রুত গতিতে প্রসারিত হতে শুরু করে। এর গতি ছিল অকল্পনীয়রকমের দ্রুত, এমনকি আলোর গতির চেয়েও দ্রুত। তবে এরকম একটা খোলনলচে বদলে-দেওয়া, প্যারাডাইম শিফট-করা তত্ত্বটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিজ্ঞানীদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বললেই তো হলো না যে পর্যবেক্ষণ এবং গাণিতিক হিসাব থেকে মনে হচ্ছে এত দিনের লালিত সমস্ত ধারণা ভুল। আমাদের মহাবিশ্ব আসলে স্থির নয়, সেরকম মাপের প্রমাণও তো দিতে হবে এর পক্ষে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিগ ব্যাং নামটাও এই বিজ্ঞানীদের কারো দেওয়া নয়, বরং স্থিতিশীল বিশ্বের মডেলের প্রবক্তা বিজ্ঞানী হয়েল একবার টিটকারি করে এটা বলেছিলেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বিগ ব্যাং কথাটা স্থায়ীভাবে গেড়ে বসে।
যাই হোক, বিগ ব্যাং-এর পক্ষের সবচেয়ে বড় প্রমাণটা এল ষাটের দশকের মাঝামাঝি। আমেরিকার বেল ল্যাবে বিজ্ঞানী পেনজিউস এবং উইলসন দূরপাল্লার যোগাযোগের আরও শক্তিশালী যন্ত্র বানানোর জন্য একটা ২০ ফুট মাইক্রোওয়েভ এন্টেনা বানিয়ে বায়ুমণ্ডলের বেতার বা রেডিও-তরঙ্গ পরীক্ষা করছিলেন। কিন্তু রিসিভার চালানোর সাথে সাথে একটা বাড়তি গুনগুন শব্দ শোনা যেতে লাগলো। বিরক্ত করে ছাড়লো সেই নাছোড়বান্দা গুনগুনানি। দিনের পর দিন ধরে এন্টেনাটা এদিক ওদিক করে, বিভিন্নভাবে চালাকি করে পরীক্ষা করেও কিছুতেই তাকে পিছু ছাড়ানো যাচ্ছে না। ঠিক সেসময়েই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন বিজ্ঞানীর কাজের সাথে সমন্বয় করে বোঝা গেল, এটা “Cosmic Mmicrowave Background Radiation" বা মহাজাগতিক পশ্চাদপট বিকিরণ। এটাই সেই বিকিরণ যা ১৪০০ কোটি বছর ধরে ছড়িয়ে আছে আমাদের সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। তাহলে, ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে?
আম্-ম...ধরুন, আপনি চা পান করছেন, কাপটা প্রথমে খুব গরম ছিল! কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে তা ঠান্ডা হয়ে আসবে। ঠিক সেভাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তির সেই শুরুর দিকে যে অভাবনীয় রকমের উত্তাপ এবং বিকিরণ ছিল সেটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আজ মাত্র শূন্যের ওপর ২.৭ (দুই দশমিক ৭) ডিগ্রিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা আগেই প্রকল্প দিয়েছিলেন যে, বিগ ব্যাং-এর মডেল যদি ঠিক হয়, তাহলে আকাশ স্ক্যান করে, সৃষ্টির সেই শুরুর দিকের ভয়ঙ্কর উত্তাপ এবং বিকিরণের ছিটেফোঁটা হলেও সনাক্ত করা যাবে। বিগ ব্যাং-এর প্রায় চার লক্ষ বছর পরে যখন ইলেকট্রনের ঘনত্ব কিছুটা কমে আসতে শুরু করে তা থেকে মুক্তি পায় আলো। অর্থাৎ ফোটন ইলেকট্রনের সাথে আর ধাক্কা না-খেয়ে বেরিয়ে পড়ে, আর তাকেই আমরা দেখছি আজ মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে। আর ইলেকট্রনেরা প্রোটনের সঙ্গে এক হয়ে তৈরি করেছিল হাইড্রোজেন পরমাণু, তবে সেই গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
ওদিকে আবার এই তাপমাত্রা থেকেই হিসেব করে বের করা যাচ্ছে বিগ ব্যাং-এর পরে কতদিন ধরে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে অর্থাৎ এখান থেকেই আমরা নির্ণয় করতে পারছি এর বয়স। বিজ্ঞানীরা, এর পরে, বহু দূরের গ্যালাক্সির সুপারনোভা বিস্ফোরণের ওপর ভিত্তি করে এও দেখান যে মহাবিশ্ব প্রসারণের বেগ তো কমছেই না, বরং ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিগ ব্যাং এখন আর শুধু একটা ধারণাই নয়, এটা আমাদের মহাজাগতিক উৎসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব। মহাবিশ্ব, মহাশূন্য যে অনবরত প্রসারিত হচ্ছে এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই।
এতক্ষণ তো দেখলাম বিগ ব্যাং তত্ত্ব কী। শেষ করার আগে সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক আমরা এখনো এ সম্পর্কে ঠিক কী জানি না, এবং কি কি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে এ নিয়ে।
সেই যে প্রথমে বলেছিলাম, বিগ ব্যাং এর কথা শুনলেই আমাদের প্রথমেই এক গগনবিদারী বিস্ফোরণের কথা মনে পড়ে, যেন হাজার হাজার মহাশক্তিশালী নিউক্লিয়ার বোমা ফাটছে সমগ্র মহাশূন্য জুড়ে। নাহ, আসলে বিগ ব্যাং-এর সময় এরকম কোন মহাবিস্ফোরণ ঘটেনি। এটা মহাবিশ্বের প্রসারণের প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন, বিগ ব্যাং-কে যদি সময় 0 শূন্য বলে ধরি, তাহলে বিজ্ঞানীরা সেখান থেকে, ১০^-৪৩ (১০ টু দি পাওয়ার নেগেটিভ ৪৩) সেকেন্ড পর্যন্ত কী ঘটেছিল তা এখনো ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কিন্তু, উদ্ভট রকমের ছোটো এই সময়ের হিসেবটা দিয়ে আসলে কী বোঝা গেল?
বোঝা গেল, আমাদের মহাবিশ্বের বয়স এখন ১৩৭০ থেকে ১৩৮০ কোটি বছর, আর আমরা প্রথম এক সেকেন্ডের মিলিয়নের দশ ভাগের ট্রিলিয়ন ভাগের ট্রিলিয়নের উপরে আরেক ট্রিলিওন সেকেন্ড সম্পর্কে এখনো জানি না। ওদিকে আবার, বিগ ব্যাং শব্দটা থেকে বা আমাদের গ্যালাক্সি থেকে দেখেও মনে হতে পারে, কোনো একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে এই মহা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কিন্তু আসলেই কি আমাদের মহাবিশ্বের কোন কেন্দ্র আছে? না, নেই। এবং তার কারণটাও বেশ সহজ: বিগ ব্যাং-এর আগে সময় এবং স্থানের কোন ধারণাই ছিল না। এখনো সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, বিগ ব্যাং-এর পরে ১০^-৩৬- ১০^-৩৩ (১০ টু দি পাওয়ার নেগেটিভ ৩৬ থেকে ১০ টু দি পাওয়ার নেগেটিভ ৩৩) সেকেন্ড পর্যন্ত মহাবিশ্ব অকল্পনীয় গতিতে সম্প্রসারিত হয়েছিল, যাকে বলা হয় ইনফ্লেশন (Inflation)।
আর ইনফ্লেশন তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের স্ফীতি থেমে গেলেও, বহু দূরে কোথাও কোথাও ইনফ্লেশন থামেনি, হয়েই চলেছে। আর সেজন্যই আমাদের প্রায়-অসীম এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু খোঁজার আসলে কোনো অর্থই হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব এই প্রতিনিয়ত প্রসারিত হতে থাকলে শেষটায় কী হবে? গ্রহনক্ষত্রছায়াপথ সব বহু দূরে দূরে সরে যাবে একে অন্যের থেকে। তারাদের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে আসবে ক্রমে, একদিন একে একে তারাও যাবে নিভে। তারপর গোটা মহাবিশ্বের তাপ আর আলো শেষ হয়ে গেলে ফুরোবে মহাজাগতিক সব লেনদেন। সেসবের হিসেব নিয়ে আবারো আসবো ভবিষ্যতে। শোনাবো অণুপরমাণু, এই বস্তুজগতের জন্মের গল্প, ডার্ক ম্যাটার, ইনফ্লেশন, সিঙ্গুলারিটি বা প্রথম সেই মুহূর্তের অজানা বিষয়গুলো নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনাগুলোর রোমাঞ্চকর সব গল্পগুলো