হালুম! বাঘ! ব্যাঘ্র! বাঘ মামা, বনের রাজা, দক্ষিণ রায়! কতই না নাম তার। এই রহস্যেঘেরা প্রাণীটির সাথে আমাদের সম্পর্ক কিন্তু বেশ জটিল। বাঘ নামটা শোনার সাথে সাথে আমাদের শক্তি-সৌন্দর্য, ভীতি-রোমাঞ্চ থেকে শুরু করে ভালোবাসা এমনকি আজকাল বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি ও সংরক্ষণের কথাও মনে পড়ে যায়। শুনলে হয়ত অবাক হবেন যে বাঘের একমাত্র হত্যাকারী হচ্ছি আমরা। গত ১০০ বছরে প্রকৃতিতে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে শতকরা ৯৫ ভাগ আর তাদের বাসযোগ্য এলাকা কমে গেছে প্রায় ৯৪ ভাগ, আর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানুষই দায়ী এর জন্য। এই নান্দনিক প্রাণীটি আর কতদিন প্রকৃতিতে স্বাধীনভাবে টিকে থাকবে, সেটাও আজ নির্ভর করছে আমাদেরই ওপর।
আজকে থিংকের বন্ধু, সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী হাসান রহমানের সাথে জানবো বাঘ সম্পর্কে, বিশেষ করে সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার, তাদের বিলুপ্তির আশঙ্কা এবং সংরক্ষণ সম্পর্কে। তবে আলোচনা শুরু করার আগে একটা ছোট্ট অনুরোধ, আমাদের ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকশন পেতে নিচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন। বাঘ আর মানুষ! সেই কবে থেকেই না পাশাপাশি বাস করে আসছি আমরা! চিনের কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে ভারতীয় পুরাণে বাঘের কথা শোনা যায়। কতই না রূপকথার গল্প আছে এই বাঘকে নিয়ে, আছে কত বাগধারা, ছড়ার পংক্তি! বেড়াল হল বাঘের মাসি। তাইইতো! বাঘ বিবর্তনীয়ভাবে বেড়ালের খুব কাছের আত্মীয়। আসলে বাঘ আর গৃহপালিত বেড়াল দুইই একই পরিবারের সদস্য! আর সেই পরিবারটির নাম হচ্ছে ফেলিডে। খেয়াল করলে দেখবেন, কুকুরেরা ডাল ভাত খেয়ে সানন্দে বেঁচে থাকলেও, বেড়ালদের কিন্তু মাছ-মাংস ছাড়া কিছুতেই চলে না।
পাঁচটা প্রাণীকে ধরা হয় ‘বড় বিড়াল হিসেবে, আর এদের মধ্যে বাঘই সবচেয়ে বড় এবং পেশিশক্তিসম্পন্ন। একসময় বাঘেদের মোট নয়টি উপ-প্রজাতি ছিল, যার মধ্যে পাঁচটি এখনো টিকে আছে, তিনটি গেছে বিলুপ্ত হয়ে, আরেকটার দেখা মেলে কেবল চিড়িয়াখানাতেই। পৃথিবীর প্রায় সবরকম পরিবেশেই দেখা মেলে বাঘেদের: ভুটানের মত চার হাজার মিটার উচ্চতায় যেখানে গাছ জন্মে না, সুন্দরবনের জলাভূমি থেকে শুরু করে সুমাত্রার গহিন অরণ্য, রাজস্থানের মরুভূমি বা সাইবেরিয়ার ঠান্ডায়। এদের দেহের মাপও বদলে যায় বাসভূমির উপর, মানে তাদের শিকারেরা কত বড়, তার ওপর নির্ভর করে, যেমন নেপাল, উত্তর ভারত আর দূর পূর্ব রাশিয়ার বাঘেরা আকারে সবচে বড়মাপের, আর সুন্দরবনের বাঘ মাপে সবচে ছোটো।
বনে এদের আয়ু প্রায় বছর পনেরোর মত। একাই ঘুরে বেড়ালেও এক্কেবারে নিঃসঙ্গও কিন্তু নয় তারা। নারী এবং পুরুষ বাঘ জুটি বাঁধে মিলনঋতুতে, কখনো কখনো আবার নাকি তারা বাচ্চা বড় করে দুজন মিলেই। বাঘিনী সাধারণত ৪টি বাচ্চার জন্ম দেয়। বছর দুয়েক মায়ের সাথে থাকার পরে ছেলে বাচ্চাগুলো বংশগতীয় বৈচিত্র্য ধরে রাখতে যতদূর পারে চলে যায়, আর মেয়ে বাচ্চাগুলো থাকার চেষ্টা করে মায়ের এলাকা ঘেঁষে। মায়ের এলাকা বেশি হলে সে তাদের কিছু জায়গা ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করে না। গত শতকের শুরুতেও কিন্তু লাখখানেকের মত বাঘ দিব্যি ঘুরে বেড়াত প্রায় পুরো এশিয়া জুড়ে, তুরস্ক থেকে শুরু করে সেই রাশিয়া পর্যন্ত। আর এখন?
এখন টিকে আছে ৪ হাজারের মত বাঘ, মাত্র দশটি দেশে। আর এর অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে আমাদের সেই ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ যারা মূলত বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল আর ভারতেই বাস করে। এই ‘রয়েল’ নামটা কিন্তু বৈজ্ঞানিক কিছু নয়। বৃটিশরা একদিকে যেমন আমাদের বেঙ্গল টাইগারের সামনে 'রয়্যাল' জুড়ে দিয়ে ঔপনিবেশিক রোমান্টিসিজম দেখিয়েছে, আবার অন্যদিকে তাকে মেরে বিলুপ্তপ্রায় করতেও পিছপা হয়নি। ব্রিটিশ আর স্থানীয় অভিজাতদের কাছে বাঘ-শিকার ছিল এক "রাজকীয় খেলা”—একেকজন মহারাজা বা ইংরেজ শিকারি বাঘমারায় সেঞ্চুরি করার দাবি করতেন অত্যন্ত গর্বের সাথে।দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেই ব্রিটিশ আমল শেষ হয়ে গেলেও আমাদের সুন্দরবনে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল অবধি বৈধভাবেই শিকার করা হয়েছিল ১৮৭টি বাঘ!
এজন্যই বলেছিলাম, মানুষের সাথে বাঘের সম্পর্কটা জটিল। মানুষ পৃথিবীতে রাজত্ব করার শুরু থেকেই অজস্র বাঘ মেরেছে। বন্দুকের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে বাঘেরা জ্যামিতিক হারে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে-চলার কারণেও কমে আসছে তাদের থাকার জায়গা! ফলে বাঘ হারাচ্ছে নিজস্ব আবাস আর কমছে তাদের শিকারের পরিমাণ। এতে করে তারা জনবসতিতে হামলে পড়ছে, সাবাড় করছে গবাদি পশু। আর নিজেদের জীবন আর জীবিকা বাঁচাতে মানুষও বাঘ মারছে। শুধু কী তাই? এখনো চিনে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ। তাদের প্রথাগত চিকিৎসায় বাঘের পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয় পুরুষের যৌনশক্তি বাড়ানোর ওষুধ বানানোর জন্য। নামকরা যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ ভায়াগ্রার নামও দেওয়া হয়েছে সংস্কৃত প্রতিশব্দ 'ব্যাঘ্র' থেকে।
এখন নাকি বনে যত বাঘ আছে তারচে বেশি আছে খাঁচায়-আটকানো। নেটফ্লিক্সের তুমুল জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘টাইগার কিং’ দেখেছেন হয়তো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাঘ প্রজননকারীদের ব্যবসা এবং উদ্ভট কাণ্ডকারখানা নিয়ে বানানো সিরিজ। এরকম ‘রাস্তার ধারের চিড়িয়াখানা’-য় টাকা দিয়ে আদুরে বাঘের ছানা নিয়ে ছবি তুলতে মানুষের দীর্ঘ সারি পড়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বন্দিদশায় বাঘের প্রজনন ঘটালে তাদের বাস্তুতন্ত্রের কোনো উপকার হয় না। এমনকি পরে বাঘ বনে এনে ছেড়ে দিলেও তারা সেখানে টিকে-থাকতে শেখে না।এখন প্রশ্ন করতে পারেন, বুনো বাঘ বা প্রাকৃতিকভাবেই শুধু বাঘকে রক্ষা করতে হবে কেন? কারণ, এর সাথে প্রাণীদের খাদ্যচক্র, পরিবেশের ভারসাম্য এবং সংরক্ষণসহ বেশ কতগুলো ব্যাপার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
বাঘেরা যেখানেই থাকুক, তারা সাধারণত থাকে খাদ্যচক্র বা ফুড চেইনের এক্কেবারে চূড়োয়। তারা সর্বোচ্চ শিকারি, মানে তারা হরিণ, শুয়োর, বুনো গরু, বনছাগল, বুনো মহিষের মত ক্ষুরওয়ালা প্রাণীর খাদক। বাঘ যদি উধাও হয়ে যায় তাহলে তৃণভোজী প্রাণীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকবে, আর সেইসাথে কমতে থাকবে বনভূমির পরিমাণ। এতে করে যেমন অন্য প্রাণীদের এবং পাখিদের জন্যে খাবারে টান পড়বে, ওদিকে আবার তৃণভোজীরা নিজেরাও একসময় খাদ্যসংকটে পড়বে।তাই বাঘ বাঁচালে, তাদের আবাসস্থল বাঁচালে, বাস্তুতন্ত্রটাও হয়ে ওঠে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বাঘকে 'কিস্টোন বা ‘আম্ব্রেলা স্পিসিজ’ অর্থাৎ ‘রক্ষক প্রজাতি' বলা হয় কারণ আপনি যদি বাঘ বাঁচান তাহলে বাঁচবে বিস্তীর্ণ বনভূমি এবং আরো অজস্র প্রজাতির অস্তিত্ব। যেমন, সুন্দরবনের বাঘ বাঁচালে সুরক্ষিত হবে হরিণ, বানর, মদনটাকের মত বিভিন্ন প্রাণী এবং তাদের খাবার ও আবাসস্থল। আর এই সংরক্ষিত বনভূমি বিশুদ্ধ বাতাস, জল, খাবার, আশ্রয়, স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও বিশাল ভূমিকা রাখে। আমরা তো বারবারই দেখছি এই সুন্দরবন কী বিশাল ভূমিকা পালন করে আমাদের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলো থেকে বাঁচাতে। তাই আমাদের মনে রাখা দরকার, বাঘ আমাদের জন্য শুধু শক্তি বা হিংস্রতার প্রতীক নয়, এই দুর্দান্ত প্রাণীটি আমাদের জাতীয় প্রাণী, পরিবেশ ও প্রকৃতির এক অনন্য সন্তান। সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের একে রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বড্ড দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই, এখনই আমাদের সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিলুপ্ত ম্যামথ বা টাসমেনিয়ার বাঘের মত আমরা বাঘকেও শুধু কম্পিটারের স্ক্রিনেই দেখতে চাই নাকি পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়ানো এই অনন্য সাধারণ প্রাণীটার সাথে উন্মুক্ত প্রকৃতিতে হেঁটে যেতে চাই আরো অনেকটা পথ?