বাংলার বদ্বীপ সৃষ্টি হলো কীভাবে? বাংলাদেশের জন্ম-কাহিনী

.

নদীমাতৃক বাংলাদেশের কথা ভাবলে আমাদের চোখে কী ভেসে ওঠে? স্থির বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি, সবুজ ধানক্ষেত, রুপোলি নদী-নালা, খাল, বিল, মনে হয় যেন সারাজীবনই বুঝি এরকমই শান্ত-সবুজই  ছিল সবকিছু

অথচ বাংলার এই শান্ত, বিস্তীর্ণ সমতলভূমির জন্মের পিছনে লুকিয়ে আছে মহাদেশীয় পাতগুলোর  ভয়ঙ্কর সব সংঘর্ষএকটি, দুটি নয়, -৫টি ভূখণ্ড থেকে আসা পলিমাটি আর  পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালাসহ আরো অনেকগুলো পর্বতমালার জেগে ওঠার গল্প।   

আজ থেকে কোটি বছর আগেও আমরা যাকে বঙ্গীয় বদ্বীপ বলে জানি তার অস্তিত্বই ছিল না, ছিল না আজকের বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের  বিশাল এক অংশ। রংপুর বা সিলেটের এলাকা  থেকে দক্ষিণে যা দেখি তার  সব ছিল সমুদ্রের পানির নিচে - আজকের খুলনা, যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রামের তখনো কোন চিহ্নই ছিল না। আজ  সে বিষুবরেখার উত্তরে  অবস্থিত হলেও তার  জন্মের  ইতিহাস কিন্তু শুরু হয়েছিল পৃথিবীর অপর প্রান্তে - সেই দক্ষিণ গোলার্ধেএন্টার্কটিকার কাছে - প্রায়  ১৩ থেকে ১৭ কোটি বছর আগে।  

আর  গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা? এই নদীগুলো যেমন আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঠিক তেমনি এদেরকে বাদ দিয়ে  আমাদের এই বঙ্গীয় বদ্বীপের গল্পটিও  বলা সম্ভব নয়। 

আসুন, আজকে তাহলে  থিংকের বন্ধু, Florida International University- ভূতত্ত্বের প্রফেসর . নেপচুন শ্রীমালের সাথে জেনে নেই 

- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই বদ্বীপ সৃষ্টির সেই রোমাঞ্চকর ইতিহাস। জেনে নেই,  

- কীভাবে তা  অনবরত বদলে গেছে, যাচ্ছে, এবং সেই সাথে বদলে দিচ্ছে আমাদেরও প্রতিনিয়ত। 

প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে প্যাঞ্জিয়া, হ্যাঁ, পৃথিবীর সবগুলো  মহাদেশ একসাথে হয়ে যে বিশাল ভূভাগ তৈরি হয়েছিল, সেই প্যাঞ্জিয়া ভাঙতে শুরু করে - তৈরি হয়  দুটি অতিমহাদেশ, লরেশিয়া এবং গন্ডোয়ানাল্যান্ড। আর এই গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকেই শুরু বাংলার এই বদ্বীপের যাত্রা। 

প্রায় ১৩-১৭  কোটি বছর আগেগন্ডোয়ানাল্যান্ডে ভারত, এন্টার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়ার ভেতর চিড় ধরতে  আরম্ভ করে।  এই  চিড়গুলো ধরে ধরে অগ্ন্যুৎপাতের সাথে যে লাভা বা ম্যাগমা উঠে এসেছিল তার অস্তিত্ব অর্থাত সমকালীন  আগ্নেয়শিলা দেখা  যায় সিলেট আর শিলং আর অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে - যেটা ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার যে একসময় যে  যুক্ত ছিল তার  প্রমাণ। আস্তে আস্তে   ভারত, এন্টার্কর্টিকা এবং  অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের চিড় খাওয়া পাতগুলোর  মাঝখানে সৃষ্টি হয় এক সমুদ্র। 

আর হ্যাঁ - এই যে এখনকার এন্টার্টিকার কাছে গন্ডোয়ানাল্যান্ড এর মহাদেশীয়  পাতগুলোকে  ভাংতে দেখছেন, আর তার নীচে  ভারতীয় পাতের  যে তটদেশ  ছিল তার ওপরই ওপরেই কোটি কোটি বছর ধরে, বহু পথ বেয়েবহু ভূখন্ডের পলিমাটি পড়ে পরেই  তৈরি হয়েছে আমাদের এই বঙ্গীয় বদ্বীপ 

আমরা থিংকের হিমালয় এবং এভারেস্টের ভিডিওতে দেখেছিলাম যে  ভারত এক স্ময় অস্ট্রেলিয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে উত্তর দিকে চলতে শুরু করে। হাজার হাজার মাইল ধরে বিস্তীর্ণ মহাসাগর পেরিয়ে এই অভিযানে সে কিন্তু সবসময়ে একা ছিল না। প্রায়   কোটি বছর আগে ভারতের সঙ্গে ধাক্কা লাগে  আরেক ভূখণ্ডের যাকে আমরা এখন বলি পশ্চিম বর্মাদেশ। তারপরে সে আর কিন্তু ভারতের পিছু ছাড়েনি। ভারত আর পশ্চিমা বর্মাদেশের মাঝখানে যে সমুদ্র সৃষ্টি হয়েছিল  সেখানেও তখন  দুদিক  থেকে পলি এসে জমা হতে শুরু করে। 

ওদিকে আবার ভারতীয় ভূত্বক আস্তে আস্তে  পশ্চিম বর্মার পাতের তলায় ঢুকতে আরম্ভ করে আমরা জানি , এটাকে  ভূবৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয়  সাবডাকশান।  ভারত যতই ঢুকতে থাকে ততই পশ্চিম বার্মা ব্লক  উঁচু হয় - তৈরি হয় নাগাল্যান্ড আর  আরাকান ইয়োমা পর্বতমালা। 

এখানেই কিন্তু  গল্প শেষ নয়, বরং বলতে পারেন - সবে  শুরু সাসপেন্সের। 

প্রায়  সাড়ে  পাঁচ কোটি বছর আগে ভারতীয় পাত  বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম দিকে  ইউরেশীয় পাতের সাথে  তিব্বত বরাবর ধাক্কা খায়আমরা জানি যে সেই দুনিয়া কাঁপানো সংঘর্ষের ফলেই  গড়ে ওঠে  হিমালয় পর্বতমালা। 

এই হিমালয় পর্বত তৈরি হতে হতে তার ঢেউ পৌঁছায়  হিমালয়ের পাদদেশে যেখানে দেখি শিবালিক পর্বত এবং সেখানেই তৈরি হয় গঙ্গা নদী। পাহাড় যত বড় হতে থাকে ততই বাড়তে থাকে  তাদের ক্ষয়, তাই   ধীরে ধীরে  সেখান থেকে বিশাল পরিমাণ পলিমাটি গঙ্গা নদী ধরে এসে  জমা হতে শুরু করে বেঙ্গল বেসিনে।

তাহলে এখন ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো?   

হিমালয়ের বিশাল পরিমাণ পলিমাটি আসছে গঙ্গা বেয়ে প্রচণ্ড বেগে, পলি আসছে বার্মা প্লেট বা  নাগাল্যান্ড এবং আরাকানি পাহাড় থেকেও আর ওদিকে  তো ভারতীয় ভূখণ্ড এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আগেই এসেছিল। এবার  আস্তে আস্তে ভরাট হতে শুরু করলো আমাদের এই বেঙ্গল বেসিন। 

ভারত আর তিব্বতের যেখানে ধাক্কা লেগে হিমালয় তৈরি হয়েছিল সেখান থেকেই কিন্তু  Yarlung বা   ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। 

আরেক কাণ্ড ঘটে গেছে এর মধ্যে, - তিব্বত সরু সরু লম্বা অনেকগুলো ফালির মত ভূখণ্ড দিয়ে তৈরি। এখন  তিব্বতের ভূখণ্ডগুলো ডানদিকে মোড় নিতে থাকলে তৈরি হয় মিশ্মি পাহা আর তার ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের  মূল ধারাটি ভারতের একদম পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে যে  দক্ষিণ দিকে ভিয়েতনামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল তা আটকে যায়। পথ আটকে এবার  ক্রমশ সরে আসতে শুরু করে আটকে গিয়ে পূর্ব আর দক্ষিণে বঙ্গীয় বদ্বীপের দিকে।  

মূলধারা পরিবর্তন করতে করতে ব্রহ্মপুত্র একসময় বাংলাদেশের উত্তরে চলে আসে - কিন্তু এবার পথ আটকে দাঁড়ায় শিলং মালভূমি বা  শিলং প্লেটো।  পাশ কাটিয়েউত্তর দিক থেকে এসে দক্ষিণে মোড় নিয়ে শেষ পর্যন্ত অদম্য ব্রহ্মপুত্র  প্রবেশ করে বাংলাদেশে, বিশাল এক পলিমাটির ডালি নিয়ে। 

ওদিকে আবার  গঙ্গা নদীও একসময় পথ পরিবর্তন করে পূর্ব দিক  দিয়ে বাংলার ভিতর দিয়ে  প্রবাহিত হতে শুরু করলো। গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র এভাবে পলিমাটি বহন করে না নিয়ে এলে বদ্বীপের এত বিস্তীর্ণ অঞ্চল তৈরি হতে  পারতোনা। ধারণা করা হয় আজো  তারা সম্মিলিতভাবে প্রতি বছর ১০০ কোটি টনের বেশি  পলি নিয়ে আসে বঙ্গীয় বদ্বীপেএর ৪০ শতাংশ আসে গঙ্গা-পদ্মা এবং ৬০% আসে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা দিয়ে।  এর  প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ থেকে যায় দেশের ভেতরে বা উপকূলে এবং বাকি ৫০ থেকে ৬০ ভাগ উপকূলের কাছে বা দক্ষিণে বদ্বীপে জমা হয়। কোটি কোটি বছর ধরে পলি পড়ার ফলে আজকে বরিশাল অঞ্চল ২০ কিলোমিটার এবং  ঢাকা প্রায় ১৫ কিলোমিটার অবক্ষিপ্ত পলির ওপর বসে আছে।

ওদিকে আবার সুন্দরবনের উপকূলের দক্ষিণে সাগরের ভিতরের সোয়াচ গিরিখাত দিয়ে বিশাল পলিপ্রবাহ বয়ে গিয়ে তৈরি করেছে ১৫-২০ কিলোমিটার উঁচু বেঙ্গল ফ্যানতবে একে বঙ্গীয় বদ্বীপ থেকে আলাদা বলেই ধরা হয়। 

এদিকে  বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভূত্বক বার্মা প্লেটের নীচে যী অধোগমন করছে, তার ফলেই গড়ে উঠেছে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। বার্মা প্লেট অনেকটা দা বা বটির মত কাজ করে এবং বঙ্গীয় অববাহিকার অবক্ষিপ্ত পাললিক স্তরকে চেঁছে ওপড়ে উঠিয়ে দেয়। 

এখানে একটা মজার তথ্য উল্লেখ করিঃ সিলেটের কাছে মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তে সাড়ে ১৩ কোটি বছর আগে ক্রেটেশ্যাস যুগে অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল, যখন ডাইনোসরেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। গলিত পাথর জমাট  বাঁধে, তার ওপর পড়ে পলির আস্তরণ যা সময়ের সাথে জমাট বেধে হয় পাললিক শিলা, যাতে ডাইনোসরের মৃতদেহ আটকে পড়ে। তাই এলাকায় ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায়। আর বাকি বাংলাদেশ জন্মই তো নিয়েছে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর, তাই বাংলাদেশে ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায় না। 

যাই হোক, আমাদের আজকের বঙ্গীয় বদ্বীপের গল্পে  ফিরে আসি। একে এখন মোটামুটিভাবে  দুটো ভাগে ভাগ করা যায়

  • পূর্বদিকে সক্রিয় মেঘনা বদ্বীপ সমতল এবং 
  • পশ্চিমদিকে নিষ্ক্রিয় বদ্বীপ।

সক্রিয় মেঘনা মোহনায় প্রতিনিয়ত ভাঙা-গড়ার মধ্যেও পলি পড়ে বছরে ১০ থেকে ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন জমি সমুদ্রের ওপরে জেগে উঠছে। 

আর  পশ্চিমদিকের নিষ্ক্রিয় বদ্বীপে-যার মধ্যে এই সুন্দরবনও পড়ে- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণ দিকে কিছু ভাঙন দেখা দিলেওসমুদ্রের জোয়ারের সঙ্গে পলি কিছুটা সাম্যাবস্থা থাকে তবে এই শতাব্দীতে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরো বাড়লে সুন্দরবন এলাকা ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে বলে  আশঙ্কা করা হচ্ছে।   

পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী পূর্বে উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত গোরাই, মধুমতী, কালীগঙ্গা, বলেশ্বর নদীর মধ্যের বদ্বীপে নতুন পলি আসে না, ফলে এটাকে মৃতপ্রায় বদ্বীপ বলা হয়। এর একটি কারন হল উজানে ভারতে ফারাক্কাসহ কয়েকটি বাঁধ দেবার ফলে পদ্মা তার প্রশাখার স্বাভাবিক স্রোত পলিভরণের প্রক্রিয়ার বাধা পড়েছে।  

আর একটি কারণ ভূতাত্ত্বিক। ক্রমাগত পাত সঞ্চালনের  ফলে সামগ্রিকভাবে বঙ্গীয় বদ্বীপ বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে গিয়ে  ধীরে ধীরে ডানদিকে কাত হচ্ছে, ফলে   নদীর প্রবাহ ক্রমাগতই পূর্ব দিকে সরছে।  ভূমির এই অবনমন হচ্ছে।  

এর ফলে  হয়তো আগামী . কোটি বছরে সমগ্র বঙ্গীয় বদ্বীপই হয়তো  ঢুকে পড়বে বার্মা পাতের নিচে। হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণ অক্ষুণ্ণ থাকলে বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণে গড়ে উঠতে পারে নতুন বদ্বীপ, তবে  আজকের চিরচেনা জায়গাগুলো হয়তো তখন আর থাকবে না। 

এই ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলতেই থাকবে, তবে আজকে আমরা মূলত বঙ্গীয় বদ্বীপের সৃষ্টির প্রাচীন ইতিহাসটাই জানলাম , এই যে ব্রহ্মপুত্রের বা গঙ্গার গতিপথের পরিবর্তনের কথা শুনলাম তার অনেক কিছুই  কিন্তু ঘটেছে মাত্র ১০-১২ হাজার বছর আগে। এর পরের আরেকটি ভিডিওতে আলোচনা করবো এরকম আরও সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে যা আমাদের এই  বদ্বীপের উপর গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। 

 

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles