বাংলাদেশে তেল, গ্যাস বা সোনার খনি!

.

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকম খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। সিলেটে গ্যাস, উত্তরবঙ্গের মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলা (গ্রানাইট), বড়পুকুরিয়ায় কয়লা। কিন্তু বরিশালে কেন গ্রানাইট নেই? খুলনাতে কয়লা বা গ্যাস নেই কেন? বাংলাদেশে কি খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায়?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড কিভাবে তৈরি হয়েছে, সেই ইতিহাসে। যদি এখনো না দেখে থাকেন, তাহলে থিংকের এই বাংলার বদ্বীপ সৃষ্টি হলো কীভাবে? ভিডিওটা দেখে নিলে আজকের ভিডিওটা বুঝতে সুবিধা হবে।
 
আজ থেকে ৩০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সব ভূভাগ মিলে একত্রে তৈরি করেছিল বিশালতম মহাদেশ প্যানজিয়া। এই ভূখণ্ডগুলি এক বা একাধিক টেকটোনিক প্লেইট বা ভূ-পাতের সমষ্টি। বাংলাদেশ ভারতীয়  পাত নামের একটা পাতের অংশ।
 
ভূগর্ভস্থ তাপ আর পৃথিবীর ঘুর্ণনের কারনে ভারতীয়  পাত  উত্তর দিকে সরতে থাকে, এবং আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে ভারতীয় পাতের উপরের বা উত্তরের অংশ ইউরেশিয়ান পাতের  সাথে ধাক্কা খায় বর্তমান তিব্বতের কাছে। এই ধাক্কার ফলে জন্ম নেয় হিমালয় যা আমরা দেখেছিলাম থিংকের হিমালয় কীভাবে বদলে দিন পৃথিবী ভিডিওতে।
 
আর এই  ভারতীয় পাতের একদম শেষ বা নিচের অংশ ছিল বর্তমান সিলেট আর রংপুর। তার দক্ষিনে কোন মাটি ছিল না, ছিল অথৈ সমুদ্রের পানি। প্রাচীন পাথরে তৈরি রংপুর আর সিলেটের উত্তরে ভারতের মেঘালয় ছিল শুধু। বর্তমান সিলেটের অধিকাংশ আর গাইবান্ধা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সমুদ্র আর  সিলেট অঞ্চলের দিকে  এই সমুদ্র ছিল জাফলং আর খাসিয়া পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
 
সেই প্রাচীন সমুদ্রের প্রান্তে, সিলেটের ছাতকে একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। বাংলাদশের সেই সময়ের দূর্গম প্রান্তে কেন সিমেন্ট ফ্যাক্টরি করা হয়েছিল? কারন সেখানে একসময় চুনাপাথর পাওয়া যেত। ভোলাগঞ্জ থেকে রোপওয়ে দিয়ে কেবল কারে করে চুনাপাথর আসতো সেখানে। ভোলাগঞ্জের “সাদা পাথর” এলাকায় যারা ঘুরেছেন, তারা কি জানেন, এই সাদা পাথরের সাদা রঙ এসেছে ক্যালসিয়াম থেকে, যা থেকে পানে বা দেয়ালে দেওয়া চুন তৈরি হয়?
শামুক, ঝিনুক, কোরাল, এই সব জলজ প্রাণী মারা যাওয়ার পর খোলসগুলি পানিতে মেশে। তারপর সেই পানি বাষ্পীভূত হলে খোলসের ক্যালসিয়াম জমে তৈরি হয় চুনাপাথর। তাই যেখানে প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়, প্রায় নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায় সেটা এক সময় স্বল্প-গভীরতার পানির নিচে ছিল, অর্থাৎ উপকূল ছিল। সিলেটেও তাই হয়েছে।

নদীর শামুক/ঝিনুক থেকে কি এই চুনাপাথর আসতে পারতো?

না, সেটা সম্ভব না, কারন ঐ পরিমাণ পাথর তৈরি করতে হাজার হাজার বছরের হাজার-কোটি শামুক/ঝিনুক লাগতো, নদীতে তার  স্থান-সংকুলান হওয়া সম্ভব নয়।

একই কারনে নওগাঁ আর জয়পুরহাটেও পাওয়া গিয়েছে আহরণযোগ্য পরিমাণের চুনাপাথর, কারন ঐ এলাকাগুলিও এক সময় সিলেটের মতই ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ স্থলসীমার শেষ, সমুদ্রের শুরু।
 
তারপর কী হলো সেই সমুদ্রের?
 
হিমালয় থেকে নামা নদীগুলো কোটি কোটি টন পলি  বয়ে এনে ঢেকে দিয়েছে সেই সমুদ্র, তৈরি করেছে বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা।
 
সিলেট ও রংপুর-দিনাজপুরের কিছু অংশও তৈরি হয়েছিল ৩০ কোটি বছরেরও আগে, যখন ভারতীয়  পাত গন্ডোয়াল্যান্ডের অংশ ছিল। সেই প্রাচীন ভূখণ্ডে অগ্ন্যুৎপাতের ম্যাগমা শীতল হয়ে তৈরি করেছে গ্রানাইট। সময়ের সাথে পৃথিবীর আগ্নেয়গিরিগুলি শেষ হয়ে আসছে, তাই নতুন ভূখণ্ডে তেমন কিছু ঘটে নি।
 
ওদিকে কয়লা, গ্যাস এবং পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি তেল —তিনটাকেই ‘ফসিল ফিউয়েল’ বা জীবাশ্ম জ্বালানী বলা হয়, কারন এগুলি তৈরি হয় মৃত জীব বা গাছ থেকে। দেখা যাক জীবাশ্ম থেকে গ্যাস, পেট্রোলিয়াম আর কয়লা তৈরির প্রক্রিয়াটা কীরকম এবং বাংলাদেশের কোথায় কী পাওয়া যাচ্ছে।
 
কয়লা ডাইনোসরদেরও আগের, অর্থাৎ ৩০ কোটি বছরেরও আগের প্রাচীন গাছের দেহাবশেষ। পানি আর মাটির নিচে চাপা পড়ে  তাপে/চাপে সেই গাছগুলি পরিণত হয় কয়লায়। যখন মহাদেশীয় পাত ভাঙ্গার সময় যদি  কয়লা আছে এমন স্তর যদি এভাবে উপরে উঠে আসে, তখন সেটা বাণিজ্যিকভাবে আহরণ করা সহজ হয়।। দিনাজপুরের বড়োপুকুরিয়াতে তাই হয়েছে, তাই সেখানে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় কয়লাখনি।
 
ওদিকে আবার সমুদ্রের পানিতে থাকে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন ও অন্যান্য জলজ ক্ষুদ্র প্রাণী। কোটি কোটি বছর ধরে তারা মারা যায়  তাদের দেহের কার্বন ও অন্যান্য জৈব যৌগ পড়েছসেই প্রাচীন সমুদ্রের তলদেশে। তারপর ভেসে আসা পলির আস্তরণে তারা চাপা পড়েছে। সময়ের সাথে সেই মাটি এক সময় পরিণত হয় পাথরে, তার সেই পাথরের নিচে অক্সিজেন-বিহীন পরিবেশে তৈরি হয়েছে মোমের মত একটা পদার্থ যার নামে কেরোজেন । যদি অন্তত ২-৩ কিলোমিটার মাটির নিচে থাকে সেই কেরোজেন তাহলে পৃথিবীর তাপে সেটা থেকে তেল বা গ্যাস তৈরি হতে পারে। তাপমাত্রা যদি ৯০ থেকে ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তাহলে গ্যাস আর পেট্রোলিয়াম, দুটাই তৈরি হবে। আর যদি ১৬০ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা থাকে, তাহলে শুধু গ্যাস তৈরি হবে। যত বেশী নিচে চাপা পড়বে, তত বেশি তাপমাত্রা। বাংলাদেশে ১৫-২০-২৫ কিলোমিটার বা তার চাইতেও বেশী পলির নিচে চাপা পড়ে কোটি কোটি বছর ধরে প্রকৃতির রান্নাঘরের তাপে ও উপরের চাপে তৈরি হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানী। যেহেতু এগুলি গভীরে চাপা পড়ে ছিল, তাই তাপ বেশি ছিল, ফলে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কিছু পেট্রোলিয়াম।

যেহেতু সিলেট ছিল সেই প্রাচীন অঞ্চলের সমুদ্রের শুরু এবং সেই অঞ্চল চাপা পড়া শুরু হয়েছে বাকি এলাকাগুলির আগে, তাই সেখানে গ্যাস তৈরি হওয়ার সময় পেয়েছে সবচাইতে বেশি। বাংলাদেশের প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয় সিলেটের হরিপুরে, ১৯৫৫ সালে।

বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রের নিচে গ্যাস? ঘটনা একই। সমুদ্রের তলদেশেও জলজ প্রাণীর দেহ থেকে গ্যাস তৈরি হয়েছে, তবে সেটা তৈরির পদ্ধতি একটু আলাদা। কিছুদিন আগেই খবরে এসেছে, বাংলাদেশের উপকূলে কয়েক ট্রিলিয়ন মিথেন হাইড্রেট (গ্যাসের স্ফটিক) পাওয়া গিয়েছে । পানির সংস্পর্শে ছিল বলে সেই গ্যাস হাইড্রেট হয়ে গিয়েছে, এবং সেটা থেকে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস বের করার কোন সাশ্রয়ী পদ্ধতি এখনো নেই।
 
গ্যাসের অংশে আমরা দেখেছি, পেট্রোলিয়াম তৈরি হওয়ার পদ্ধতি গ্যাসের মতই। এখানেও শর্ত হচ্ছে, সমুদ্রিক প্রাণীর মৃতদেহ চাপা পড়বে মাটির নিচে, তারপর সেটা তাপে ও চাপে রূপান্তরিত হয়ে তৈরি হবে পেট্রোলিয়াম যদি তাপমাত্রা ১৬০ ডিগ্রির কম থাকে। । মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা থেকে আমরা একটা সহজ অনুসিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি—সৌদি আরব ও অন্যান্য তেল-সমৃদ্ধ মরুভূমির দেশগুলি এক সময় সমুদ্রের নিচে ছিল যেটা পরে শুকিয়ে গিয়েছে। সিলেটে প্রথমে গ্যাস পাওয়া গিয়েছে, এবং একই কারনে সেখানে পেট্রোলিয়ামও পাওয়া গিয়েছে।
 
বর্তমানে পৃথিবীর মোট তেলের মজুদের ৭০% তৈরি হয়েছে মেসোজোয়িক যুগ বা ৬.৬ কোটি বছর থেকে পচিশ কোটি বছর আগে, ২০% তৈরি হয়েছে ছয় কোটি বছর আগে, আর মাত্র ১০% তৈরি হয়েছে ২৫ থেকে ৫০ কোটি বছর আগে। বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডের নিচে যে সমুদ্র ছিল, তা অবশ্যই এই বয়সের হিসাবে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেই তেল খুঁজতেই ২৫-৩০ কিলোমিটার পলিমাটি ড্রিল করা লাগবে। এত গভীর মাটিতে ড্রিল করা সম্ভব না এখনো তাই সেটা না করে সমুদ্রে তেল খোঁজা হচ্ছে, এবং পাওয়াও যাচ্ছে, যদিও বড় তেলক্ষেত্র এখনো আবিষ্কার হয় নাই। তবে সেগুলিও হয়তো  সমুদ্রের তলদেশে আরো কয়েক কিলোমিটার মাটির নিচে হবে।
 
তাহলে আর কী পাওয়া যেতে পারে বাংলাদেশে? লোহা, সোনা বা অন্যান্য ভারী ধাতু এমনিতেই মাটির গভীরে থাকে। তার ওপরে পড়েছে আরো ২০-২৫ কিলোমিটার পলি, তাই সেগুলি থাকলেও খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের নেত্রকোনা এবং মধ্যপাড়ায় কিছু এলাকা আছে, যেখানে কিছু সাদা মাটি বা কেওলিন পাওয়া যায়, যা আমদানি করা কেওলিনের সাথে মিশিয়ে সিরামিকের প্লেইট, বাটি এগুলি তৈরি করা হয়। আর আছে বালু, যদিও সেটাকে আমরা খনিজ হিসাবে ভাবি না।
 
সাড়ে চারশো কোটি বছর বয়সের পৃথিবীর এক চিমটি এলাকা নিয়ে মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি বছরেরও কম বয়সী বাংলাদেশের জন্য এই বা খারাপ কী।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles