শুভ নববর্ষ।
আমরা জানি যে প্রতি বছর রোজার শুরু বা দুই ঈদ ইংরেজি ক্যালেন্ডারের একই দিনে হয় না—আগের বছরের চাইতে ১০ বা ১১ দিন এগিয়ে আসে। আপনি কি জানেন, পহেলা বৈশাখ আর বাংলা পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের জন্ম সেই কারণেই?
আমরা আমাদের 'ক্যালেন্ডার কীভাবে এল' ভিডিওতে দেখেছিলাম, একটা নতুন ক্যালেন্ডার বানানো সহজ ব্যাপার না। বাংলা ক্যালেন্ডারের জন্মের ইতিহাসটি বেশ বৈজ্ঞানিক; চলুন, তাহলে আজ জেনে নেয়া যাক কোথা থেকে এল আমাদের এই ক্যালেন্ডার।
আলোচনা শুরুর আগে একটা ছোট্ট অনুরোধ, ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকেশন পেতে নিচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
মোগল সাম্রাজ্যে বছর শুরু হতো হিজরি সন বা ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কিন্তু দেখা গেল, সেটা একটা বিশাল ঝামেলা করছে রাষ্ট্র পরিচালনায়। ফসল ওঠার ঠিক পর পর মানুষের কাছ থেকে সরকারের খাজনা বা ট্যাক্স পাওয়া সহজ, কিন্তু ছয় মাস পরে গেলে তার কাছে আর টাকা থাকে না। মাঠে কখন ধান আসে, সেটা নির্ভর করে ঋতুর ওপর, যা নির্ভর করে সূর্যের ওপর। এদিকে হিজরি সন চাঁদ-ভিত্তিক; এই বছর হিজরির যেই তারিখে ট্যাক্স দেয়ার দিন, পরের বছর সূর্যের হিসাবে সেটা ১০ দিন এগিয়ে যাবে।
কেন পিছিয়ে যায়?
চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট ২.৮ সেকেন্ড। সেই হিসেবে ১২ মাসে হয় মোট ৩৫৪.৩৬৭ দিন। আর সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন। তার মানে এক চান্দ্র বছর (হিজরি ক্যালেন্ডার) আর এক সৌর বছরের (ইংরেজি বা বাংলা ক্যালেন্ডার) মধ্যে প্রায় সাড়ে দশ দিন (১০.৬) তফাৎ হয়ে যাচ্ছে। তাই ঈদ আগাতে থাকে, পুজা আগাতে থাকে আবার ওদিকে খাজনা তোলার দিনও আগাতে থাকে।
অর্থাৎ আজকে যদি ফসল তোলার দিন হয়, ৯ বছর পরে দেখা যাবে, হিজরি ক্যালেন্ডারে তারিখ একই আছে, কিন্তু ফসল পাকতে এখনো ৯০ দিন বা তিন মাস বাকি। দিন আনি দিন খাই কৃষকের হাতে টাকা নেই, খাজনা তুলতে গিয়ে তখন তাকে শুলে চড়িয়েও লাভ হচ্ছে না, টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
এই সব ঝামেলার সমাধান করার জন্য সম্রাট আকবর ১৫৮৪ ইংরেজি সালে তার রাজসভার জ্যোতির্বিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দিলেন, একটা নতুন সন-তারিখের পদ্ধতি তৈরি করতে।
ফতেউল্লাহ সিরাজী হিজরি সন, সৌর সিদ্ধান্ত নামের একটা সংস্কৃত জ্যোতির্বিদ্যার বই অনুসারে তৎকালীন ভারতীয় ক্যালেন্ডার আর আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছর, এই তিনটাকে মিলিয়ে একটি নতুন সন তৈরী করলেন। আকবরের প্রবর্তিত ধর্ম দ্বীন-এ-এলাহি-র সাথে মিলিয়ে এই ক্যালেন্ডারের নাম দেয়া হলো তারিখ-এ-এলাহি। এখানে বলে রাখা ভাল, এই ইতিহাস নিয়ে একটু দ্বিমত আছে। অন্য মতানুসারে, এই ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি আকবরের অন্তত ৫০ বছর আগে, আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ-এর আমলে, সিরাজী শুধু সেটাকে আরো প্রাঞ্জল করেছেন।
এই তারিখ-এ-এলাহির পদ্ধতিটা কঠিন না। নতুন সন গননা শুরু হলো হিজরি সনের সাথেই; অর্থাৎ প্রথম হিজরি সন এ প্রথম তারিখ-এ- এলাহি সন হিসাব করলে ৯৬৩ হিজরি সন হচ্ছে ৯৬৩ তারিখ-এ- এলাহি সন, যেটা আবার ১৫৫৬ ইংরেজি সন - আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছর, এবং হিজরি বছরের মতই এই ৯৬৩ তারিখ-এ-এলাহি চন্দ্র মাসের সাথে হিসাব করা হলো, যেখানে আগের মতই ৩৫৪ দিনে বছর হলো হলো, কিন্তু ৯৬৪ তারিখ-এ-এলাহি হলো সৌর বছর, - সেখানে এখনকার যে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আমরা ব্যবহার করি তার মতই ৩৬৫ দিনে বছর গোনা হলো ।
তাহলে ভারতে এর আগে তাহলে কী ধরণের ক্যালেন্ডার ছিল?
ভারতবর্ষে গণিত আর জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো। আকবরের অন্তত ৫০০ বছর আগে শকাব্দ নামে আরেকটা বর্ষ গণনার পদ্ধতি ছিল। সিরাজী সৌর সিদ্ধান্ত নামে যে বই ব্যবহার করেছেন, সেটা আরো পুরানো।
এখানে শুধু আমরা বর্তমানে যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০১৯ খৃষ্টাব্দে বাংলা ১৪২৬ সাল হয়, সেটার উৎপত্তি নিয়ে কথা বলছি।
ফসল ওঠার সাথে সাথেই তারিখ-এ-এলাহির নতুন বছরে মুগল সুবেদাররা খাজনা আদায় করলেন। কৃষকের উপরে আর ততটা চাবুক পড়লো না, ফসল ওঠার সাথেই সাথেই খাজনা কেড়ে নিয়ে নেওয়া হলো। বাংলার কৃষকদের কাছে সেই জন্য তারিখ-এ-এলাহির বদলে এই নতুন বছর “ফসলি সন” হিসাবে পরিচিতি পায়, এবং সরকারী ক্যালেন্ডার হয়ে যায়।
সিরাজী মাসের নাম হিসাবে ফার্সি ক্যালেন্ডার থেকে নাম ব্যবহার করেছিলেন তারিখ-এ-এলাহিতেঃ বাঙ্গালির জিভে সেগুলি পোষালো না, তাই অচিরেই নক্ষত্রগুলির সংস্কৃত নাম অনুসারে বাংলা মাসের নামকরণ হয়ে গেলঃ
যেমন ধরুন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জাইষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ, ...এভাবে আষাঢ়া থেকে আষাঢ়
কোন কোন সূত্র অনুযায়ী আকবরের ক্যালেন্ডারের মাসের প্রতিটি দিনের আলাদা নাম ছিল, কিন্তু সেটা তো বিশাল ঝামেলার ব্যাপার। তাই সম্রাট শাহজাহানের সময় ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মত সপ্তাহের প্রচলন করা হয় যাতে মানুষের মাত্র ৭টা দিনের নাম মুখস্ত করলেই চলে।
তারপরেও একটা প্যাচ থেকেই গেল। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘুরে আসতে সময় আসলে লাগে ৩৬৫ দিনের একটু বেশি... ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। সুতরাং ৩৬৫ দিনে বছর হিসাব করলে প্রতি চার বছরে ২৩ ঘন্টা ১৫ মিনিটের মত বাদ পড়ে যায়। তাহলে প্রতি ১০০ বছরে প্রায় ২৪ দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এটাকে ঠিক রাখার জন্য তাই প্রতি চার বছরে এক দিন যোগ করা হয়, তাই আমরা ইংরেজি বা গ্রেগ্ররিয়ান ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ার পাই।
তবে সেটাও সম্পূর্ন সঠিক না। খেয়াল করে দেখুন এখানে ২৩ ঘন্টা ১৫ মিনিটের বদলে ২৪ ঘন্টা যোগ করা হচ্ছে, তার মানে আমরা ৪৫ মিনিটের হিসাবে গোজামিল দিয়ে দিচ্ছি প্রতি চার বছরে একবার। অর্থাৎ ৩২টি লিপ ইয়ার বা ১২৮ বছরে আবার এক দিন বাড়তি হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত এটা ইংরেজি ক্যালেন্ডারে কোন ঝামেলা করেনি, আমরা শুধু হজম করে নিচ্ছি। কিন্তু ১৫৫৬ সালে বাংলা বছরের প্রবর্ততন থেকে যদি শুরু করি তাহলে মোট ১২৮০ বছরে এটা ১০ দিনের ঝামেলা পাকাবে। সম্ভবত তার আগেই এটা ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলা বছরে লিপ দিনের কোন হিসাব ছিল না, তাই আবার বাংলা তারিখ পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই বিচ্যুতি ঠিক করার জন্য বাংলা একাডেমি ১৯৬৬ সালে প্রস্তাব করেঃ
- বছরের প্রথম পাঁচটি মাস, বৈশাখ থেকে ভাদ্র, হবে ৩১ দিনে
- বছরের বাকি সাতটি মাস, আশ্বিন থেকে চৈত্র, গঠিত হবে ৩০ দিনে
- তাহলে বছরে হচ্ছে মোট ৩৬৫ দিন
- বছর শুরু হবে ইংরেজি (গ্রেগরিয়ান) ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্র্রিল, এবং ইংরেজি ক্যালেন্ডারের প্রতি লিপ ইয়ার বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ হবে, ঠিক যেভাবে ফেব্রুয়ারিতে যোগ হয়। বাংলাদেশে ১৯৮৭ সাল থেকে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তাই আমাদের পহেলা বৈশাখ ১৯৮৭ সাল থেকে ১৪ এপ্রিলেই পড়ে।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা আর আসামে প্রচলিত বাংলা ক্যালেন্ডারে এখনো চাঁদ- সূর্যের অবস্থান দেখে বছরের শুরু নির্ধারণ করা হয়, তাই ভারতে পহেলা বৈশাখ মাঝে মাঝে ১৪ এপ্রিল, মাঝে মাঝে ১৫ এপ্রিল পড়ে।
২০১৫ ইংরেজি সালে বাংলা অ্যাকাডেমি এটার আরো পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশে নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এখন থেকে বাংলা বছরের প্রথম ছয় মাস ৩১ দিনে হবে।
এর আগে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র---বছরের প্রথম এই পাঁচ মাস ৩১ দিনে গোণা করা হত। এখন ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল লিপইয়ারের বছর ফাল্গুন ৩০ দিনের মাস হবে।
কিন্তু যদি পয়লা হিজরি = পয়লা তারিখ-এ-এলাহি বা বাংলা সন হয়ে থাকে, তাহলে এই বছর কেন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ কিন্তু ১৪৪১ হিজরি? উত্তরটা উপরে বলা আছে... ৯৬৩ বঙ্গাব্দ-র পর থেকে হিজরি চন্দ্র মাসেই চলতে থাকলো, কিন্তু বঙ্গাব্দ হয়ে গেল সৌর মাসে, অর্থাৎ প্রতি বছরে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতই বঙ্গাব্দ ১০.৬ দিন করে পিছিয়ে পড়তে থাকলো হিজরি থেকে। সিরাজীর এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর ৪৬৩ বছর পার হয়েছে। বছরে ১০.৬ দিন করে পেছালে ৪৬৩ বছরে ৪৯০৭.৮ দিন পিছিয়েছে বঙ্গাব্দ। তার সাথে যোগ হবে এই ৪৬৩ বছরের আরো ১১২ লিপ দিবস। এই মোট ৫০১৯ দিনের জন্যই প্রায় ১৪ বছরের তফাৎ হয়ে গিয়েছে হিজরি আর বঙ্গাব্দের।
আবারো নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।