বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০০ জনের বেশি মানুষ মারা যান বজ্রপাতে। ২০২১ সালে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ২৮২। এই তো কিছুদিন আগে এক বরযাত্রীদলেই মারা গিয়েছেন সতেরো জন। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাৎসরিক বজ্রপাতের সংখ্যার দিক দিয়ে হিসেব করলে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় শীর্ষে আছে। ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫০টা বজ্রপাত হয়, অর্থাৎ বছরে প্রায় ৬৫ লক্ষ বজ্রপাত ঘটে।
কিন্তু এই বজ্রপাত আসলে কী? কীভাবে আকাশের বুকে সৃষ্টি হয় এরকম হাই ভোল্টের বিদ্যুত? আর কিভাবেই তা পৃথিবীর বুকে এসে পড়ে? এই বজ্রপাত থেকে বাঁচতে আমরা কী করতে পারি?
একসময় মানুষ আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখে ভাবতো, দেবতাদের যুদ্ধ হচ্ছে আকাশে। আমরা এখন জানি, আকাশের বিদ্যুৎ আর আমাদের বাসার বিদ্যুৎ আসলে একই, শুধু মাত্রা আর নিয়ন্ত্রণের তফাত। মেঘের ভেতরে অতি ঠাণ্ডা ও শুষ্ক বাতাস ও অপেক্ষাকৃত গরম ও জলীয়বাষ্পে ভর্তি বাতাস যখন মেশে, তখন বরফের কুচি ও নরম শিলা বা গ্রাউপল তৈরি হয়।
আবার, দুইটা বস্তু, যেমন সিল্ক আর প্লাস্টিকের ঘর্ষণে স্থির-বিদ্যুত তৈরি হতে পারে। ধারনা করা হয়, ঠিক তেমনি বাতাসের ধাক্কায় বরফের কুচি আর গ্রাউপলের ঘষায় বরফের কুচিতে ধ্বনাত্মক আর গ্রাউপলে ঋণাত্মক চার্জ তৈরি হয়, আর সাধারণত মেঘের উপরের দিকে ধনাত্মক ও নিচের দিকে ঋণাত্মক চার্জ জমা হতে থাকে।
বিদ্যুতের স্বভাব হচ্ছে উচ্চ বিভব বা চার্জ থেকে নিম্ন বিভবের দিকে চার্জ চলতে চায়। কিন্তু বাতাস বিদ্যুতের ভাল পরিবাহী না, তাই সহজে এই চার্জের আদান প্রদান হয় না। কিন্তু বিভবের চাপ বাড়তে বাড়তে প্রতি সেন্টিমিটারে ৩০ হাজার ভোল্ট বা এর বেশি হলে এক সময় সেটা বাতাসের অপরিবাহিতায় (ইন্সুলেটিং প্রপার্টিতে) চিড় ধরায়, এবং বিশাল পরিমাণের চার্জ ওই চিড় বরাবর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যায়। এই চার্জের ছুটে যাওয়াকে আমরা দেখি বিদ্যুতের চমক হিসাবে।
ওদিকে শব্দের চাইতে আলোর গতি প্রায় আট লক্ষ বিরাশি হাজার গুন বেশি বলে আমরা বজ্রপাতের আলো আগে দেখি, আর তারপর শব্দ শুনি।
আর এর ফলে তৈরি হওয়া তাপের তাপমাত্রা পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেখানে সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই প্রচণ্ড তাপে বাতাসের খুব দ্রুত প্রসারণ হয়, আর যেহেতু বাতাসের কম্পনই শব্দ, তাই এই প্রসারণের থেকে তৈরি কম্পন আমাদের কানে ধরা দেয় বজ্রের গর্জন হয়ে।
এভাবে চার্জের ছুটে যাওয়া একই মেঘের ভেতরে হতে পারে, আবার পাশের মেঘের সাথেও হতে পারে। তবে আমাদের চিন্তা আরেক ধরনের বজ্র নিয়ে, যা মাটিতে আঘাত করে।
মাথার ওপর যখন মেঘে চার্জ জমা হতে থাকে, মাটিতে আবেশ বা ইনডাকশন প্রক্রিয়ায় তার বিপরীত চার্জ জমতে থাকে। যদি উঁচু কোনও গাছ বা বিল্ডিং থাকে, তাহলে সেটার চুড়োতে এই চার্জ জমার পরিমাণ বেশি হয়, এবং উচ্চতার কারণে সেটা মাটির তুলনায় মেঘের কাছাকাছিও থাকে।
গাছ বা বিল্ডিং থেকে মেঘের দিকে আর মেঘ থেকেও নিচের দিকে চার্জের প্রবাহ শুরু হয়। যদি এই দুইটা চার্জের প্রবাহ একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে, তাহলে রোধ বা রেজিস্ট্যান্স খুব দ্রুত কমে যায় এবং এই পথ ধরে মেঘের চার্জ ছুটে আসে নিচে, ঘটে বজ্রপাত।
মাটির কাছে থাকে বলে বজ্রাঘাতে মেঘ থেকে ঋণাত্মক চার্জ নেমে আসে ৯৫% ক্ষেত্রে, আর দূরে থাকে বলে ধ্বনাত্মক চার্জের বজ্রাঘাত হয় মাত্র ৫%। কিন্তু বেশী দূরত্ব অতিক্রম করতে বেশি চার্জ লাগে, তাই ধ্বনাত্মক চার্জের বজ্রপাত অনেক বেশি মারাত্মক।
মাটি থেকে কোন বস্তু যত বেশি উচ্চতায় থাকবে, সেটা মেঘের তত কাছে হবে। তাই সেখানে চার্জ জমবে বেশি, বজ্রপাতও হবে বেশি বার। নিউ ইয়র্কের এমপায়ার স্টেইট বিল্ডিঙে বছরে গড়ে ২৫ বারের মত বজ্রপাত হয়। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা যদিও তার চাইতে অনেক উঁচু, কিন্তু দুবাইয়ের আকাশে মেঘ থাকে না বলে সেখানে বজ্রপাত হয় অনেক কম, যদিও তাও বজ্রপাত হয়েছে বুর্জ খলিফায়। কিন্তু সেই বিল্ডিঙগুলির ক্ষতি হয় না কেন?
বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে সরাসরি মাটিতে ধাতব তার দিয়ে সংযোগ করা থাকলে বিদ্যুৎ বাসার ক্ষতি না করে মাটিতে চলে যায়; এটাকে আমরা আর্থিং বলি; যদিও এটার আসল নাম লাইটনিং অ্যারেস্টর।
বাসার বিদ্যুতের শক্তি মাত্র ২৪০ ভোল্ট; তাতেই মানুষ মারা যায় অনেক সময়। আর সেখানে বজ্রপাতের বিদ্যুতের শক্তি প্রায় ৩০ কোটি ভোল্ট--সেটা সরাসরি আঘাত করলে মৃত্যু তো হবেই। তবে বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে সরাসরি বজ্রপাতে মাত্র ৩-৫% মৃত্যু ঘটে, গ্রাউন্ড কারেন্ট বা মাটি তড়িতাহত হয়ে ৪০-৫০% এবং সাইড ফ্ল্যাশ লাইটনিং বা পার্শ্বীয় ঝলকানিতে ২০-৩০% মৃত্যু ঘটে। বাকি মৃত্যু ঘটে নিরাপদে স্থানে থেকেও পরিবাহীর মাধ্যমে বা আহত হয়ে ভোগান্তির পরে। কিছু লোক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও বেঁচে গেলেও তাঁরা ব্লান্ট ট্রমা এবং নানাবিধ শারীরিক, মানসিক এবং স্নায়বিক সমস্যায় ভোগেন।
সাইড ফ্ল্যাশ লাইটনিং-এ প্রথমে বজ্রপাতটা হয় গাছে বা অন্য কোন উঁচু স্থাপনায় যার সঠিক বজ্রনিরোধী ব্যবস্থা নাই। তারপর সেটা গাছ বা ওই স্থাপনা ভেদ করে আড়াআড়ি ভাবে বা পাশ থেকে মানুষকে আঘাত করে, তাই এটার নাম সাইড ফ্ল্যাশ বা পার্শ্বীয় ঝলকানি। এতে বজ্রপাতের শক্তি ও আঘাত করার ক্ষমতা অনেক কমে যায়, তবে তার পরেও সেটা মৃত্যু ঘটাতে পারে।
আর ভেজা মাটি বিদ্যুতায়িত হয়েও মারা যেতে পারে মানুষ, যা গ্রাউন্ড কারেন্ট নামে পরিচিত। এরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনাতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি বরযাত্রী দলের ১৭ জন একসাথে মারা গিয়েছেন বজ্রপাতে।
এরা সবাই বৃষ্টির কারণে নৌকা থেকে নেমে একটি ছোট্ট বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা বিহীন ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের ধারনা, সাইড ফ্ল্যাশ, ধাতব সংস্পর্শ এবং ভূমির বিদ্যুতায়ন - এই তিনটির এক বা একাধিক কারণে এই মৃত্যু ঘটেছে।
বজ্রপাত মৌসুম ও এলাকা নির্ভর। প্রাক মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ অর্থাৎ হাওর অঞ্চলে। বর্ষা মওসুমে বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে।
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।
সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী এসব অঞ্চলে বেশি হয় শীতকালে।
ভাইসালার সাত বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটে কৃষিকাজ করার সময়। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
আমরা আগে জেনেছি, বজ্রপাত হয় উঁচু বস্তুতে। বছরে যত বজ্রপাত হয় তার অর্ধেকেরও বেশি হয় মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে। এই সময়টায় কৃষকেরা মাঠে ব্যস্ত থাকেন। হাওর এলাকায় বেশির ভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই। সেখানে কৃষকের শরীরই মাঠে সবচাইতে উঁচু বস্তু, তাই সেখানেই বজ্রাঘাত হয়।
বাংলাদেশ সরকার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিচ্ছে নিরাপদ আশ্রয় ও অ্যাপের মাধ্যমে সাবধান বার্তাপাঠানোর জন্য। সেটা ছাড়াও তাহলে কী করলে বাঁচতে পারি আমরা? বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত জানিয়েছেন,
১) জনগণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। মেঘের গর্জন শুনলে খোলা মাঠ বা পানিতে থাকা যাবে না যদি আশেপাশে আরো উঁচু কিছু না থাকে।
২) তালগাছ বা যে কোন উঁচু গাছ, বাঁশঝাড়, এগুলো নিরাপদ আশ্রয় নয়। সাইডফ্ল্যাশ বা মাটি বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা সরাসরি আঘাতের চাইতে থেকে আরও বেশি।
৩) ঝলকানি দেখা ও শব্দ শোনার মাঝে যদি ৩০ সেকেন্ড বা তারচেয়ে কম সময় থাকে তাহলে জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ে অর্থাৎ পানিরোধী ছাদযুক্ত, শুকনা ফ্লোর বিশিষ্ট এবং বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা যুক্ত স্থাপনাতে ঢুকে পড়তে হবে। বজ্রপাত থেমে গেলেও অতিরিক্ত আরও ৩০ মিনিট ওখানে অবস্থান করে দেখতে হবে আবার বজ্রপাত শুরু হয় কিনা।
৪) বজ্রপাতের সময় পুকুরে বা এমনকি ঘরেও গোসল বা থালা বাসন ধোয়া উচিত না, কারণ ধাতব পানির পাইপে বজ্রপাত হয়ে সেটা পানি দিয়ে শরীরে আঘাত করতে পারে।
৫) ঘরের ভেতরেও সিমেন্টের মেঝেতে শোয়া বা দেয়ালে হেলান দেয়া উচিত নয়। কারণ দেয়াল বা মেঝের রড দিয়েও বজ্রপাতের ইলেক্ট্রিসিটি এসে আঘাত করতে পারে।
এই নিয়মগুলি মনে রাখলে হয়তো বেচে যেতে পারে আপনার বা আপনার পরিচিত কারও প্রাণ। তাই এই ভিডিও শেয়ার করে জানিয়ে দিন সবাইকে।
সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন, থিংকের সাথে থাকুন।