আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে কোন একদিন - পৃথিবীতে মানুষ ছিল না , কিন্তু প্রাণীর কোন অভাব ছিল না। আর তাদের মধ্যে সবচাইতে উপরের ধাপে ছিল ডাইনোসররা, বহু ধরণের, বহু আকারের ডাইনোসর - যারা তারও ১৬ কোটি বছর আগে থেকে রাজত্ব করে আসছিল আমাদের এই গোলকে। তারা কি সেদিন , আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ভেবেছিল, ঐ নতুন আলোটা কী একটা দ্বিতীয় চাঁদ? তাদের বিশাল দেহের তুলনায় ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কি বেজে উঠেছিল কোন বিপদসংকেত? নাকি তখন বেঁচে থাকা কোন প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা এতদূর চিন্তা করার মত বিকশিত হয় নাই?
সেই আলো? সেটা ছিল প্রায় এভারেস্টের সমান সেই গ্রহাণু থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো। ধেয়ে আসা সেই প্রকাণ্ড গ্রহাণুটা মেক্সিকোর উপকূলে আঘাত করে ২০০০টারও বেশী হিরোশিমার অ্যাটম বোমার শক্তি নিয়ে। ফলে তৈরি হয় অকল্পনীয় ভূমিকম্পের, ধেয়ে আসে বিশাল সুনামি, তারপরে যে পাথরগুলো বাষ্পীভূত হয়ে হাজার হাজার মাইল উপরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তারা গনগনে আগুন হয়ে নেমে আসে পৃথিবীর নানা অংশে যা থেকে শুরু হয় দাবানল, পাথরের গলিত সালফারে সমুদ্রের পানি হয়ে যায় অ্যাসিডিক। উৎক্ষিপ্ত ধুলার মেঘে সূর্য ঢাকা পড়ে থাকে মাসের পর মাস, পৃথিবীতে দেখা দেয় এক পরিবেশ বিপর্যয়। প্রথমেই মারা যায় অনেক উদ্ভিদ, ফলে না খেতে পেয়ে মারা যায় অনেক নিরামিষাশী প্রাণী। তারপর মারা যেতে থাকে সেই সব প্রাণীকে যারা খেত, সেসব মাংসাশী প্রাণী। যে প্রাণী যত বড়, তাদের খাদ্যচাহিদা তত বেশি। তাই বড় প্রাণী, অর্থাত মাটিতে চড়ে বেড়ানো বড় ডাইনোসররা সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে তিন-চতুর্থাংশ প্রজাতি।
এ তো ছিল সেই অভিঘাতের পরের কয়েক মাস ধরে ব্যাপী বিলোপ পাওয়া। কিন্তু কেমন ছিল সেই দিন, যেদিন মহাকাশের এই আগন্তুক ডাইনোসরদের ১৬ কোটি বছরের রাজত্বের অবসান ঘটিয়েছিল? চলুন, বিজ্ঞানের সাথে কল্পনার রথে চড়ে ঘুরে আসি সেই দিনটা থেকে, যেদিন হয়েছিল এই পৃথিবীর সবচাইতে বড় প্রজাতিহত্যা, অন্যতম বড় মহাবিলুপ্তি।
গাছ, ফুল, ফল, ফার্নে ভরপুর ছিল সাড়ে ছয় কোটি বছর আগের সেই দিনটা। হাজার হাজার কোটি প্রাণীর পদচারনায়, তাদের শব্দে বাতাস ছিল মুখর। টাইরানোসোরাস রেক্সের মত ঘাতক ডাইনোসরের সাথে ছিল টাইটানোসোরাসের মত বিশাল কিন্তু নিরীহ ডাইনোসররাও, ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী ছাড়াও আরো বহু ধরণের প্রাণী, বহু কীট পতংগ। তার একদিন আগে, অথবা এক লক্ষ দিন আগের সাথে কোন তফাৎ ছিল না সেই দিন টার।
শুধু, শুধু আকাশের সেই ছুটে আসা আলোটা বাদে। আলোটা কয়েক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে বড় আর উজ্বল হয়ে উঠছিল।
কিন্তু সেই আঘাত থেকে বাঁচার উপায় ছিল না কারুরই সেদিন। আকাশে আরেকটা সূর্যের মত আলো ছড়িয়ে, শব্দের প্রায় ষাট গুন বেশী গতিতে ছুটে এসেছিল সেই ঘাতক গ্রহাণু। বায়ুমণ্ডলের সীমানার বাইরে থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নামতে সেটার সময় লেগেছিল দুই সেকেন্ডেরও কম, আর এই অতি দ্রুত বেগে নামার সময় বায়ুমণ্ডলের সাথে ঘর্ষনে সেটা হয়ে উঠেছিল গনগনে গলিত পাথর আর ধাতু। বাষ্পীভূত হচ্ছিল তার কিছু অংশ। তার পরেও এই বিশাল গ্রহাণুর অধিকাংশই টিকে থাকে এবং প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোন করে আঘাত হানে মেক্সিকোর উপকূলে, ইউকাটান উপদ্বীপের কাছের চিক্সিলুব-এ।
ঘন্টায় ৭২ হাজার কিলোমিটার বেগে যখন এই মহাকাশের পাহাড় আছড়ে পড়ে মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিন্সুলায় , তখন তার ভরবেগের ফলাফল হয় কয়েক হাজার আণবিক বোমার সমান। সেই ধাক্কায় সমুদ্রের পানি সরে যায় শতশত কিলোমিটার। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে দশ হাজার ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রার আগুনের হল্কা গলিয়ে দেয় সমুদ্রতলদেশের পাথরকে, এবং সেই গ্রহাণুর ভরের ষাট গুনেরও বেশী পাথর উৎক্ষিপ্ত হয় বায়ুমণ্ডলে ও মহাকাশে। কিছু উৎক্ষিপ্ত পাথর আঘাত হানে চাঁদে, এমনকি মঙ্গল গ্রহেও। আলোর গতিতে সেই আঘাতের তাপ ছড়িয়ে যায় চারদিকে; দেড় হাজার কিলোমিটারের ভেতরে যা ছিল, সব আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাতাসের তাপমাত্রা হয়ে যায় শত শত ডিগ্রি। পানির নিচে বা গুহার ভেতরে আশ্রয় নিতে না পারা সব প্রাণী নিমেষে মারা যায়।
সমুদ্রের তলদেশে তৈরি হয় ২৫ কিলোমিটার গভীর ও ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের এক অভিঘাত গহ্বর। সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় রিখটার স্কেলে ১১ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের ভারত উপমহাদেশেও সেই ভূমিকম্পের ফলে ধরে ফাটল, শুরু হয় অগ্ন্যুৎপাত। সেই ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতের লাভায় ঢাকা পড়ে বর্তমান ভারতের অর্ধেকেরও বেশি।
আর এদিকে পানির আন্দোলনে শুরু হয় সুনামি, যার ঢেউয়ের উচ্চতা দাঁড়ায় এক কিলোমিটারেরও বেশি। শুরু হয় ঘন্টায় হাজার কিলোমিটার বেগের সাইক্লোন। এধরনের সাইক্লোন বা ভূমিকম্প এর আগে বা পরে পৃথিবীতে আর হয় নি।
আর বায়ুমণ্ডলে ছিটকে যাওয়া গলিত পাথরগুলি?
তাদের বেশিরভাগ মাধ্যাকর্ষনে আবার নিচের দিকে নামতে থাকে, এবং বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষনে সেগুলিও হয়ে ওঠে গনগনে আগুনের গোলা। যেখানেই সেগুলি পড়ে, সেখানেই ধরে যায় আগুন।
আর যদি মাটিতে না পড়ে সেগুলি সমুদ্রে পড়ে? তাহলে সালফার-সমৃদ্ধ সেই সব পাথরের বের হয়ে আসা সালফার পানির সাথে মিলে তৈরি করে সালফিউরাস আর সালফিউরিক অ্যাসিড, সমুদ্রের পানি রাতারাতি হয়ে যায় অ্যাসিডিক, অনেক সামুদ্রিক জীবের জন্য অবাসযোগ্য।
যে সব প্রাণী আগুনে পূড়ে, সুনামিতে, ভূমিকম্পে বা বাতাসের ধাক্কায় মারা যায়নি, তাদের দূর্ভোগ কিন্তু এখানেই শেষ হলো না। ধুলোর মেঘ আর বিশ্বব্যাপী আগুনের ধোয়া বায়ুমণ্ডলে পৌঁছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঢাকা পড়ে সূর্য, একমাত্র আলো থাকে চারপাশে জ্বলতে থাকা আগুন। বিশ্বের তাপমাত্রা রাতারাতি কমে যায় ২৫ ডিগ্রির মত, সেই ঠান্ডা আবহাওয়া থাকে বহুদিন। অনেক প্রাণী মারা যায় এই ঠাণ্ডা সইতে না পেরে। সূর্যালোক না পেয়ে সালোকসংশ্লেষণ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মারা যেতে থাকে সমুদ্রের প্ল্যাঙ্কটন। ফলে বিপর্যয় নামে জলজ খাদ্য-শৃঙ্খলে। যেসব প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন খেতো, তারা মারা যেতে থাকে, তারপর সেই কারনে মারা যেতে থাকে তাদের উপরের প্রাণীগুলো। ডাঙ্গাতেও নামে একই বিপর্যয়। আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল অনেক উদ্ভিদ। যেগুলি বেচে গিয়েছিল, তাদের বেশিরভাগও এবার খাদ্যের অভাবে মারা গেল। ফলে মারা যেতে শুরু করলো নিরামিষাশী প্রাণীরা। তারপর মারা যেতে শুরু করলো সেইসব মাংসাশী প্রাণী যেগুলি উদ্ভিদভূক প্রাণীগুলিকে খেত। আকারের সাথে খাদ্যের পরিমাণ বাড়তে থাকে, ফলে মাটিতে চড়ে বেড়ানো বড় ডাইনোসরগুলি মারা গেল প্রথমে। ছাই আর মৃত প্রাণীর দেহাবশেষে ঢাকা পড়ে থাকলো পৃথিবীর মাটি। সমুদ্রের নিচে জমলো প্ল্যাঙ্কটন আর মাছের মৃতদেহ। ঠাণ্ডা, অন্ধকার পৃথিবীতে আধিপত্য দেখা দিল ছত্রাকের। প্রায় ৭৫% জীব বিলুপ্ত হয়ে গেছিল সেই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে সেদিন।
পাখির পূর্বপুরুষ ছোট পাখাওয়ালা ডাইনোসর বেঁচে গেল, আমরা পাখীর বিবর্তনের ভিডিওতে দেখেছিলাম তাদের থেকেই বিবর্তিত হয়েছে আজকের দিনের পাখিরা। আরো বেচে গেল অন্য কিছু ছোট প্রাণীর সাথে ইঁদুরের মত ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। ডাইনোসরেরা জায়গা খালি করে দেওয়ার পরে এরাই সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে বিকশিত ওঠে পৃথিবীতে, যাদের থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয় মানুষ এবং আমাদের অন্যান্য পূর্বপুরুষরা।
সেই গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী রাতারাতি বদলে না গেলে, আর ডাইনোসরদের যুগ শেষ না হলে কে জানে কেমন হতো আজকের পৃথিবীর জীবেরা!
মেক্সিকোর উপকূলে, সমুদ্রের নিচে এখনো সেই গর্তটা আছে। আমরা কীভাবে জানলাম সেখানে আঘাত হেনেছিল বিশাল গ্রহাণু? কীভাবে বুঝলাম সেটা ঘটেছিল সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে? সেটা প্রায় ডিটেকটিভ গল্পের মতই আকর্ষনীয়। বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকে খুঁজছিলেন ডাইনোসরদের উধাও হয়ে যাওয়ার কারন। ফসিল পরীক্ষা করে তারা আগেই জেনেছিলেন, সাড়ে ছয় কোটি বছরের কম বয়সের কোন ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায় না। চিক্সিলুবের গহ্বর যখন আবিষ্কার হলো ১৯৮০ সালে, বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখলেন, সেখানে গলিত পাথর এক ধরনের কোয়ার্জে রূপান্তরিত হয়েছে, যেটার জন্য দশ হাজার ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা লাগে, যা আগ্নেয়গিরি থেকে আসতে পারে না। সেই গহ্বরের দেয়ালের কোন থেকে অনুমান করা গেল, ৬০ ডিগ্রি কোনে কিছু আঘাত করেছিল। পাথরে ইরিডিয়ামের আইসোটোপ থেকে বের করা হলো এর মহাজগতিক আদি ঠিকানা। আভিঘাত গহ্বরের আকার, গভীরতা, পাথর গলার তাপমাত্রা মিলিয়ে বের করা হলো সেই সঙ্ঘর্ষের মোট শক্তির পরিমাণ। বছরের পর বছর গবেষণা করে বের করা হলো, পৃথিবীর পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে। আমরা জানলাম, কেন ডাইনোসররা আর নেই।
যদি এই সংঘাত না হতো?
যদি ডাইনোসররা থাকতো এই পৃথিবীতে? আমাদের পূর্বপুরুষ সেই ছোট্ট স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে কি বিবর্তিত হতে পারতো ধাপে ধাপে বুদ্ধিমান মানুষে? অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন ডাইনোসরেরা সেভাবে রাজত্ব করতে থাকলে স্তন্যপায়ী প্রাণিদের এরকম্ভাবে বিকাশ ঘটার সুযোগ নাও হতে পারতো!