ডাইনোসর থেকে পাখির বিবর্তন! How did birds evolve from dinosaurs? | Think Bangla

.

ভাবুন তো, দৈত্যাকার, সেই মন্থর গতির ডাইনোসরগুলো ডানা মেলে উড়ছে আকাশে! উদ্ভট মনে হলেও, বিজ্ঞানীরা গত দেড়শো বছরের দীর্ঘ তর্কবিতর্ক, গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন,  ডাইনোসর থেকেই এসেছে সব আধুনিক পাখি। তাহলে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে, প্রকাণ্ড সেই গ্রহাণুর প্রলয়ঙ্করী ধাক্কায় বিলুপ্ত হয়ে  যায়নি ডাইনোসরেরা? এখনো দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে? আসুন আজকে, সেটাই জেনে নেই থিংক-এর বন্ধু, জীবাশ্মবিদ Dr. Jingmai O'Connor-এর কাছ থেকে, যিনি নিজেই পাখির বিবর্তনের গবেষণায় আকণ্ঠ ডুবে আছেন। 



মানুষের বিবর্তন নিয়েও এতটা কষ্ট করতে হয়নি জীববিজ্ঞানীদের, যতটা সমস্যা এবং ধাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন এই পাখির বিবর্তন নিয়ে। ডারউইন সেই ১৮৫৯ সালে প্রস্তাব করলেন, সব জীবের অনবরত বিবর্তন ঘটছে এবং মানুষসহ গাছপালা, পশুপাখি সবই, আগের কোনো জীব থেকে বিবর্তিত হয়েছে। বিবর্তনতত্ত্ব যদি সঠিক হয় তবে পাখিকেও কোনো না কোনো সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আসতে হবে, তাহলে তাদের পূর্বসূরিদের বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের মধ্যবর্তী ফসিলগুলোও পাওয়া যাবে কোথাও না কোথাও! আর, সমস্যার শুরু সেখানেই। 


অন্যান্য প্রায় সব ধরনের প্রাণীকে তাদের পূর্বসূরির সাথে সংযুক্ত করা গেলেও ফসিল রেকর্ডে  পাখির মত কোন আদিম  প্রাণী পাওয়া যাচ্ছিল না: ওড়ার জন্য পাখা, পালকে ঢাকা শরীর, উইশবোন, বুকের বিশাল শক্ত পেশি, দাঁতহীন মুখ, ফাঁপা হাড়, তিন আঙুল। বড়ই মুশকিলে পড়ে গেলেন তারা। অনেকেই এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে বিবর্তন তত্ত্বের অসাড়তাও প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে গেলেন। বছর দু'য়েকের মধ্যেই জার্মানিতে পাওয়া গেল আর্কিওপ্টেরিক্সের জীবাশ্ম। ১৫ কোটি বছরের পুরনো, পাখির মত তিন ভাগে বিভক্ত পালকসহ পাখা কিন্তু আবার ওদিকে ডাইনোসরের মত লম্বা লেজ ও দাঁতওয়ালা চোয়াল, নখর। আধুনিক পাখি এবং ডাইনোসরের যেন এক অদ্ভুত মিশ্রণ! 


ডারউইনের বুল ডগ নামে পরিচিত জীববিজ্ঞানী থমাস হাক্সলি এ থেকে হাইপোথিসিস বা প্রকল্প দিলেন: পাখিরা ডায়নোসরদের মত সরীসৃপদের থেকে এসেছে! কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনেকেই মেনে নিতে পারলেন না। এত ধীরে-চলা, প্রকাণ্ড সব ডাইনোসরের সাথে মিল কোথায় পালকে-ঢাকা, ডানায় ভর করে উড়ে-বেড়ানো ছোট্ট পাখিদের? 

আর তাছাড়া সব ধরনের পাখির বুকের ওপরে যে-উইশবোন দেখা যাচ্ছে সেটাই বা কোথায়? মুরগি কাটার সময় তার ঘাড়ের কাছে V-এর মত হাড়টি কখনো খেয়াল করেছেন? শরীরের  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই হাড়টিই পাখিদের বুকের শক্ত পেশিগুলো ব্যবহার করে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে উড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড শক্তি জোগায়। আমাদেরও কিন্তু এই হাড় দুটো আছে, তবে তারা একসাথে যুক্ত নয়। 


ডায়নোসর থেকে পাখির বিবর্তন নিয়ে প্রায় ১০০ বছর ধরে চললো বৈজ্ঞানিক তর্ক-বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত, ১৯৬৩ সালে, জীবাশ্মবিদ জন ওস্ট্রমের দল খুঁজে পেলেন সাড়ে এগারো কোটি বছর  আগের ছোটো একধরনের শিকারি ডায়নোসর, Deinonychus হাড়ের গড়ন এবং ভয়ঙ্কর থাবাই বলে দিচ্ছে তারা ছিল ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন এবং নির্মমভাবে ছিঁড়ে খেত তাদের শিকার। ওস্ট্রম তুলনা করে দেখালেন, আর্কিওপ্টেরিক্স এবং Deinonychus দুজনেরই হাত লম্বা, একই রকমের ঘাড়, কোমড়ের হাড় এবং আধুনিক পাখির মতই হাড়ের ভিতরেটা ফাঁপা। পাখিদের মতই ইংরেজি অক্ষর 'S' আকৃতির গলাও দেখা যাচ্ছে ডাইনোসরদের, খুঁজে পেলেন সেই উইশবোনও।


বললেন, হাক্সলির হাইপথিসিস বা প্রকল্পই ঠিক ছিল। সব ডায়নোসরেরা Saurapodদের মত বিশাল ছিল না বা ধীর গতিতে চলাফেরাও করতো না। পাখি এসেছে আরেক ধরনের ডাইনোসর থেরোপড থেকে, যাদের অনেকেই ছিল সাইজে ছোট, উষ্ণ রক্তের, সক্রিয় এবং ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। টি-রেক্স থেকে পাখি বিবর্তিত হয়নি, কিন্তু তারা সেই একই থেরাপড clade বা দলের অন্তর্ভুক্ত। মুরগির পায়ের সাথে টি-রেক্সের পায়ের পাতা মিলিয়ে দেখেছেন? বা এই সাউদার্ন ক্যাসওয়েরির (Southern Cassowary) সাথে! কী অদ্ভুত মিল! 


এরপরে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেলেন ডিমসহ ডায়নোসরদের বাসা। মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমিতে পাওয়া গেছে ৮ কোটি বছরের পুরনো ৫০টি ডায়নোসরের ডিমসহ ১৫টি বাসা। অর্থাৎ আজকের  পাখিরা যে দল বেঁধে বাসা তৈরি করে, ডিমে তা দেয়, বাচ্চা লালনপালন করে, তার সূচনা ঘটেছিল কোটি কোটি বছর আগে, আদিম ডায়নোসরদের মধ্যেই। ডায়নোসরদের নাম ভুল করে টেরিবল লিজার্ড দেওয়া হলেও তারা আসলে বেশ মমতাময়ী বাবা-মা ছিল! আশির দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা ডায়নোসর থেকে পাখির উদ্ভবের প্রকল্পটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে  শুরু করলেন। নব্বই দশকে, চিন দেশের কৃষকেরা খুঁজে পেতে শুরু করলেন মেসোজয়িক এবং ক্রেটেইসিয়াস যুগের প্রথম দিককার হাজার হাজার ছোট ডায়নোসরের ফসিল। অনেক ফসিল এত ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়েছে যে তাদের ভেতরের অঙ্গগুলোও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। 

পাওয়া গেল টিরানোসর গোত্রের Dilong Yutyrannus: পালকে আবৃত, ছোট থেরোপড ডায়নোসর; Sino-sauropteryx: ছোট্ট, দ্বিপদী, আঁশ নেই, শরীর ঢাকা আদিম এক ধরনের আদি পালক বা প্রোটো-ফেদার দিয়ে। ময়ুরের মত দেখতে Caudipteryx; Confuciusornis যাদের লেজের হাড় তখনো লম্বা কিন্তু পাখির মত ঠোঁট; Fukuipteryx prima: লেজের হাড় সংযুক্ত হয়ে ছোটো হয়ে এসেছে আধুনিক পাখির মত; চার ডানা বিশিষ্ট Microraptor যাদের গায়ের পালক অনেকটাই আধুনিক পাখির মত। এভাবে একের পরে পাওয়া গেল বহু মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যের ফসিল: দাঁতসহ এবং পাখিদের মত দাঁতবিহীন ডায়নোসর, বিভিন্ন ধরনের ঠোঁট, পালক এবং পাখাসহ উড়তে সক্ষম আবার উড়তে অক্ষম, বিভিন্ন ধরনের ফসিল, বাদুড়ের মত পাখা, ঘুমন্ত অবস্থায় ফসিল হয়ে-যাওয়া, ৬ কোটি ৮০ লক্ষ বছরের পুরনো, কিন্তু আধুনিক হাঁসের মত ডায়নোসর। এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করলো: - থেরোপড ডায়নোসরদের হাতই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে পাখির ডানার। ডানার এবং পালকের বিবর্তন মোটেও ওড়ার জন্য ঘটেনি। পাখিরা উড়তে-পাড়ার বহু আগেই, আদিম ডায়নোসরদের মধ্যে পালকের বিবর্তন ঘটেছিল মিউটেশন থেকে যা হয়তো তাপ সংরক্ষণ বা যৌন মিলনে আকর্ষণ সৃষ্টি বা অন্য কোন সুবিধা দেওয়ায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় টিকে গিয়েছিল। একইভাবে ডানার উদ্ভব এবং ডানা ঝাপ্টানোর বিবর্তনও ঘটে ডায়নোসরেরা উড়তে-পারার বহু আগেই। - আরকিওপটেরিক্স থেকে আজকের আধুনিক পাখির বিবর্তন ঘটেছে প্রায় ১৬ কোটি বছর ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের হাত ধরে, কনভারজেন্ট বা সমান্তরাল বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়। তৈরি হয়েছে অসংখ্য রকমের বিচিত্র সব ডানা, পালক এবং ভেসে-থাকা ও ওড়ার পদ্ধতির প্রকরণ বা ভেরিয়েশন বিভিন্ন ডায়নোসরের মধ্যে। তাদের মধ্যে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে যারা অভিযোজিত হয়েছে, বেশি বংশবৃদ্ধি করতে পেরেছে তারাই টিকে থেকেছে। আর ধীরে ধীরে বিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন ধরনের কার্যকরী ওড়ার পদ্ধতির। সরলরৈখিকভাবে ডায়নোসর থেকে আসেনি পাখিরা, অন্যান্য জীবের বিবর্তনের মতই, প্রকৃতির বহু রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে, দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথে ঘটেছে জটিল কিন্তু অপূর্ব এই বিবর্তন।ধীরে ধীরে গত তিন দশকে হাজারো ফসিল রেকর্ড, আণবিক জীববিদ্যা এবং জেনেটিক্স-জিনোমিক্সের গবেষণা থেকে সমাধান হলো প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এক বৈজ্ঞানিক ধাঁধার一গড়ে উঠলো পাখির বিবর্তনের এক দীর্ঘ এবং পরিষ্কার ছবি। টেরোসরদের মত সেই ভয়ঙ্করী, বিশাল উড়ন্ত ডায়নোসরদের থেকে নয় বরং এদের মত ছোট্ট থেরোপডদের থেকেই বিবর্তিত হয়েছে আমাদের আধুনিক পাখিরা। প্রলয়ঙ্করী গ্রহাণুর আঘাতে সেদিন বেশিরভাগ ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, শতকরা ২০ ভাগের মত জীবজগত তারপরেও টিকে যায়। আর একদল ছোটো, দ্বিপদী, ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন, পাখির মত ডানা এবং পালকে আবৃত থেরোপড ডায়নোসররাও সেদিন টিকে যায়। আর সেই ভয়ঙ্কর গণবিলুপ্তির পর, প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ায়, ছোট্ট স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মতই এই থেরোপডদেরও দ্রুত বিকাশ ঘটতে শুরু করে।এই যে আমরা আজ চারদিকে, গাছে, মাটিতে, পানিতে, মরুভূমিতে, সব ধরনের পরিবেশে ১০ হাজারেরও বেশি বিচিত্র সব প্রজাতির পাখির আনাগোনা দেখছি, তারা আধুনিক ডায়নোসর ছাড়া আর কিছুই নয়।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles