ডাইনোসর! ডাইনোসরেরা কি জুরাসিক পার্ক সিনেমার মত ছিল? | Jurassic park dinosaurs | Think Bangla

.

টি-রেক্স কি কখনো ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমার ডাইনোসর এর মতো এভাবে রক্ত-হিমকরা গর্জন করতে পারতো? তারা কি এত জোরে দৌড়াতে পারত? ভেলোসিরাপটররা কি আসলেই এত্ত বড় ছিল? আমরা ফসিল রেকর্ড থেকে জানি যে, কোটি কোটি বছর ধরে রাজত্ব করার পরে, প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই ডাইনোসরেরা। দেখেছিলাম জীবাশ্মবিদেরা সিনেমার ল্যাবরেটরিতে শিল্পীদের সাথে বসে এমন করে ডাইনোসরগুলো বানান যে তাদের আকার, নড়াচড়া, শারীরিক বিন্যাস সবকিছুই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে আমাদের চোখের সামনে। আজকে আমরা ডাইনোসরদের সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে যা জানি তার তার অনেক কিছু ফুটিয়ে তোলা হয় এই মুভিগুলোতে, কিন্তু আবার একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে বহু ভুলভাল জিনিসও কিন্তু দেখানো হয় সেখানে। 


আমাদের থিংক-এর বন্ধু জীবাশ্মবিদ এবং জুরাসিক ওয়ার্ল্ড সিনেমার কন্সাল্ট্যান্ট প্রফেসর সুমিডা বলেন, “জুরাসিক পার্ক তো আর বিজ্ঞান বা জীবাশ্মবিজ্ঞান নিয়ে বানানো কোনো সিনেমা নয় বরং এগুলোকে দেখা উচিত  দৈত্যদানবের সিনেমা হিসেবে যাদের উপর ডাইনোসররা এসে ভর করেছে।” মনে রাখতে হবে, দিনের শেষে  সিনেমার পরিচালকেরা বানান বিনোদন এবং বাণিজ্যিক দিকটা মাথায় রেখেই তাঁরা অনেক আজগুবি জিনিসপত্রও  গুঁজে দেন সেখানে। এই সিনেমাগুলো যেন ব্লকবাস্টার বিনোদন আর প্রাগৈতিহাসিক সেই বাস্তবতার মাঝামাঝি কোথাও বিরাজ করে।চলুন তাহলে একটু খতিয়ে দেখা যাক কী ধরনের ডাইনো-কল্পকথা তৈরি করেছে এই মুভিগুলো। 


আসুন, প্রথমে তাকাই আমাদের এই  সুপারস্টার ডাইনোসরের দিকে। একে দেখলেই কী মনে হয় বলেন তো? আমার তো সিনেমার পর্দায় দেখা সেই ভয়াবহ গর্জন আর হুঙ্কারের কথাই মনে পড়ে প্রথমে...কিন্তু...কিন্তু এই টি-রেক্সরা কি সত্যিই এভাবে গর্জন করতে পারত? বা শুধু  টি-রেক্স কেন, কোনো ডাইনোসরই কী আসলে এভাবে লোম খাড়া করানো হুঙ্কার ছাড়তে পারতো?কোটি কোটি ডায়নোসেরর ফসিল উদ্ধার করেছেন বিজ্ঞানীরা গত কয়েকশো বছরে এবং সেসব ফসিলের মস্তিষ্ক,  বুকের খাঁচা, নাকের গর্ত দেখে ডাইনোসরের শব্দ করা সম্পর্কেও আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। ডাইনোসরদের সম্ভবত এরকম জোরে হুঙ্কার করার কোন ক্ষমতাই ছিল না। 


হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন, ডাইনোসরেরা আসলে কোন গর্জন বা হুঙ্কার করতে পারত না। তারা হয়তো সাপের হিসহিসানির মত শব্দ করতে পারতো, বিকট শব্দ করে দাপিয়ে বেড়ানোর বদলে হয়ত উটপাখি বা বড়জোর কুমিরের মত শব্দ করতো তারা। আবার ধরুন, মুভিতে যে টি-রেক্সদের যে এভাবে দৌড়াতে দেখি, আসলেই কি বাস্তবে তারা এভাবে ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারত? অবশ্যই না। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ প্রফেসর জন হাডসন প্রমাণ করে দেখিয়েছেন টি-রেক্স কখনোই এত জোরে দৌড়াতে পারত না। তারা ঘন্টায় বড়জোর ১০ কিলোমিটার গতিতে দৌড়াত। এর থেকে বেশি গতিতে দৌড়ালে তাদের  নাকি শুধু পড়ে যাওয়ারই কথা নয়, একটা বড়সড় তরমুজের উপর থেকে ধপাস করে পড়ার মতই  পড়ে নাকি ফেটে যাওয়ার কথা। 


পরিচালক, শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা সবাই তাঁদের নিজেদের ধারণা এবং কল্পনাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেন এই সিনেমাগুলোতে। এবং শেষ পর্যন্ত সব দিক দেখেশুনে হয়তো সিদ্ধান্ত নেন ঠিক কীভাবে এদের বানানো হবে যাতে করে আর্ট, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের এক মোহনীয় সম্মেলন ঘটে এতে। কখনো কখনো এতে বিজ্ঞানের জয় হয়, কখনো বা শিল্পের আবার কখনো কখনো স্রেফ বিনোদন এবং বাণিজ্যিক দিকের কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞানের ধারেকাছেই ঘেঁষেন না তারা। আবার কখনো বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার খাপ খাওয়াতে না পেরে সম্পূর্ণভাবে সরে আসেন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থেকে। যেমন ধরুন জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের সিনেমাগুলো বানানোর সময় এর নির্মাতারা ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গেছিলেন  ডাইনোসরের শরীরের ত্বক বা চামড়া নিয়ে। 


‘৯৩ সালে প্রথম যখন জুরাসিক পার্ক সিনেমা বানানো হয় তখন আমরা জানতাম ডাইনোসরদের চামড়া এরকম নুড়ি-বেলে পাথরের মত অমসৃণ, খসখসে। কিন্তু গত দশকেই আমরা জেনে গেছি যে, ডাইনোসরের শরীর ছিল আসলে লোমশ। বেশিরভাগ মাংসাশী ডাইনোসরগুলোর শরীরের পালক ছিল রীতিমত নাকি রঙচঙা এবং আকর্ষণীয় উজ্জ্বল পালক। আমরা এখন এও জানি যে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে সব ডাইনোসররা কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এক ধরনের ডাইনোসর টিকে যায় এবং তাদের থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয় আজকের দিনের সব পাখি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এই পাখিদের মতই তাদের পূর্বসূরিদের শরীরেও পালক ছিল। এখন ২৫ বছর পরে জুরাসিক পার্কের সিকুয়াল হিসেবে জুরাসিক ওয়ার্ল্ড বানাতে গিয়ে তাঁরা তো রীতিমত বিপদে পড়ে গেলেন। জুরাসিক পার্কে যে ডাইনোসরদের পালক ছাড়া দেখিয়েছিলেন আজকে রাতারাতি সেই একই ডাইনোসরের গায়ে তো আর পালক বসিয়ে দেওয়া যায় না! এখন কী করবেন তারা? ড. সুমিডা বলেন অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষ পর্যন্ত পরিচালকেরা নাকি সিদ্ধান্ত নেন যে বৈজ্ঞানিকভাবে যাইই থাকুক কেন, জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের ডাইনোসরদের তাঁরা আগের মত পালক ছাড়াই বানাবেন।   


এই ভেলোসিরাপটরদের যে শুধু পালক ছিল তাইই কিন্তু নয়, তারা কিন্তু আকারেও এত বড় ছিল না। তারা আসলে ছিল টার্কি সাইজের মুরগির মত। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, তারা আসলে ছিল কিম্ভূতকিমাকার একটা বড় লেজওয়ালা পাখির মত, যারা উড়তে পারতো না, কিন্তু ইগলের মত তীব্র ধারালো নখরযুক্ত থাবা আর দাঁত দিয়ে  শিকার ধরে ছিঁড়ে খেত। জুরাসিক পার্ক সিনেমার আরেকটা বড় গরমিল কী শুনবেন? ভূতাত্ত্বিক যুগগুলোর একটা যুগ হচ্ছে এই জুরাসিক যুগ। এখানে সিনেমাগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে এই জুরাসিক দিয়ে: জুরাসিক পার্ক, জুরাসিক ওয়ার্ল্ড, অথচ সিনেমার সুপার স্টার টি-রেক্স, ট্রাইসেরাটপস এবং ভেলোসিরাপটরেরা এই যুগে জন্মায়ইনি। বিশ্বমঞ্চে তাদের আবির্ভাব ঘটে আরও অনেক পরে, সেই ক্রেটাসিয়াস যুগে। কিন্তু ধরুন ‘ক্রেটাসিয়াস পার্ক’ শুনতে কেমন শোনাবে? জুরাসিক পার্ক-এর মত ঠিক এতটা সেক্সি তো শোনাবে না, তাই মহাভুল করে হলেও এই নাম রাখা হয়েছে জুরাসিক যুগ দিয়েই। এবার আসি এই মুভিগুলোর এক্কেবারে গোড়ার ভুলে যেখান থেকে সব কিছুর শুরু, সেইইইই যে রক্তখেকো মশার পেট থেকে ৮ কোটি বছর আগের  ডিএনএ বের করে আনা হয়েছিল! সেখান থেকে ক্লোনিং করেই তো এই ডাইনোসর বানানোর গপ্পো ফাঁদা হয়েছে এই মুভিগুলোতে। কিন্তু, আসলে কি এটা সম্ভব? 


এখন আমাদের প্রযুক্তি এমন এক জায়গায় এসে পৌছেছে যেখানে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা আর এক্কেবারে অসম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিককালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া তাসমেনিয়ান বাঘ বা ম্যামথের ক্লোনিঙের কথা ভাবছেন। কিন্তু সেগুলোতো কয়েকশ বা কয়েক হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী। ক্লোনিং করতে দরকার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর ব্যবহারযোগ্য ডিএনএ। সমস্যা হলো অন্যান্য সবকিছুর মত ডিএনএ ও সময়ের সাথে সাথে ক্ষয় হয়, যদিও ডিএনএর এই ক্ষয় ঠিক কী হারে হয় সেটা নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে করে আদর্শ পরিবেশেও ১৫ লাখ বছরের বেশি পুরনো কোনো ডিএনএ আর ব্যবহারের মত অবস্থায় থাকে না। আর সেখানে ডাইনোসরেরা তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। সমস্যাটা কী তা তো বুঝতেই পারছেন! তবে ডাইনোসর নিয়ে এই সিনেমাগুলোতে এত ভুল থাকা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হয় যে এই সিনেমাগুলো ডাইনোসরের বিবর্তন এমনকি জীবের বিলুপ্তি সম্পর্কেও আমাদের চিন্তার জগতে একটা ধারণা তৈরি করিয়ে দিয়েছে।  প্রফেসর সুমিডা মনে করেন এত সমস্যার পরেও সারা পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য শিশু কিশোরদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করতে এই সিনেমাগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles