জেমস ওয়েব স্পেইস টেলিস্কোপ নিয়ে হইচইয়ের শেষ নেই - এই তো ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ১৮ তারিখেই এর উৎক্ষেপণ আর এক মাস পরে বহু বাধা বিপত্তি কাটিয়ে সেটি পৌঁছাবে পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে তার কক্ষপথে।
বিখ্যাত সেই হাবল টেলিস্কোপের স্থানপূরণ করবে কি এই নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ? নাসা ঠিক সেটা বলতে চায় না, তারা চায় মানুষ জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে দেখুক হাবলের উত্তরসুরী হিসেবে। হাবল টেলিস্কোপের কাছ থেকে জানা এবং শেখা বহু তথ্যের ভিত্তিতে আরো উন্নত এবং কাটিং এজ প্রযুক্তি দিয়ে বানানো হয়েছে একে।
- কেন এই জেমস ওয়েব স্পেইস টেলিস্কোপ নিয়ে এত হাইপ বিশ্বজুড়ে?
- কী এমন আছে এতে যা অন্য কোন টেলিস্কোপে ছিলনা? আসলেই কি আমরা এই টেলিস্কোপ দিয়ে আরো দূরের, আরো অতীতের মহাবিশ্বকে দেখতে পাবো?
- একে যেভাবে শূন্যে স্থাপন করা হচ্ছে সেটাও কেন এত ইউনিক এবং রিস্কি যে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন শেষ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক মত করা যাবে কিনা।
চলুন তাহলে আজকে যুগান্তকারী এই টেলিস্কোপ সম্পর্কে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনে নেওয়া যাক।
মহাকাশের বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তারার আলো আমাদের কাছে আসতে সময় লাগে। যেমন সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌছাতে লাগে প্রায় আট মিনিট। অর্থাৎ আমরা সূর্যকে যে অবস্থায় দেখি, সেটা আট মিনিট আগের তথ্য।
আমরা যত দূরের তারা দেখতে পাবো, সেটার আলো বা তথ্য তত পুরানো।
কিন্তু আমরা যখন তার আলো দেখব সে তখন ১৩০০ কোটি বা ১৩ বিলিয়ন আলোক বছর দূরে থাকবে না, সে থাকবে ৫০০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, আর এই মুহূর্তে সে যে আলো বিকিরণ করছে তা আর কোনোদিনই আমাদের কাছে পৌঁছাবে না।
তাহলে অতি দূরের তারা দেখতে পাওয়া মানে অতীতের ছবি দেখা, আর এভাবেই দেখা পাওয়া যেতে পারে বিগ ব্যাং-এর পরেই জন্মানো তারা আর গ্যালাক্সি। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বানানো হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেইস টেলিস্কোপ।
বিগ ব্যাং এর পরের প্রথম চার লক্ষ বছর মহাবিশ্বের ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে আলোর কণা বা ফোটন মুক্ত ইলেকট্রনের সাথে সংঘাতের ফলে প্রোটন কণার দঙ্গল থেকে বের হতে পারছিল না।
চার লক্ষ বছর পরে প্রসারণের ফলে তুলনামূলকভাবে মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হয়ে ৩০০০ ডিগ্রিতে নামলে ইলেকট্রন ও প্রোটন যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি হয়। হাইড্রোজেনের এই পরমাণুর সাথে ফোটনের বিক্রিয়া কম, ফলে মহাবিশ্বে প্রথম ফোটন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই ফোটনগুলোকে আমরা দেখি মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ (CMB) হিসেবে।
এর পরে মহাবিশ্ব আরো দ্রুত শীতল হতে থাকে এবং তারারা সৃষ্টি হতে শুরু করে। এরা মুলত অতিবেগুনী বা আলট্রাভায়োলেট আলো বিকিরণ করত এবং এদের চারপাশের হাইড্রোজেন পরমাণু সেই বর্ণালির আলো খুব সহজেই শোষণ করে নিতে পারত।
আলো শোষিত হত, অর্থাৎ সেই তারাগুলো আমাদের কাছে অদৃশ্য। তাই বিগ ব্যাং এর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি বছরের মধ্যে জন্মানো তারাগুলি আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা না। তবে সেই সময়ের কিছু উচ্চ শক্তির তরঙ্গ শোষিত হয়নি, এবং জেমস ওয়েব দুরবিনে সেই তরঙ্গ ধরা সম্ভব। তার মানে সেই অন্ধকার যুগের কিছু তারা বা গ্যালাক্সি অবশেষে আমাদের স্ক্রিনে ধরা দিতে পারে।
ওয়েব টেলিস্কোপের আগে ছিল আমাদের অতি পরিচিত হাবল টেলিস্কোপ! জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন - মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে, এবং যে গ্যালাক্সি আমাদের থেকে যত দূরে, সেটা তত বেশি বেগে আমাদের থেকে সরে যাচ্ছে।
আমরা গ্যালাক্সির ভিডিওতে দেখেছি ডপলার এফেক্টের কারনে সেই গ্যালাক্সিগুলোর আলোর রেড শিফট বা লাল-সরণ হচ্ছে, যেটা এক সময় ইনফ্রারেড বা অবলোহিত তরঙ্গে পরিণত হয়। তাই দূরের লাল-সরণ হওয়া গ্যালাক্সিগুলোকে দেখার জন্য জেমস ওয়েব দুরবিনকে বানানো হয়েছে অবলোহিতে সংবেদী করে, যেখানে হাবল মহাকাশ দেখে মূলত দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনী তরঙ্গ ও কিছুটা অবলোহিত তরঙ্গে।
অবস্থানের দিক দিয়েও হাবল আর ওয়েব টেলিস্কোপের তফাত আছে। হাবল পৃথিবী থেকে মাত্র ৫৪৫ কিলোমিটার উপরে প্রদক্ষিণ করে, তাই এটাকে খালি চোখেই দেখা যায়। সেখানে ওয়েব থাকবে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে।
জেমস ওয়েব দুরবিনের প্রাথমিক আয়নার ব্যাস হাবলের চেয়ে অনেক বড়। ফলে এই আয়নায় তারা বা গ্যালাক্সির আলো অনেক বেশী পরিমাণে প্রতিফলিত হবে শুধু তাইই নয়, এর সংবেদনশীলতাও এতটা বেশি হবে যে এ দিয়ে নাকি চাঁদের দুরত্বে থাকা একটি মৌমাছির শরীরের তাপ এই দুরবিনটি শনাক্ত করতে পারবে।
কিন্তু এই সাফল্য অর্জন করতে জেমস ওয়েব দুরবিনের জন্য বেশ কয়েকটি দুরূহ প্রকৌশলগত উদ্ভাবন করতে হয়েছেঃ
প্রথমত – পৃথিবী আর সূর্যের মহাকর্ষ কাটাকাটি হয়ে পরিমাণ শূন্য হয়ে যায়, এমন পাঁচটা বিন্দু আছে। সেগুলির মধ্যে একটার নাম L2 (el two) - বিন্দু যা সূর্য আর পৃথিবীর সাথে একই সরলরেখায় কিন্তু পৃথিবীর পেছনে। সবকিছু ঠিক থাকলে উৎক্ষেপণের প্রায় ১ মাস পরে, জানুয়ারির ১৮ তারিখ দুরবিনটি পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে L2-তে পৌঁছাবে। কোনো সমস্যা হলে নভোচারী পাঠিয়ে সেটিকে ঠিক করার কোনো উপায় নেই।
দ্বিতীয় সমস্যা তাপ নিয়ে। ওয়েব টেলিস্কোপ কাজ করবে ইনফ্রারেডে, যা তাপের বিকিরণের তরঙ্গও বটে। সুতরাং অন্য কিছুর তাপ এই দূরবীনের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেবে। এমনকি নিজের যন্ত্রাংশের তাপও পর্যবেক্ষনের ক্ষতি করতে পারে। সেটা যাতে না হয়, তাই দূরবীনটিকে ৫০ কেলভিনে রাখা দরকার। তাই পৃথিবী আর সূর্যের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য সেটির একটি সৌর তাপীয় ঢাল (Sun Shield) লাগবে। ঢালটির ক্ষেত্রফল ২৯৪ বর্গ মিটার—প্রায় একটা টেনিস কোর্টের সমান। এবং এই ঢাল যদি কোন কারণে স্থাপন না করা যায়, তাহলে দুরবিনটি কোনো কাজেই লাগবে না।
তৃতীয় সমস্যা কম্পন। একটি বিশেষ ডিটেকটরকে পরম শূন্যের মাত্র ৭ কেলভিন ওপরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। এটার জন্য হিলিয়ামের একটি হিমায়ক ব্যবহার করা হবে, কিন্তু তার ফলে তৈরি কম্পনে পর্যবেক্ষনে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। সেই কম্পনকে থামাবার জন্য বিজ্ঞানীদের আবার বিশেষ প্রকৌশল উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
এবার আসি দুরবিনের মূল অংশ – আয়নাতে। ওয়েবের আয়না কাচের নয়, বরং হাল্কা কিন্তু অনমনীয় বেরেলিয়ামের এবং তার ওপর একটি খুবই সূক্ষ্ম সোনার প্রলেপ দেয়া।
বেরেলিয়ামের ওপর সোনার প্রলেপের কারণ হল সোনা অবলোহিত তরঙ্গ খুব ভালভাবে প্রতিফলিত করতে পারে। ৬.৫ মিটার ব্যাসের আয়না রকেটে ঢোকানো যাবে না, তাই ১৮টি ষড়ভূজাকৃতি ১.৩২ মিটার আকারের আয়না ভাজ করে পাঠানো হচ্ছে। গন্তব্যে পৌঁছে সেগুলি একত্র করে বড় আয়নাটি গঠন করা হবে। তাপীয় ঢালটি খোলার মত এটিও একটি প্রকৌশলগত কঠিন কাজ।
ওয়েব দুরবিনে চারটি ডিটেকটর আছে। এগুলি ইনফ্রারেড তরঙ্গের নির্দিষ্ট অংশবিশেষ নিয়ে কাজ করবে।
আর পৃথিবীকে তথ্য পাঠানোর জন্য জেমস ওয়েব দুরবিনে একটি উচ্চ-শক্তির ও একটি মধ্য-শক্তির অ্যান্টেনা আছে। উচ্চ-শক্তির অ্যান্টেনাটিকে পৃথিবীতে অবস্থিত কোনো বড় অ্যান্টেনার দিকে তাক করতে হয়, অন্যদিকে মধ্য-শক্তির অ্যান্টেনাটির থেকে বিকিরিত তথ্য একটি বড় জায়গাজুড়ে অনেক গ্রাহক অ্যান্টেনার কাছে পৌঁছাতে পারে।
টেলিস্কোপটির সব যন্ত্র চালানোর জন্য প্রায় দুই হাজার ওয়াট ক্ষমতা লাগবে, সেটি পুরোপুরিই আসবে সৌরীয় প্যানেল থেকে। ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের ৫টি প্যানেলকেও উৎক্ষেপণের পরে খুলতে হবে।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার জন্য অধ্যাবসায়, ত্যাগ ও অনুপ্রেরণার প্রয়োজন। জেমস ওয়েব দুরবিনের জন্য বাড়তি বাধা হিসাবে আছে কিছু অতি সূক্ষ্ম প্রকৌশলগত সমস্যা। আমাদের আশা এই দুরবিনটি এই প্রতিটি দুরূহ পর্যায় অতিক্রম করে আমাদেরকে মহাশূন্যের দূরতম প্রান্তে নিয়ে যাবে, তথ্য এনে দেবে, নক্ষত্রের জন্ম বা বহিঃগ্রহ সম্পর্কের আমাদের জ্ঞান বহুগুণ বাড়াবে।
শুভকামনা, জেমস ওয়েব দুরবিন!!