জলবায়ু পরিবর্তন কী ও কেন হয়?
কোভিড আসার আগে আমরা মোটামুটি মেনে নিয়েছিলাম আমাদের চলমান তলা বিহীন বিশ্ব-ব্যবস্থা। কিন্তু কোভিড-১৯ এর এই অতিমারী আমাদের দেখিয়ে দিল কেমন হতে পারে অবস্থা শুধু প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের পিছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যদি এই ছোট্ট পৃথিবীটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ি। আমরা সাইন্স ফিকশান মুভির মত দেখলাম খাঁ খাঁ করতে থাকা বড় বড় শহর - লক ডাউনে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মুম্বাই, সাংহাই, ঢাকা; আরো দেখলাম আমেরিকা, বৃটেন থেকে শুরু করে ব্রাজিল, নেপাল, ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙ্গে পড়ছে, মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
যদি বলি বিশ্বব্যাপী কোভিডের এই বিপর্যয় কিছুই নয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামিতে যা ঘটতে যাচ্ছে তার তুলনায়? আমাদের হাতে এখন যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ক্রমশঃ বাড়ছে গত কয়েক দশক ধরে - রেকর্ড রাখতে শুরু করার পরে পৃথিবীব্যাপী গত দশকের তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে গরম। গত ৫ বছরে আটলান্টিক মহাসাগরে সবচেয়ে শক্তিশালী ৭টি বড় ক্যাটাগরি ৫ মাত্রার হারিকেন বা ঘূর্ণিঝড় হয়েছে - পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যাচ্ছে বন্যা, চরম খরা, তুষার ঝড়, দাবানলসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমারোহ। যে হারে মেরুর বরফ গলতে শুরু করেছে তা ক্রমশঃ বাংলাদেশের মত উপকূলবর্তী নীচু অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা জানি যে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জলবায়ু বিজ্ঞান কোন সহজ বিষয় নয় - প্রকৃতি নিজেই জটিল নিয়মে কাজ করে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা কীভাবে জানেন যে পৃথিবীর জলবায়ু ভয়াবহ দিকে মোড় নিচ্ছে? জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বলতে আসলে কী বোঝায়? গত সারে চারশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে আসছে তার থেকে এবারের পরিবর্তনটা কেন ভিন্ন? এর পিছনে মানুষের অবদান কতটুকু?
চলুন আজকে থিংকের এই ভিডিওতে এই জটিল প্রশ্নগুলোরই উত্তর জেনে নেই আমেরিকার জ্যাক্সসন-ভিল ইউনিভার্সিটির ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্টের প্রফেসর এবং ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড. তানভীর ইসলামের কাছ থেকে।
জলবায়ুর সবগুলো মডেল পরিষ্কারভাবে দেখাচ্ছে যে, গত প্রায় দশ-বারো হাজার বছর ধরেই আমাদের পৃথিবী ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এ থেকে কি প্রমাণ হয় যে, আজকে আমাদের চোখের সামনে যে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে তা সেই প্রাকৃতিক উষ্ণায়নেরই ধারাবাহিকতা?
নাহ - দশ হাজার বছর ধরে তাপমাত্রা খুব ধীরে ধীরে বাড়লেও মূলত আঠারো শতকে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এই উর্ধগামিতার শুরু এবং তখন থেকেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ছাপিয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ডকে। এখানে দেখুন কী হারে বেড়েছে তাপমাত্রা আঠারো শতাব্দী পর্যন্ত, আর তারপরে তা কত দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে । এই আকস্মিক বৃদ্ধির হার বোঝার জন্য কারো বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা।
এবং এরজন্য দায়ী যে আমরাই সে নিয়ে আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই - এর পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে বৃটেন, এবং আমেরিকার মত দেশগুলোতে ব্যাপক শিল্পায়ণ, যানবাহন ও কলকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানীর যথেচ্ছ ব্যবহার যা ছড়িয়ে পড়েছে বাকী ইউরোপ ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এছাড়া, গত একশ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
আমাদের এই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার মুনাফাকেন্দ্রিক অনিয়ন্ত্রিত শিল্প কারখানা, কৃষি, পশুখামার থেকে শুরু করে পরিবহন পর্যন্ত সব কিছু থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে CO2 ও মিথেন সহ নানা গ্যাস, এবং তা বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে - তৈরি হচ্ছে গ্রিনহাউজ ইফেক্ট, যা ধরে রাখছে সূর্যের তাপ এবং বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা।
এই গ্রিনহাউস ইফেক্টের ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে কাজ করে?
গ্রিনহাউস বলতে বোঝায় কাচ বা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢাকা ঘর যেখানে তাপ আটকে থাকে। পৃথিবীকে ঘিরে কাঁচ নেই, তার বদলে আছে ঘন বায়ুমন্ডল - যাতে কার্বন ডাইওক্সাইড, মিথেন, জলীয়বাস্পের মত গ্যাসগুলো আটকে পড়ে। দিনের বেলা সূর্য থেকে যে তাপ পৃথিবীতে আসে তার খানিকটা পৃথিবী শুষে নেয়, রাতের বেলা তা বিকিরণ করে। এই বিকিরিত তাপের কিছুটা ঐ গ্যাসগুলোর চাদরে আটকা পড়ে এবং এতেই সৃষ্টি হয় গ্রীনহাউস প্রভাব। আমাদের জীবজগতের টিকে থাকার জন্য নির্দিষ্ট পরিমানের তাপের প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে, আমরা তাপমাত্রার এই ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছি - জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক বেশী কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে, কৃষি ও পশুখামার থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত করে বা বনজঙ্গল কেটে ফেলে- এতে পৃথিবীর ক্রমাগত উষ্ণায়নের ফলে জটিল সব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে এটা ঠিক যে এই জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়, এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আদি থেকেই আমাদের পৃথিবী দীর্ঘ সময় ধরে কখনো উষ্ণ ছিলো, আবার কখনো বরফযুগে ছিল। আবার একটা সময়ে মেরুতে কোন বরফের অস্তিত্বই ছিলো না - আজকের বরফাচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা মহাদেশে ছিলো বিশাল ক্রান্তীয় বনাঞ্চল!
২৬ লাখ বছর আগে শুরু হওয়া প্লাইস্টোসিন যুগের প্রায় পুরোটা সময় বরফে ঢাকা ছিলো এন্টার্কটিকাসহ ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশ এবং এশিয়ারও কিছু অংশ, যার অংশবিশেষ এখনো রয়ে গেছে গ্রিনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায়। এই প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ ছিল যাযাবর এবং শিকারি-সংগ্রাহক।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত অন্তত ৫ টি দীর্ঘ বরফ যুগের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে - তখন পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল অনেক নীচে।
আজ থেকে আনুমানিক বারো হাজার বছর আগে, হোলোসিন যুগে যখন পৃথিবী উষ্ণ হতে শুরু করলো তখন ঠান্ডা পরিবেশে অভ্যস্ত ম্যামথ এবং (উলি)পশমে ভরা রাইনোসোরাসের মতো অনেক প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও মানুষের জন্য সময়টা ছিলো আশীর্বাদের মত - কৃষিকাজের উৎপত্তিসহ সব সভ্যতার সূচনা এই যুগেই।
তবে হোলোসিন যুগেও তাপমাত্রা ওঠানামা করে - যেমন, ১৩০০ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত পৃথিবী, বিশেষ করে ইউরোপ, খুবই ঠান্ডা ছিলো, গড় তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গিয়েছিল - এই কালকে 'ছোট্ট বরফ যুগ' বলেও ধরা হয়।
গ্রীনল্যান্ড বা এন্টার্কটিকায় হিমবাহের গভীরে আটকে থাকা বুদবুদের কার্বন ডাইওক্সাইডের পরিমাণ থেকে এখন বিজ্ঞানীরা অতীতের পৃথিবীর তাপমাত্রা কেমন ছিল তা নির্ধারণ করতে পারেন।
আর সমস্যা দেখা দিল সেখানেই - ২০২০ সালে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইওক্সাইডের পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ ভাগে ৪১৭ ভাগ, যা গত ১০ লক্ষ বছরের ইতিহাসে সবচাইতে বেশী।
আকস্মিকভাবে এই CO2 বাড়ার ফলে ভেঙে গেছে কোটি কোটি বছরের জটিল কিন্তু স্বাভাবিক/প্রাকৃতিক জলবায়ু চক্রটি। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরিত হয়ে যত দ্রুত গতিতে এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে তা মানব ইতিহাসে আর ঘটেনি। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানল, তুষার ঝড়, দূষণ বাড়া সহ পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রভাব বাড়ছে তার নমুনা তো আমরা এখন চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি।
যেহেতু মানুষের তৈরি বা এনথ্রপজেনিক কারণে এই পরিবর্তন হয়েছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন আমরা এখন আর হোলোসিন যুগে নেই, নতুন একটা যুগে প্রবেশ করেছি- যার নাম ‘এনথ্রোপোসিন’ যুগ। আমাদের গত কয়েক’শ' বছরের কর্মকান্ডের ফলে পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে তা থেকে ক্রমশঃ এক বড় ধ্বংসের মুখেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
অনেকে চোখ বন্ধ করে বলে দেন যে জনসংখ্যা বিস্ফোরণই হচ্ছে সব সমস্যার মূল। কিন্তু সূচারুভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীর জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বড় সমস্যা হল সম্পদের অসম বন্টন এবং অনিয়ন্ত্রিত তথাকথিত 'প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন'; আবার পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে - এই শতাব্দীর মধ্যেই জনসংখ্যা শীর্ষে উঠে কমতেও শুরু করবে। এখন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি দেখছি তার বেশির ভাগই আসছে মানুষের দীর্ঘায়ুর কারণে। এবার আমাদের দরকার জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমানো, কৃষি এবং পশুখামার থেকে গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমানো, বন-জঙ্গল কাটা বন্ধ করা, প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে তা লালন করা, তার অংশ হয়ে টিকে থাকতে শেখা আবার নতুন করে। ।
এখন আমাদের এই ছোট্ট গ্রহকে রক্ষা করার একটাই উপায় - আমাদের নিজ হাতে তৈরি জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমানো বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের রাশ টেনে ধরা, দ্রুতহারে বাড়ন্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের লেভেল নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। জানি অনেকেই ভাবছেন - এটা তো মুখের কথা নয়, এর পিছনে আছে ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশাআল সব কারন এবং এজেন্ডা। হ্যাঁ, কথাটা ঠিক, তবে সেই সাথে এও ঠিক যে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, এখনই সবাই সচেতন না হলে এবং জরুরীভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এর পরের ভিডিওগুলোতে, আমরা মনুষ্যজনিত কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কীভাবে হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো কতটা, কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এভাবে মেরুর বরফ গলে যেতে থাকলে বাংলাদেশের মত উপকূলবর্তী নীচু জায়গাগুলোর ভবিষ্যত কী হবে, আমাদের করণীয় কী - এসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করার ইচ্ছে রইলো।