ছায়াপথের বাইরের গ্যালাক্সিগুলো কীভাবে আবিষ্কার হলো?

.


বন্যা -  গ্যালাক্সি নিয়ে আমরা আজকে আবার একটা নতুন ভিডিও সিরিজ শুরু করতে যাচ্ছি।  আগের ভিডিওগুলোতে আমরা আলোচনা করেছিলাম আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির ভিতরে সূর্য কীভাবে ঘোরে  এবং গ্যালাক্সিতে কত তারা আছে।  আজ আমরা দীপেনদার কাছ থেকে জানব কীভাবে আমরা জানলাম যে আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সি ছাড়াও আরো হাজারো গ্যালাক্সি আছে এই মহাবিশ্বে? এই সিরিজে কয়েকটি ভিডিওতে আমরা ধীরে ধীরে ঢুকে যাবো সেই গ্যালাক্সিগুলোর ভিতরে এবং জেনে নেব এই গ্যালাক্সিগুলোর গতিপথ নিয়ে - কীভাবে তারা ভ্রমণ করছে আমাদের এই অনন্ত মহাবিশ্বে।


বন্যা - দীপেনদা - আমাদের মহাবিশ্বে প্রতিটি গ্যালাক্সিই একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এটাকে আমরা মহাবিশ্বের প্রসারণ বলছি - এই গ্যালাক্সির গতিপথের ব্যাপারটা বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে। কিন্তু তার আগে আজকে আমাদের বলুন  গ্যালাক্সির বাইরে যে অন্য গ্যালাক্সি আছে সেটি কবে আবিষ্কার হল??

দীপেন - ১৯২৪ সনে যখন এডউইন হাবল আবিষ্কার করলেন যে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরেও অন্য গ্যালাক্সি আছে। এটা যে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার সন্দেহ নেই।

আমাদের গ্যালাক্সিই যে মহাবিশ্বের শেষ কথা নয় সেটা বহুদিন হল বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা ভেবে আসছিলেন, এর মধ্যে অন্যতম হলে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট, যিনি তাঁর ১৭৫৫ সনে তাঁর Universal Natural History and Theory of the Heavens বইটিতে আমাদের ছায়পথ গ্যালাক্সির বাইরে আরো Island Universe বা আরো জগতের দ্বীপ আছে বলে অনুমান করেছিলেন। তবে তারও আগে ১৭৫০ সনে Thomas Wright নামে একজন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ রাতের আকাশে যে আবছা নীহারিকা দেখা যায় সেগুলি যে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে সেটি প্রস্তাবনা করেছিলেন।

কিন্তু ফিরে আসি হাবলের আবিষ্কারে। হাবল দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসনের তখনকার সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি প্রতিফলক দুরবিন ব্যবহার করে আমাদের নিকটতম বড় সর্পিলাকার গ্যালাক্সি আন্ড্রোমিডা বা M31 এবং আর একটি তুলনামূলকভাবে ছোট সর্পিলাকার গ্যালাক্সি M33 এর কিছু তারাকে আলাদাভাবে বিশ্লিষ্ট করতে পারলেন - এই গ্যালাক্সিগুলো তো এত দূর থেকে দেখতে মেঘের মত, কিন্তু হাবল গ্যালাক্সির ওপরে কয়েকটি উজ্জ্বল তারা দেখলেন, প্রথমে ভেবেছিলেন সেগুলো হল আমাদের গ্যালাক্সির কোনো তারা কিছু দিনের জনা উজ্জ্বল হচ্ছে - যাকে আমরা নোভা বলি, কিন্তু পরে একটি তারাকে তিনি সেফিড বিষম তারা বা Cepheid Variable হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলেন।

এই ছবিটি ১৯২৩ সনে হাবলের তোলা ছবি, এখানে নিচের N চিহ্নিত জায়গায় সেই বিখ্যাত তারাটির অবস্থান। 


আধুনিক সময়ে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে হাবল দুরবিন এই সেফিড বিষম তারাটিকে পর্যবেক্ষণ করে, এবং কয়েক মাস ধরে এটির উজ্জ্বলতার বিষমতাকে ছবিতে ধরতে সক্ষম হয়  

এই একটি তারা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনা বদলে দিল - যাকে বলে paradigm shift, আমাদের মহাবিশ্বটা যেন হঠাৎ করে ভীষণ বড় হয়ে গেল।

বন্যা - তাহলে এডউইন হাবল দেখালেন যে এই সেফিড তারাটি আমাদের গ্যালাক্সিতে নয়, বরং আর একটি গ্যালাক্সি, অর্থাৎ অ্যান্ড্রোমিডাতে অবস্থান করছে। সেটি কেমন করে তিনি বের করলেন?

দীপেন - এর উত্তর দিতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে, বলতে হবে হেনরিয়েটা লেভিটের কথা। উনি যুক্তরাষ্ট্রের হারভারড কলেজের মানমন্দিরে কাজ করতেন এবং কয়েক হাজার বিষম তারা আবিষ্কার করেন। 

কিন্তু ওনার সবচেয়ে বড় কাজটি হল সেফিড বিষম তারার উজ্জ্বলতার হেরফের বা পিরিয়ড বা পর্যায়কালের ওপর ভিত্তি করে সেই তারাটির পরম বা absolute উজ্জ্বলতা আবিষ্কার করা এবং সেটির ওপর ভিত্তি করে সেই তারাটির দূরত্ব বের করা। ২০১২ সনে একটি বিজ্ঞান প্রবন্ধে উনি দেখালেন যে, এই ধরণের সেফিড বিষম তারার অন্তর্নিহিত বা আসল উজ্জলতা যত বেশি হয় তাদের উজ্জ্বলতার হেরফেরের সময়কালো তত বেশি হয়। আর তারার পরম উজ্জ্বলতা যদি আমরা জানি তাহলে সেটি যত দূরে যাব তার উজ্জ্বলতা কমতে তাহক্বে - তার ওপর ভিত্তি করে তার দূরত্ব বার করা যায়।


দীপেন - হাবল লেভিটের গবেষণা অনুসরণ করে M31 ও M33 এই দুটি গ্যালাক্সির দূরত্ব বের করে দেখালেন যে তারা  আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে দুটি বড় নক্ষত্রেরে আধার। আজ আমরা জানি M31 অ্যান্ড্রোমিডা আড়াই মিলয়ন আলোকবর্ষ দূরে এবং M33 ৩ মিলিয়ন আলোকচোরষ দূরে। আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সি, M31, M33 ও এদের মাঝে বেশ কয়েকটি বামন গ্যালাক্সি নিয়ে গঠিত হল আমাদের স্থানীয় গ্যালাক্সি দল বা local cluster।


তাহলে আমি যদি কাছাকাছি একটি সেফিড তারার অন্তর্নিহিত বা পরম উজ্জ্বলতা অন্য কোনো পদ্ধতিতে বার করতে পারি তাহলে সেই পরম উজ্জ্বলতার সঙ্গে উজ্জ্বলতার ওঠানামার একটা সম্পর্ক বার করা যায়। এটা parallax পদ্ধতি বা spectroscopic পদ্ধতি দিয়ে করা যায়, সেই আলোচনাটা না হয় আমরা অন্য একটি পর্বের জন্য তুলে রাখি। 


মনে হচ্ছে আমাদের একটা পুরো ভিডিওই করতে হবে এ নিয়ে - কীভাবে তারাদের দূরত্ব মাপা হয়। তাহলে আমরা এখন আবার হাবলে ফেরত যাই।  M31 এবং M33 যে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে তা বলার  পরেও তো হাবল আরো অনেক কিছু আবিষ্কার  করেছিলেন। 


দীপেন - হ্যাঁ, হাবল বেশ কয়েকটি গ্যালাক্সির বর্ণালী বের করলেন এবং দেখালেন যে তাদের মৌল পদার্থ যেমন বিশেষত হাইড্রোজেনের তরঙ্গের লাল সরণ বা red shift হচ্ছে। এই নিয়ে বন্যা তুমি হয়তো শৌনকের সাথে কথা বলেছ।

বন্যা - হ্যাঁ ডপলার শিফট বা সরন নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম শৌনকের সাথে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে ভডিওটা বাবানোর সময়।

এটাকে আমরা ডপলার সরণও বলে থাকি। সেই ১৮৪২ সনে অস্ট্রীয় বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডপলার এটা সম্বন্ধে বলে গেছেন। তিনি অবশ্য এটা শব্দ তরঙ্গের ব্যাপারে বলেছেন, কোনো চলন্ত যান থেকে শব্দ বিকিরত হলে তার কম্পাঙ্ক বদলাবে, যানটি যদি আমাদের দিকে আসে তাহলে কম্পাঙ্ক বাড়বে, তার তরঙ্গদৈর্ঘ কমবে আর যানটি আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে শব্দের কম্পাঙ্ক কমবে, তরঙ্গদৈর্ঘ বাড়বে।

https://www.youtube.com/watch?v=a3RfULw7aAY

একই ঘটনা তড়িৎ-চুম্বকীয় বা আলোর জন্য প্রযোজ্য। একটি গ্য্যালাক্সি যদি আমাদের থেক দুর্ে সরে যেতে থাকে তবে তার থেকে বিকিরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘা বাড়বে, অর্থাৎ সে যদি নীল আলোয় উজ্জ্বল থাকে অন্তর্নিহিত ভাবে আমরা তাকে লাল দেখব, আর তার থেকে বিকিরিত লাল রঙ আরো লাল হয়ে হয়তো অবলোহিত হয়ে যাবে।

https://www.youtube.com/watch?v=-mQ41yA6LaA


বন্যা - হাবল তো ম্মনে হয়  প্রথম ব্যক্তি নন যিনি ডপলার পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো খোগল বস্তির দূরত্ব বার করেছেন। তাই না? 


দীপেন - সেই ১৮৪৮ সনেই ফরাসী বিজ্ঞানী ইপোলিত ফিজো তারাদের বর্ণালীতে যে রেখাগুলো পাওয়া যায় সেগুলো পৃথিবীর গবেষণাগারের থেকে ভিন্ন কেন সেটা বলতে গিয়ে তারাদের গতি নির্দেশ করেছিলেন। আর ১৮৬৮ সনে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হাগিন্স প্রথম তারাder গতিবেগ এই পদ্ধতিতে বার করার চেষ্টা করেন। 


১৯২৯ সনে হাবল আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে ২৪টি নিহারীকার একটি বর্ণালী দিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। এর নাম ছিল A RELATION BETWEEN DISTANCE AND RADIAL VELOCITY AMONG EXTRA-GALACTIC NEBULAE

বন্যা - আমার যতদূর মনে পড়ে হাবলের এই আবিষ্কারের সঙ্গে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্বের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। 


দীপেন - হাবল দেখালেন যে এই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। আমরা অনেকেই জানি যে আইনস্টাইন তারভ সাধারণ আপেক্ষিক তত্ব সমীকরণে ধরে আবিষ্কার করেছিলেন যে মহাবিশ্ব অস্থিতিশীল, অর্থাৎ সে হয় আপতিত হবে নিজের ওপর, নইলে বাড়তেই থাকবে। কিন্তু আইনস্টাইন যখন তার তত্ব দিয়েছিলেন তখন আমাদের বাইরে যে গ্যালাক্সি আছে তাই জানা ছিল না। আমর জানি যে আইনস্টাইন  মহবিশ্বাঅকে স্থিত করার জন্য একটা cosmological term তার সমীকরণে ব্যাবহার করেছিলেন। হাবলের আবিষ্কার শুনে উনি বুঝতে পারলেন যে সেটা করার দরকার ছিল না, কিন্তু আইন্স্টাইন যাকে বলেছিলেন তার জীবনের বড় ভুল সেটা পরবর্তীকালে অর্থাত আমাদের সময়ে কৃষ্ণ শক্তির ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। তোমরা dark  matter ভিডিওতে যে ডার্ক এনার্জির কথা বলেছ সেতাই আসলে এই  cosmological term।


বন্যা - হাবল কীভাবে ওই সব গ্যালাক্সির গতিবেগ ও দূরত্ব বার করেছিলেন ? 


এখানে কী করে বর্ণলী রেখা থেকে দূরত্ব মাপা যায় সেটা সংক্ষেপে বলি। হাইড্রোজেনের লাল রেখাটির মান 656.281 nm, NGC 4649 নামে একটি গ্যালাক্সি আছে যার থেকে নির্গত হাইড্রোজেনের মান দেখা গেল 658.726 nm, তাহলে এর লাল সরণ বা redshift হবে (658.726 - 656.281)/656.281 = 0.003726, একে ইংরেজীতে বলে z। খুব ভাল কথা, কিন্তু এর থেকে আমরা এই গ্যালাক্সিটির গতিবেগ বার করব কী করে? গ্যালাক্সিটি যদি আমাদের কাছাকাছি হয় তাহলে তার গতিবেগ আলোর গতিবেগের চাইতে অনেক কম হবে এবং ওই z সংকাহাটিকে আলোর গতিবেগ দিয়ে পূরণ করলেই সেই গ্যালাক্সিটির গতিবেগ পাওয়া যাবে - এই ক্ষেত্রে 1118 km/sec। সমস্যা হল এই গতিবেগ থেকে কেমন করে দূরত্ব বের করা যায়। আমরা যদি এই গতিবেগকে হাবলের ধ্রুবক দিয়ে ভাগ দিই তাহলে তার দূরত্বটি পাওয়া সম্ভব। হাবলের ধ্রুবক হল দুটি গ্যালাক্সি যদি এক মেগাপার্সেক দূরত্বে অবস্থান করে তারা একে অপরের কাছ থেকে কত দ্রূত সরে যাচ্ছে। হাবলের গণনায় কিছু ভুল ছিল তিনি হাবল ধ্রবককে ধরলেন 500 km/sec/Mpc। এর ফলে NGC 4649-এর দূরত্ব হল মাত্র ২ মেগা পার্সেক। এই মানটি এখন ৭০-এর কাছাকাছি, অর্থাৎ NGC 4649 বা মেসিয়ার 60 গ্যালাক্সির দূরত্ব হল ১৬ মেগা পার্সেক।

বন্যা - তাহলে হাবলের মহাবিশ্ব আমরা এখন যা জানি তার থেকে ছোট ছিল?

হ্যা, এবং এটা হাবলের জন্য একটা সমস্যা ছিল, কারণ গ্যালাক্সিগুলো যদি এত কাছে থাকে এবং তাদের গতি যদি এত বেশি হয় তবে আমরা যদি এটা পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাই তাহলে মাত্র দুই বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং হবার কথা, কিন্তু ততদিনে বিজ্ঞানীরা পৃথিবির বয়স যে দুই বিলিয়ন বছরের বেশি সেটা বুঝতে পারছিলেন। তাই হাবল মহাবিশ্বের প্রসারণে যে পুরোপুরি আস্থা রেখেছিলেন তা বলা যায় না।  


এই প্রসঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর একটা অনুরূপ সমস্যার কথা বলি। বিবর্তন তত্ত্বে পৃথিবীর বয়স নিয়ে সমস্যাটার কথা  তো তুমিও লিখেছ তোমার বইএ।

বন্যা - 


ডারউইন তাঁর বিবর্তন তত্ব সবে দিয়েছেন, ডারউইনের অন্যাতম সমর্থক ছিলে ভুতত্ববিদ স্কটিশ বিজ্ঞানী চার্ল্স লায়েল। লায়েল বলেছিলেন পৃথিবীর বুকে আমরা যে পরিবর্তন দেখি এই পাহাড় উঠছে বা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তার জন্য প্রচুর সময় দরকার। 


বন্যা - 

১৮৫৯-এ ডারউনিন তার বিবর্তনের তত্ব দিয়েছিলেন। বিবর্তনের জন্য অনেক সময় দরকার সেটা ডারউইন, লায়েল দুজনেই বুঝেছিলেন, লর্ড কেলভিন বা উনিলিয়াম থমসন যার নামে আমাদের পরম তাপমাত্রার কেলভিন স্কেল দেয়া হয়েছে, খুব প্রভাবশালী পদার্থবিদ ছিলেন বিশেষত: তাপ গতিবিদ্যার ব্যাপারে। তো উনি ধরলেন যে পৃথিবী যখন প্রথম তৈরুই হ সেটা উত্তপ্ত লাভা ছিল গলিত, তখন থেকে ঠান্ডা হতে কত সময় লাগবে। ঠান্ডা হবার প্রক্রিয়াটা উনি ধরলেন conduction। পৃহ্তিবির বয়স দিলেন ২০ মিলিয়ন বছর। এত অল্প সময়ে তো বিবর্তন হবে না। সূর্যের বয়স দিলেন ১০০ মিলিয়ন বছর। অনেকেই কেলভিনের গণনা নির্ভুল ধরে নিয়েছিলেন, এতে ডারউইন তত্ব উনবিংশ শতাব্দীর শেষ একটা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে যখন বস্তর তেজস্ক্রিয়তা বের হল তখন বোঝা গেল পৃথিবী ও সূর্যের বয়স অনেক।  


বন্যা - পৃথিবীর প্রকৃত বয়স বের করাটা যে কতটা কঠিন ছিল সেটা ভাবলেও অবাক লাগে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে স্বাভাবিক চেতনার দিয়ে  এটা বুঝতে পারা সম্ভব নয় বলেই হয়তো! এবং পৃথিবীর বয়স এবং মহাবিশ্বের বয়সের উপর ভিত্তি করে আমরা আরো কত কিছুই না জেনেছি এবং বুঝতে পেরেছি আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে। 


দীপেন - বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায় যে কোনো বিজ্ঞানী একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন কিন্তু তাতে আস্থ রাখতে পারেন নি। হাবল একটি উদাহরণ, উনি মহাবিশ্ব প্রসারণে ঠিক বিশ্বাস করেন নি এবং তার আবিষ্কারকে কিছুটা স্থানিয়য় গতবেগ হিসেবে ধরেছেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক, কিন্তু ফোটন যে আলাদা আলোর কণিকা তাতে আস্থে রাখেন নি যদিও নিজেই সেটির প্রস্তাব করেছিলেন একটু অন্যভাবে।



কন্যারাশির গ্যালাক্সিপুঞ্জের দিকে ছায়াপথের গতি: কিন্তু এখানেই শেষ নয়, তার সমস্ত নক্ষত্র সহ আমাদের গ্যালাক্সী ও স্থানীয় অন্যান্য গ্যালাক্সী আবার কন্যারাশির (ভার্গো) দিকে অবস্থিত গ্যালাক্সীপুঞ্জের দিকে আকর্ষিত হচ্ছে। এই গতিবেগ হল সেকেন্ডে ৩৩০ কিলোমিটারের মত। কন্যা গ্যালাক্সিপুঞ্জের কেন্দ্র আমাদের থেকে ৫৪ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি চল্লিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। 

 

মহা আকর্ষকের দিকে কন্যা গ্যালাক্সিপুঞ্জের গতি: কিন্তু ওপরের গতিপথও শেষ কথা নয়। কন্যারাশির গ্যালাক্সিপুঞ্জ আবার কাছাকাছি সমস্ত ছোট ছোট গ্যালাক্সিদল (আমাদের স্থানীয় গ্যালাক্সিদলসহ) নিয়ে সৃষ্টি করেছে বিশালাকায় সুপার ক্লাস্টার - এই বিশালাকায় গ্যালাক্সিপুঞ্জ আবার আকর্ষিত হচ্ছে তার পেছনে কোনো বড় একটা ভর সম্পন্ন অতি-অতিকায় গ্যালাক্সীপুঞ্জের দিকে সেকেন্ডে ৩১০ কিলোমিটার বেগে। এই গ্যালাক্সীপুঞ্জকে জ্যোতির্বিদরা নাম দিয়েছেন মহা আকর্ষক (Great Attractor)। সেটির কেন্দ্র আমাদের থেকে ২৫০ মিলিয়ন বা পঁচিশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে।    

 

মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির তুলনায় আমাদের গতি: তাহলে এটাই কি আমাদের চরম গতি? আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী চরম গতি বলে কিছু নেই। কিন্তু আমরা যদি কোন স্থির কাঠামো নির্ধারণ করতে পারি তাহলে তার তুলনায় গতিবেগ মাপা সম্ভব। সেই ধরণের একটা স্থির কাঠামো হচ্ছে মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি (Cosmic Microwave Background CMBR)। কসমিক মাইক্রওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবিআর মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময়ে যে আলো সৃষ্টি হয়েছিল তারই অবশিষ্ট। বলতে গেলে এই আলো, যা কিনা খালি চোখে দেখা যায় না, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত থেকে আসছে। যেহেতু এই মহাজাগতিক আলো সব দিক থেকে প্রায় সমান ভাবে আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, সি.এম.বি.আরকে একটা স্থিত কাঠামো ধরে নিয়ে তার তুলনায় পৃথিবীর গতিবেগ মাপা সম্ভব। 

 

হাবল স্রোত: আমাদের গ্যালাক্সির যদি কোন স্থানীয় গতি না থাকত তবে আমাদের গতি হত শুধু মহাবিশ্বের প্রসারণের সঙ্গে যুক্ত। সেইক্ষেত্রে মাইক্রোওয়েভ পটভূমির তুলনায় আমাদের গতি হত শূন্য, কারণ সেই পটভূমিও মহাবিশ্বের প্রসারণের সঙ্গে যুক্ত। এইক্ষেত্রে আমরা বলি মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে আমরা Hubble Flow বা হাবল স্রোতের সাথে চলেছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যেহেতু আমরা কন্যা গ্যালাক্সিপুঞ্জ ও মহাআকর্ষকের দিকে আকর্ষিত হচ্ছি, হাবল স্রোতের মধ্যেও আমাদের একটা ভিন্ন ধরণের গতিবেগ ও গতিমুখ আছে। আমাদের স্থানীয় গ্যালাক্সিপুঞ্জ সেইদিকে সেকেন্ডে ৬২৭ কিলোমিটার বেগে চলেছে। 

 

চূড়ান্ত গতি?: কিন্তু স্থানীয় গালাক্সিপুঞ্জের গতিবেগ আর আমাদের সৌরজগতের গতিবেগ এক নয়, কারণ গ্যালাক্সির মধ্যে আমাদের একটা নিজস্ব গতি আছে। ওপরে জাহাজের কথা মনে আছে? সেটা ধরে নিলে মাইক্রোওয়েভ পটভূমির তুলনায় আমরা সেকেন্ডে ৩৬৮ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে চলেছি সেই হাইড্রা অতিকায় ক্লাসটারের দিকে। এটাকে এক ধরণের চূড়ান্ত গতি ও গতিমুখ ধরে নেয়া যেতে পারে, কিন্তু এই প্রসারণশীল মহাবিশ্বের মধ্যে পরম রেফারেন্স কাঠামো বলে কিছু না থাকায় এটাকে চূড়ান্ত গতি বলাটাও সঙ্গত হবে না।

 

আমাদের মহাবিশ্বে সকল পদার্থ যদি সমসত্ত্বভাবে বিরাজ করত তবে কোন গ্যালাক্সিরই স্থানীয় গতি থাকত না, প্রতিটি গ্যালাক্সি একে অপরের কাছ থেকে হাবল প্রসারণের মাধ্যমে দূরে সরে যেত। আমরা যে মহা আকর্ষকের আকর্ষণ অনুভব করছি তার মানেই হচ্ছে ৪০০/৫০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষের মধ্যে মহাবিশ্বকে সমসত্ত্ব বলা যায় না।    

 

 

সমস্ত গতির খতিয়ান: শেষাবধি তাহলে কি দাঁড়াল? (১) পৃথিবীর আছে আহ্নিক গতি, যেহেতু সে নিজের অক্ষের চারদিকে আবর্তিত হয়। ঢাকা শহরে এর মান হচ্ছে সেকেন্ডে ০.৪২ কিলোমিটার। (২) পৃথিবীর আছে বার্ষিক গতি, সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার সূর্যের চারদিকে। (৩) সৌরজগতের আছে অন্যান্য নিকটবর্তী তারাদের তুলনায় স্থানীয় স্থির কাঠামোয় গতি, সেকেন্ডে ২০ কিলোমিটার। (৪) স্থানীয় স্থির কাঠামো আবার সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার বেগে আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করছে। (৫) আমাদের গ্যালাক্সি সেকেন্ডে ৩৩০ কিলোমিটার বেগে কন্যারাশির দিকের গ্যালাক্সিপুঞ্জের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। (৬) কন্যারাশির বিশাল গ্যালাক্সিপুঞ্জ বা সুপার ক্লাস্টার আবার বহু দূরের হাইড্রা-সেন্টরাস অতিকায় গ্যালাক্সিপুঞ্জের দিকে সেকেন্ডে ৩১০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। (৭) পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি বাদ দিয়ে বাকি সব কিছু যোগ করলে দেখা যাচ্ছে যে আমরা মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির তুলনায় হাইড্রা রাশির একটি বিন্দুর দিকে সেকেন্ডে ৩৬৮ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে চলেছি।


https://solarsystem.nasa.gov/solar-system/beyond/overview/#otp_faq:_how_big_is_space?





সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles