ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।”
রবি ঠাকুরের দেবতার গ্রাস কবিতায় দেবতা নয় খেপেছিলো স্বার্থপরের মতো হঠাত শান্ত মাঝ নদীতে - কেড়ে নিয়েছিল 'রাখাল' বালককে!
কিন্তু আমাদের প্রকৃতি কেন এত খেপেছে ইদানিং? কেন সাইক্লোন আম্ফানের মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলো ধেয়ে আসছে বারে বারে - ভয়ংকর থেকে আরো ভয়ংকরী হচ্ছে দিনে দিনে? এর পেছনে কি জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কোন প্রভাব আছে?
থিংকের এই ভিডিওতে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কথা শুনেছি আর কোথায়, কেন, কীভাবে এই উন্মত্ত ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয় তাও দেখছিলাম থিংকের ->ঘূর্ণিঝড়ের ভিডিওতে। কিন্তু জানা হয়নি, ইদানিংকালে খেপাটে ঘূর্ণিঝড়গুলো ঠিক কীভাবে আরো খেপাটে হয়ে উঠছে।
সেসব নিয়ে আবারো আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম আমাদের থিংকের বন্ধু, Jacksonville State University র Professor এবং Emergency Management এর Department Head ড. তানভীর ইসলামের সাথে। চলুন আজকে শুনে নেওয়া যাক সেই গল্প।
আলোচনা শুরু করার আগে একটা ছোট্টো অনুরোধ, ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকশন পেতে নীচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
থিংকের এই ভিডিওতে দেখেছিলাম, কর্কট ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বা বাংলায় যাদের ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় বলে তাদের তাণ্ডবের কথা।
যদি বলিইইই - এগুলো বেশ উপকারীই? তাহলে কি তেড়ে আসবেন?
তা অবশ্য আসারই কথা, কেন না, উপকূলীয় জনবসতির বিভীষিকা এই ঘূর্ণিঝড়গুলো।
কিন্তু জানেন কি, এই ঘূর্ণিঝড়গুলোই আবার নিরক্ষীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সৃষ্ট প্রচণ্ড তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে দিয়ে পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে! ভেবে দেখুন তো, এই ভারসাম্য না থাকলে কী হতো প্রকৃতির? সেই দিক থেকে বিচার করলে এই প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনগুলোরও কিন্তু অনেক ইতিবাচক প্রভাব আছে প্রকৃতিতে! তবে তাদের এতটা ভয়ংকরী হয়ে ওঠার কথা কিনা সেটা আরেক প্রশ্ন।
এই যে তাইফুন, সাইক্লোন কিংবা হারিকেনের সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বেসিনে, এগুলোর পর্যবেক্ষনে নিয়োজিত কমিটি এদের নামকরণও করে রাখে আগে থেকেই। আটলান্টিকের বর্ণানুক্রমিক নামের তালিকা থেকে বছরের প্রথম হারিকেনটির নাম হয় ‘A’ দিয়ে, যেমন আর্থার । দ্বিতীয়টি ‘B’ দিয়ে, যেমন - বার্থা। একইভাবে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার দেশগুলো মিলে যে নামের তালিকা তৈরি করেছে নিজেদের সংস্কৃতি অনুযায়ী, সেখান থেকেই আসে অগ্নি, নার্গিস, আম্ফান....... এসব নাম।
ও হ্যাঁ, একটা মজার তথ্য দেই!
আগে একটা সময় হারিকেনের নাম দেয়া হতো সব নারীদের নামে, কিন্তু ১৯৭৯ সাল থেকে সাম্যতা আনার জন্য পুরুষের নামও অন্তর্ভুক্ত হয় তালিকায়,
শুধু মেয়েদের নাম দিয়ে কেন প্রকৃতির এই তান্ডবতাকে বোঝানো হবে?
যাই হোক, নামকরণের সাতকাহন রেখে আমাদের মূল আলোচনায় ঢোকা যাক
জলবায়ু পরিবর্তনই কি গতানুগতিক সাইক্লোনগুলোকে আরো উন্মত্ত করে তুলেছে?
আমরা জানি জলবায়ু বলতে বুঝায় কোন স্থানের বহু বছরের আবহাওয়ার গড় মান। আর জলবায়ু পরিবর্তন বলতে মূলত সেই গড় অবস্থা, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির পরিবর্তনকেই বোঝায়।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা IPCC এর রিপোর্টে বলছে গত ৫ দশক ধরে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে অনেক বেশি হারে। শিল্পায়ন, যানবাহনে জীবাশ্ম-জ্বালানী ব্যবহার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বনজঙ্গল গাছপালা কেটে ফেলা সহ বেশ কিছু কারণে, কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হচ্ছে আর তার থেকেই ঘটছে এই উষ্ণায়ন।
এবং এর জন্য মূলত মানুউউউউষ, মানে আমরাই দায়ী!
সে নয় হলাম দায়ী, কিন্তু তার সাথে ঘূর্ণিঝড়ের কী সম্পর্ক?
জলবায়ুর এই পরিবর্তনের ফলে
প্রথমত: সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি উচ্চতায়।
দ্বিতীয়ত: মাত্র ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘূর্ণিঝড়ের ১০০ কিমি এর মধ্যে গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫% বৃদ্ধি পেতে পারে।
তৃতীয়ত: ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিমত্তা ১ থেকে ১০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
আমরা জানি, সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অন্যতম প্রভাবক। সাধারণত, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার জন্য সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকতে হয়। সমুদ্রের পানি থেকে নির্গত এই তাপই ঘূর্ণিঝড়ের মূল শক্তির উৎস, যাকে ঘূর্ণিঝড়ের ‘এঞ্জিনও বলা হয়। গবেষকেরা বলছেন, গত মাত্র চার দশকে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আমরা সাম্প্রতিককালে ক্যাটাগরি ৪ ও ৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় বেশি দেখতে পাচ্ছি।
Power Dissipation Index (PDI) নামে যে সূচকটি আছে, যা ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা, তীব্রতা, সময়কাল ইত্যাদি সমষ্টিগতভাবে প্রকাশ করে সেটায় দেখা যাচ্ছে sea surface temperature বা সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির এই সূচক সমানুপাতিক হারে বাড়ে।
অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি বৃদ্ধির সম্পর্কটা আসলে সরাসরিই!
তো, কী দাঁড়ালো?
দাঁড়ালো, সারা বিশ্বে একুশ শতকে ক্যাটাগরি ৪ ও ৫ মাত্রার শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। বৃদ্ধি যে পাবে সেটার আলামত তো আমরা পাচ্ছিই গত বেশ কিছু বছরের তথ্য থেকেই।
গত চার বছরে আটলান্টিক মহাসাগরে ক্যাটাগরি ৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় যেমন ধরুন, ডোরিয়ান, ম্যাথিউ,আরমা, মারিয়া বা মাইকেলের মত ঘূর্ণিঝড়গুলো সৃষ্টি হয়েছিলো। তারও আগে, ২০০৫ সালে ক্যাটাগরি ৫ শক্তির এমিলি, ক্যাটরিনা, রিটা, উইলমা নামক ৪ টি হারিকেনের নামও বলা যেতে পারে। এত কম সময়ের ব্যবধানে নিয়মিত এই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়্গুলো যে আজকাল সৃষ্টি হচ্ছে তা আগেকার সিকোয়েন্সের সাথে ঠিক মেলানো যায় না। বিজ্ঞানীরা বলছেন সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিই মূলত এর জন্য দায়ী।
ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিমাত্রা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত পরিমাপক কেন্দ্রীয় চাপের মান থেকে পাওইয়া তথ্যানুযায়ী শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকায়, প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি ঘূর্ণিঝড়গুলো এগিয়ে আছে।
তাহলে জিজ্ঞেসা করতে পারেন আমাদের অঞ্চল নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণটা কোথায়?
আআআছে। ভয়ংকর দুঃশ্চিন্তার কারণ আছে।
IPCC রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থেকে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলো আরো উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করতে পারে। যেটি আমাদের অঞ্চলের জন্য বেশ ভয়ের। কারণ বঙ্গোপসাগরের অগভীর মহী-সোপান ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলীয় এলাকায় মারাত্মক ধরনের উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে । ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের তালিকা অনুযায়ী সর্বোচ্চ প্রাণহানিকর ৩৫ টি ঘূর্ণিঝড়ের ২৬ টিই এই এলাকায় সংঘটিত হয়েছে, যা ঘটেছে মূলত এই জলোচ্ছ্বাসের কারণেই।
ফলে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি অন্য বেসিনের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে একটু কম হলেও অধিক জনসংখ্যা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্বল স্থাপনার ঘরবাড়ি বা অপ্রতুল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কারণে এখানে বেশি প্রাণহানি ঘটে।
জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরা না গেলে পৃথিবীর অন্যান্য বেসিনসহ আমাদের অঞ্চলেও ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত ক্ষয়ক্ষতি আরো বৃদ্ধি পাবে।
সুতরাং চিন্তার বলি রেখা মাথায় তো থাকছেই!