গ্যালাক্সির বাহু সৃষ্টির বিস্ময়কর কারণ

.

বন্যা-> মহাবিশ্বের হাজারো গ্যলাক্সির মাঝে আমরা আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির কথা জেনেছিলাম আগের পর্বে এবং এও জেনেছিলাম যে ছায়াপথ গ্যালাক্সির প্রেক্ষাপটে আমাদের সৈরজগত যে শুধু বিন্দুসম তাই নয় এর অবস্থান ছায়াপথের এটি বাহুর কোনায়। 


আমরা আমাদের গ্যালাক্সির গঠন ভিডিওতে  আমাদের গ্যালাক্সির সর্পিলাকার গঠন এবং সেখানে আমাদের সৌর জগতটা ঠিক কোথায় অবস্থিত তা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ড. দীপেন ভট্টাচার্যর সঙ্গে ভয়াজার দুই আমাদের সৌর জগৎ ছাড়িয়ে কোনদিকে যাচ্ছে এবং সেই প্রসঙ্গে আমাদের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধক বা সিরিয়াস নিয়ে আলোচনা করব। মানব সমাজের সঙ্গে এই তারাটির কী সম্পর্ক তা নিয়েও কথা বলব। 


দীপেনদা, গতবার আপনি বলেছিলেন যে,  আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির বাইরের দিকে দেখার উপযুক্ত সময় হল শীতকাল যখন আমাদের আকাশে কালপুরুষ, তারপরে ওই যে বৃহৎ সারমেয় যা সহজ বাংলায় বললে  বড় কুকুর মানে  Canis Majorর মত  জনপ্রিয় বা পরিচিত নক্ষত্রমণ্ডলী বা constellation দেখা যায়। আপনি বলেছিলেন এই পর্বে আমাদেরকে  ভয়েজার মহাকাশযানলো কোনদিকে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন। আমরা কী সেখান থেকেই শুরু করবো? 


দীপেন - হ্যাঁ, আমরা বলেছিলাম যে গ্যালাক্সির বাইরের দিকে আমরা প্রথমে কালপুরুষ বাহু, তারপর পারসিয়াস বাহুর সাক্ষাৎ পাব। আর বাহুগুলো কী? বাহুগুলোতে উজ্জ্বল তারার ঘনত্ব বেশি, তাই সেগুলোকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। লুব্ধক আমাদের আকাশের আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা, আমাদের থেকে মাত্র ৮.৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, সেটিও এই কালপুরুষ বাহুর গা ঘেঁষেই অবস্থিত।

Voyager 2 আজ থেকে প্রায় ৩ লক্ষ বছর পরে লুব্ধকের কাছ দিয়ে যাবে, আর যখন বলছি কাছ দিয়ে যাবে তার মানে এখানে হল লুব্ধক থেকে সাড়ে চার আলোকবর্ষ দূর দিয়ে যাবে। কিন্তু তিন লক্ষ বছর পরে লুব্ধক বর্তমান জায়গায় থাকবে না, বরং আমাদের দক্ষিণ আকাশের হাইড্রাস নক্ষত্রমণ্ডলীতে থাকবে। 

বন্যা - এই লুব্ধকের কথা তো আমাদের প্রাচীন সভ্যতাগুলোও জানতো? 


এই সুযোগে আমি লুব্ধক নিয়ে দু একটি কথা বলি। প্রথমত লুব্ধক বা Siriusকে আকাশে চিহ্নিত করা খুব সহজ। কালপুরুষের বেল্টের তিনটি তারাকে যোগ করে দক্ষিণ দিকে বাড়ালেই উজ্জ্বল লুব্ধকের দেখা পাব।
সিরিয়াস বা লুব্ধক একটি A শ্রেণীর তারা, এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হল ১০,০০০ কেলভিন যেখানে সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হল ৬,০০০ কেলভিন। এই তারাটি সূর্য থেকে প্রায় ২৫ গুণ উজ্জ্বল, কিন্তু বয়সে অনেক তরুণ - মাত্র ২৪২ মিলিয়ন বছর, বা ২৪ কোটি বছরের মত, অথচ সূর্যের বয়স হল প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বা সাড়ে চারশ কোটি বছর। 

 

বন্যা - তাহলে যখন লুব্ধক সৃষ্টি হচ্ছিল তখন আমাদের পৃথিবী পারমিয়ান এক্সটিঙ্কশানের শেষের দিকে আর ওদিকে ডাইনসরদেরও  আবির্ভাব ঘটছে...


তাই - তাহলে দেখ পৃথিবীর ইতিহাসের তুলনায় লুব্ধকের ইতিহাস খুবই নতুন, কিন্তু লুব্ধকের সঙ্গে মানব সভ্যতার সম্পর্ক বহু দিনের। প্রাচীন মিশরে, আজ থেকে ৫,০০০ বছর আগে, গ্রীষ্মের সময়, এটি পূর্বাকাশে সূর্য ওঠার ঠিক আগে আবির্ভূত হত, এখনও তাই হয় - ১৯শে জুলাই। ওই সময়ে নীল নদে বন্যা হত, এবং লুব্ধকের নিয়মিত আবির্ভাবের সঙ্গে মিশরীয় সৌরীয় ক্যালেন্ডারের যোগ ছিল। শুধু তাই নয় - মিশরীয়রা এই তারাটিকে বলত sopdet এবং sopdet তাদের কাছে একজন দেবী ছিলেন।

অন্যদিকে গ্রীকরা এই পূর্বাকাশে এই তারাটির আবির্ভাবের সাথে সাথে ভীষণ গরমের তুলনা করত। যেহেতু এই তারাটি বৃহৎ সারমেয়, বড় কুকুর  বা Canis Major-এ অবস্থিত, তাই আকাশে এটির উপস্থিতি Dog Days of Summer এই বাক্যটির প্রচলন করে। প্রাচীন গ্রীক মুদ্রায় লুব্ধক এবং কুকুরের উপস্থিতি এই তারাটি যে কী পরিমাণ গুরুত্বের অধিকারি ছিল তাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

     


 

বন্যা - এই লুব্ধক তো খুব ইন্টেরেস্টিং একটা তারা - তার চারপাশে তো আরেকটা তারা ঘুরছে…এরকম বাইনারি বা যুগ্ম  তারা কি কমন ছায়াপথে?

হ্যাঁ, binary star systemকে আমরা বলছি যুগ্ম তারা। আমাদের ছায়াপথের শতকরা ৮৫ ভাগ তারাই হয় যুগ্ম বা তার থেকে বেশি তারার সমষ্টি, অর্থাৎ তাতে দুটির বেশি তারা থাকতে পারে। লুব্ধকের ব্যাপার হল এর চারদিকে একটি শ্বেত বামন ঘুরছে। লুব্ধককে যদি আমরা বলি সিরিয়াস A, তাহলে এই শ্বেত বামন বা white dwarfকে বলব সিরিয়াস B। এটি মাত্র ২০ জ্যোতির্বিদ্যা  একক দুর্ত্বে প্রতি ৫০ বছরে একবার করে ঘুরে আসছে Sirius A র চারদিকে। 

Sirius B র ভর অনেকটা সূর্যের ভরের মত, কিন্তু তার আকারটি পৃথিবীর সমান। এর উজ্জ্বলতা Sirius Aর থেকে অনেক কম যদিও এর পৃষ্টের তাপমাত্রা ২৫,০০০ সেলসিয়াস। এর বয়স পারয় Sirius Aর কাছাকাছি। মনে করা হয় আজ থেকে ১২০ মিলিয়ন বছর আগে এটি শ্বেত বামনে পরিণত হয়। এটি ছিল সূর্যের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ভরের একটি তারা যেটা কিনা তার ৮০ শতাংশ ভর হারিয়েছে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Density_wave_theory

 

 

বন্যা - তাহলে কি এরা ছায়াপথের বাহুতেই, মানে অরায়েন  বেল্টেই সৃষ্টি হয়েছে? 


না, কারণ সূর্য বহবার ঘুরেছে গালাক্সির চারদিকে। তার জন্মের পরে হয়তো ২০ বার ঘুরে এসেছে। কাজেই কোন বাহুতে লুব্ধক ও কোন বাহুতে সূর্য সৃষ্টি হয়েছে তা আমরা জানি না

বন্যা - আপনাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করবো ভেবে রেখেছিলাম, আমাদের সূর্য তার জীবনকালে ২০ বার ঘুরে এসেছে ছায়াপথের চারদিকে, সে তো বাহু থেকে বেরিয়ে যায় আবার ঢোকে, ছায়াপথের সব তারাই যদি তাই করে, তাহলে বাহুগুলোর আকার কীভাবে ঠিক থাকে? বাহুগুলো  কী করে সৃষ্টি হলো? 

 

এরকম সর্পিলাকার বাহু কী করে সৃষ্টি হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন ভেবেছেন। বর্তমানে spiral density wave বা বক্রাকার ঘনত্ব তরঙ্গ নামে একটি তত্ব জনপ্রিয়। এটা বলে বাহুগুলো কোনো বিশেষ বস্তু দিয়ে সৃষ্ট নয়, বরং সেখানে তারা এবং নীহারিকাদের ঘনত্ব বেশি এবং তারা ও নিহারিকারা সেই ঘনত্বে প্রবেশ করে ও বের হতে যায়। এই এনিমেশনগুলো দিয়ে সেটা বোঝা সম্ভব।

কেন্দ্রের কাছের তারাগুলোকে ঘোরার সময় খুব অল্প পথ পাড়ি দিতে হবে, কেন্দ্রের বাইরের তারাগুলোকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়, তাই কয়েকবার ঘোরার পরই প্রথমে ভেতরটা জড়িয়ে যাবে, তারপর বাইরেটা এবং কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যেই সর্পিলাকার গঠন অন্তর্হিত হবে।

অন্যদিকে সব বাহুগুলো তাদের গঠন বজায় রেখে নিরেট ভাবেও ঘুরতে পারবে না। তাহলে বাইরের তারাগুলোকে সাংঘাতিক জোরে ঘুরতে হবে। পর্যবেক্ষণ তাই বলে না।

অন্যদিকে ঘনত্ব তরঙ্গ তত্ব বলছে বাহুগুলো মোটামুটি একই জায়গায় আছে, তারারা বাহুতে ঢুকছে ও বের হয়ে যাচ্ছে। বাহুগুলো হল ট্রাফিক জ্যামের মত, সেখানে তারা ও নিহারিকাদের ঘনত্ব বেশি হয় এবং তারা বেশি সময় সেখানে থাকে। কী করে বাহুগুলো স্থিত থাকে? এর উত্তর হল মাধ্যাকর্ষণ। গ্যালাক্সিটা যখন সৃষ্টি হয়েছিল সেটি চক্রাকারে ঘুরছিল, তার মধ্যে যদি কোনো জায়গায় তারা বা নিহারীকার ঘনত্ব বেশ হয় সেখানে বস্তুর গতি শ্লথ হবে এবং নতুন তারারা সৃষ্ট হবে, অন্যদিকে পুরোনো তারারা মোটামুটি ভাবে সমস্ত তলে ছড়িয়ে যাবে।  


আমরা কি এমন কোন গ্যালাক্সির সন্ধান পেয়েছি যেখানে এই বাহুগুলো সৃষ্টি হচ্ছে? 

 

উপসংহার - বাহুদের আকার এবং গঠনের এবং  ট্রাফিক জ্যামের কথা শুনতে শুনতে বারবার মনে হচ্ছিল আপনাকে জিজ্ঞেস করি আমাদের  ছায়াপথের কোনদিকে ভ্রমণ করছে?


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles