ক্রিপ্টোকারেন্সি কী? কীভাবে তৈরি হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি?

.

নিজের ঘরে বসেই কম্পিউটার চালিয়ে তৈরি করুন লক্ষ লক্ষ টাকা। সেই টাকা দিন অন্য কাউকে, কোন ব্যাংক বা মোবাইল মানি সার্ভিস ছাড়াই। বাংলাদেশী বেআইনি হলেও বিশ্বের অনেক দেশেই  এখন এটা  সবই সম্ভব ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে।

অনেকের কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সি শব্দটা অপরিচিত লাগতে পারে, তবে হয়তো বিটকয়েনের নাম শুনেছেন, তবে যারা অনলাইনে আনাগোনা  করেন তাদের কাছে হয়তো কোনটাই অপরিচিত নয়। বিটকয়েন, ইথারিয়াম, ডোজকয়েন, এগুলি সবই বিভিন্ন  ক্রিপ্টোকারেন্সি।এই ক্রিপ্টোকারেন্সির সবচাইতে পরিচিত নাম বিটকয়েন, তবে আরো আছে ইথারিয়াম, ডোজকয়েন, মোনেরো, ইত্যাদি।

কিন্তু এই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যাপারটা আসলে কী? কীভাবে তৈরি হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি? কেন ক্রিপ্টোকারেন্সির নিয়ে বিতর্ক?

এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর জেনে নেই থিংকের বন্ধু এবং একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান সাইবারনিরাপত্তা কর্মকর্তা ও ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর জাভেদ ইকবালের কাছ থেকে।

আজকে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে একটা ছোট্ট অনুরোধ, আমাদের ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকেশন পেতে নীচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।

ক্রিপ্টোকারেন্সি হল এক ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা। অনেকের মাথায় হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে আমরা বিকাশ, নগদ বা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করি এগুলোও কি ডিজিটাল নয়?

আমরা ডেবিট কার্ড দিয়ে যখন কিছু কিনছি বা বিকাশে যখন কাউকে পাঠাচ্ছি তখন কিন্তু আমরা যে টাকা পাঠাচ্ছি, তা আদতে কাগজের; শুধু ব্যালেন্স প্রেরক থেকে প্রাপকের অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে।

কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির কোন পার্থিব অস্তিত্ব নেই, এই মুদ্রা ধরা বা ছোঁয়া যায় না। এর অস্তিত্ব কেবল কম্পিউটারের কোডে, ০ আর ১ এর সংকেতে সীমাবদ্ধ। কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর মূল্য সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয় না বা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় না। বাজারে ক্রিপ্টোকারেন্সির চাহিদা এবং সরবরাহ কোন একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে দেয় না। আবার এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় ক্রিপ্টোকারেন্সি টাকা পাচার বা বিভিন্ন অপরাধেও সহায়ক হতে পারে, তাই বাংলাদেশ ও আরো কিছু দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি পুরোপুরি বেআইনী। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের বৈধতা আছে। সম্প্রতি এল সালভেদর বিটকয়েনের লেনদেনকে সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত করে দিয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলেও মাইনিং, ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময়, ট্যাক্স, অর্থপাচার রোধে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বেশ কিছু নীতিমালা তৈরী করেছে।

মুদ্রার প্রচলনের আগে মানুষ পণ্য বিনিময় করতো। যেমন কৃষক চালের বিনিময়ে কামারের কাছ থেকে কাস্তে নিতেন।  কিন্তু কামার যদি চাল নিতে না চান? সরকারী মুদ্রা সবাই নেয়, তাই সমস্যাটা মিটে যায়। তাহলে যদি কেউ এমন মুদ্রা তৈরি করে, যা সরকারী না, কিন্তু অনেকেই সেটা নিতে রাজী? ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারটা ঠিক তাই।

তাহলে মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, কোনও সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু আছে কীভাবে? এর উদ্ভবই বা ঘটলো কীভাবে?
গ্রীক ‘ক্রুপ্টোস’ শব্দটির অর্থ গোপন করা। সেখান থেকেই এসেছে জ্ঞানের ‘ক্রিপ্টোগ্রাফি’ নামের শাখা। ক্রিপ্টোকারেন্সিকে আমরা বাংলায় বলতে পারি গুপ্তমুদ্রা, অর্থাৎ নিজের পরিচয় গোপন করে এই মুদ্রার লেনদেন করা সম্ভব।

২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের কেউ বা কারা “বিটকয়েন” নামে ব্যাংক-বিহীন, কম্পিউটারের মাধ্যমে গোপনে টাকা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন, এবং প্রযুক্তিটা মুক্ত করে দেন। এই বিটকয়েন হচ্ছে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত সবচাইতে সফল ক্রিপ্টোকারেন্সি। সাতোশি নাকামোতো আসলে কে তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা আছে, নিজেকে নাকামোতো দাবী করা মানুষও আছে, তবে তার পরিচয় এখনো কেউ সঠিকভাবে জানে না।
 
আমরা যখন ডিজিটালি কাউকে টাকা পাঠাই, তখন কোনও একটা কম্পিউটারে সেটার হিসাব রাখা হয়। কিন্তু তার মানে হচ্ছে সেই টাকা পাঠানোর কোম্পানিটা জানবে, কে কাকে কত টাকা পাঠাচ্ছে। যদি কোনও কারণে আমরা চাই যে কোনও কোম্পানি সেটা না জানুক, তাহলে আমরা টাকাটা পাঠাতে পারবো না। আবার এই হিসাবটা যদি শুধু প্রাপক এবং প্রেরকের হাতে থাকে, তাহলে একজন মিথ্যা কথা বললেই ঝামেলা লেগে যাবে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি এই সমস্যার একটা দারুণ সমাধান দেয়। প্রতিটা ক্রিপ্টোকারেন্সির একটা বিকেন্দ্রিত হিসাবের খাতা হাজার হাজার কম্পিউটারে ছড়িয়ে আছে, যার নাম “ব্লকচেইন”। প্রাপক এবং প্রেরক যেই হোক না কেন, প্রতিটা লেনদেন এই ব্লকচেইনে নিখুঁতভাবে লেখা হওয়ার পরেই শুধু এই লেনদেন সমাপ্ত হয়েছে বলে ধরে দেয়া হয়।

যেহেতু কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রন নেই, তাহলে লেনদনের হিসাব কে রাখে? যখন কোন নতুন লেনদেন হয়, সেই লেনদেন থেকে এক মেগাবাইট উপাত্ত নিয়ে যে কেউ হ্যাশিং নামে এক ধরণের খুব জটিল অংক করে  উত্তর ব্লকচেইনে জমা দিতে পারে, আর প্রথম সঠিক উত্তরদাতা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে পারিশ্রমিক পায়। এই পুরষ্কারের জন্য অনেকেই এই কাজ করে, ফলে হিসাবটা সঠিক থাকে। এই হিসাব করাটার নাম মাইনিং, আর যারা এই কাজ করে তাদেরকে বলা হয় মাইনার। প্রতিটা লেনদেনের দলিল হচ্ছে সেই অংকের উত্তর, এবং এগুলি টুকরো বা ব্লক হিসাবে লেখা হয়। এই ব্লকগুলি একটা শেকলের মত একের পর এক সাজানো হয়, তাই এর নাম, ব্লকচেইন। এই ব্লকচেইনে লেখা কোনও লেনদেনের হিসাব চাইলেই কেউ জালিয়াতি করতে পারে না, কারন যেকোনও জালিয়াতি প্রতিটি খাতায় না করতে পারলে সেটা বাতিল হয়ে যাবে।

তাহলে কি যে কেউ মাইনিং করে ক্রিপ্টোকারেন্সি উপার্জন করতে পারে? হ্যা, পারে, তবে মাইনিংয়ের নিয়ম এমনভাবে তৈরি যে যত বেশি লোক মাইনিং শুরু করবে, মাইনিং থেকে নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি তত কঠিন হবে। তাই বিটকয়েনের মত দামী এবং বেশি চাহিদার ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর মাইনিংয়ে ঢুকলে নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি পাওয়া কঠিন, আর সেই কাজের জন্য অনেক দামী এবং শক্তিশালী কম্পিউটারও লাগে।

আর এই দামী কম্পিউটারের সাথে জড়িয়ে আছে ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্ধকার দিক। মাইনিংয়ে প্রচুর বিদ্যুৎ লাগে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের দেড় গুনেরও বেশি বিদ্যুৎ যাচ্ছে শুধু বিটকয়েনের পেছনে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়াচ্ছে ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির কারণে অপরাধও বাড়ছে। বিদ্যুতের বিল দিতে গেলে মাইনারদের লাভ অনেক কমে যায়। কম্পিউটার কেনার খরচও আছে। তাই আজকাল অনেক হ্যাকার অন্যের কম্পিউটার হ্যাক করে সেই কম্পিউটারে মাইনিং করছে। ফলে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ভিক্টিমের আর লাভ করছে সাইবার অপরাধীরা।

আমরা থিংকের হ্যাকিং ভিডিওতে দেখেছি, Ransomware দিয়ে কম্পিউটার আক্রমণ করে কোটি কোটি ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি উপার্জন করে নিচ্ছে সাইবার অপরাধীরা। যেহেতু এসব লেনদেনে প্রাপকের পরিচয় গোপন থাকে, তাই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রচলিত মুদ্রার মত ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্যাশ আউট করার জন্যও আছে ক্যাশ এক্সচেঞ্জ, এটিএম বুথ, বা অনলাইনে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিময় করার অ্যাপ। তাই একবার ক্রিপ্টোকারেন্সি পেয়ে গেলে তারা সম্পূর্ণ আইনগতভাবে সেটাকে ডলার বা অন্য কোনও মুদ্রায় পরিবর্তন করে নিতে পারছে।

শুধু তাই না, ডার্ক ওয়েবে ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময়ে হেরোইন বা কোকেইনের মত কড়া ড্রাগস কেনা যায়, এমনকি খুনীও ভাড়া করা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কয়েক বছর আগে সিল্ক রোড নামে এই ধরণের একটি বেআইনি বাজার বন্ধ করেছে।
 
ক্রিপ্টোকারেন্সির ভালো দিকও আছে। বিকাশ বা নগদের মত মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় কাউকে ক্রিপ্টোকারেন্সি পাঠাতে সার্ভিস চার্জ দেওয়া লাগে না। ক্রিপ্টোকারেন্সি পাঠালে সেটা প্রায় সাথে সাথে চলে যায় প্রাপকের কাছে। এছাড়া গোপনীয়তার কারনে আইডেন্টিটি থেফট বা পরিচয় চুরির হাত থেকেও মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির কারণে লেনদেনে জালিয়াতি হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার বিতর্কিত হলেও এর ভিক্টি ব্লকচেইন প্রযুক্তির কিন্তু অনেকগুলো চমৎকার প্রয়োগ হতে পারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। জমি বেচাকেনা ও দলিল, ডিজিটাল আইডি, এরকম অনেক কাজেই বর্তমান বিশ্বে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বন্ধুদের সাথে খেতে যাওয়ার সময় আর এটিএমএ থামা লাগবে না, ক্রিপ্টোকারেন্সিতেই দেয়া যাবে বিল, ক্রিপ্টোকারেন্সি হয়ে উঠবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আমাদের ট্রেনের বা বাসের টিকেট, পরীক্ষার ফলাফল, সংসদ নির্বাচনের ভোট, সবই থাকবে ব্লকচেইনে। এই ব্লকচেইনের প্রযুক্তি নিয়ে ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles