আবারো বছর ঘুরে এলো, শুরু হলো ২০২১ সাল। আবারো আমরা একদিন একদিন করে পুরো বছরটা কাটিয়ে দেবো। কখনো কি প্রশ্ন জেগেছে এই বছরের হিসেব কখন কীভাবে শুরু হলো বা বছরে যে ৩৬৫ দিন সেটা কোথা থেকে এল? এগুলো তো ঠিক আমাদের মহাবিশ্বের বয়স, পৃথিবী বা মানুষ প্রজাতির বয়স নয়। তাহলে এই ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকাগুলোর ভিত্তি কী? দেখা যাচ্ছে, সময়ের গণনার সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম, সমাজ-সংস্কৃতির এক দীর্ঘ ইতিহাস। আসুন, বছরের শুরুতে থিংকের এই বিশেষ ভিডিওতে খোঁজা যাক প্রশ্নগুলোর উত্তর। জেনে নেওয়া যাক প্রাচীন মানব সমাজে সময়গণনা, বছরের হিসেব, ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার ইতিহাস এবং তাদের সাথে পৌরাণিক দেবদেবতাদের সম্পর্ক।
বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার মানুষেরা ঠিকই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে আকাশের চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্ররা স্থির নয়। সুমের, ব্যাবিলন, মিশর, গ্রিক বা ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চাও চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। এমনকি ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট কোপার্নিকাসের প্রায় এক হাজার বছর আগেই বলেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু সে গল্প আজ নয়, তোলা থাক অন্য আরেক দিনের জন্য। আমাদের পূর্বসূরিরা সেই আদি থেকেই দেখেছেন যে সূর্যের উদয় এবং অস্ত যাওয়ার সাথে দিন রাতের চক্র চলতে থাকে। এখান থেকে সময় এবং দিনরাতের ধারণা তৈরি হতে শুরু করে। চাঁদের পক্ষগুলোও দেখা যায় খুব সহজেই, আর সেখান থেকেই শুরু চন্দ্র মাসের। নির্দিষ্ট সময় পরপর ঋতুগুলোও যে ফিরে আসছে তাও তাঁরা দেখতে পেতেন চোখের সামনেই।
আমাদের পূর্বসূরিদের প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাত্রার জন্য শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত, বৃষ্টি বা নদীর প্লাবন ঠিক কখন আসবে সেটার হিসাব জানা ছিলো খুব জরুরি। সেখান থেকেই হয়তো শুরু সময়ের গণনার। প্রথমদিকে বেশিরভাগ প্রাচীন সভ্যতাই বছরের হিসেব করতো চাঁদের উপর ভিত্তি করে। এখনো চীনের নতুন বছর, হিজরি সন, হিব্রু ক্যালেন্ডার, নেপালি পঞ্জিকা বা দেওয়ালির জন্যও চাঁদের বছরই হিসাব করা হয়। কিন্তু এই চান্দ্রপঞ্জিকায় একটি বড় সমস্যা। প্রতিবছর এগারো দিন করে কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রত্যেক বছরের একই সময়ে আর একই ঋতু থাকছে না। তো কিভাবে এর সমাধান করা যায়?
দীর্ঘদিনের আকাশ-পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাচীন জ্যোতির্বিদেরা বুঝতে পারছিলেন যে রাতের আকাশে একেক সময়ে একেক নক্ষত্র বা নক্ষত্রপুঞ্জ দেখা যাচ্ছে, এবং তারা নির্দিষ্ট সময় পরপর ফিরেও আসছে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসার ফলে এটা ঘটছে না জানলেও এখান থেকেই শুরু হয় সৌরকন্দ্রিক সময় এবং ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জিকার ধারণা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে মিশরীয়রা সৌরপঞ্জিকা ব্যবহার করা শুরু করেছিল যা আমাদের বর্তমান পঞ্জিকার প্রায় কাছাকাছি। যেদিন উজ্জ্বলতম তারা সিরিয়াস আকাশে দেখা যেত, সেদিন থেকেই শুরু হতো বছরের প্রথম দিন, নীল নদের বাৎসরিক প্লাবনের ঠিক আগে আগে, যা ছিল সেই কৃষিনির্ভর প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুরো বছরকে তাঁরা ১২০ দিন করে তিনটি মৌসুম一শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায়一ভাগ করে ফেলেছিলেন, আর বছরের ৩৬৫ দিনের বাকি ৫ দিন বরাদ্দ করা ছিল উৎসবের জন্য।
এরকমই আরেকটি প্রায় নির্ভুল সৌরপঞ্জিকা ছিলো উত্তর আমেরিকার মায়াদের সভ্যতায়। প্রতি মাসে ২০ দিন করে মোট ১৮ মাস আর অতিরিক্ত ৫ দিন ছিলো উৎসব, প্রার্থনা ও শোকের জন্য। এছাড়াও ব্যবিলনীয়, চীনা, পারস্যের বা ভারতের প্রাচীন সৌরপঞ্জিকাগুলোও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এখন আমরা প্রায় বিশ্বব্যাপী যে সৌরকেন্দ্রিক পশ্চিমা ক্যলেন্ডার ব্যবহার করি, তাকে বলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আর তা এসেছে প্রাচীন রোমের চন্দ্রপঞ্জিকা থেকে বহু পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মধ্যে দিয়ে !
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর সূচনা কিন্তু ২০২০ বছর আগে নয়! এই তো, ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগোরি থার্টিন পুরোনো জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিকে কিছুটা সংস্কার করে এই ক্যালেন্ডারটি প্রবর্তন করেন ! এই যে বলা হয় যে যিশু খ্রিস্টের জন্ম থেকে শুরু হয়েছে এই পঞ্জিকা, সেটাও কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর ধর্মগুরু Dionysius-এর ভুল গণনা থেকে এটা ধরে নেওয়া হয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে যিশুর জন্ম ৪-৬ BC বা খ্রিস্টপূর্ব ৪-৬ সালে। এমনকি ২৫শে ডিসেম্বরকে যে যিশুর জন্মদিন বলে ধরা হয় সেটাও ভুল। ধারণা করা হয়, রোমের প্যাগানদের শীতের উৎসব থেকেই বোধহয় এই দিনটি নেওয়া হয়েছিল।
তো এখন ব্যাপার হচ্ছে, প্রাচীন আমলে রোমকরা বিশ্বাস করতো, সময় ও সৃষ্টির শুরু এবং সবকিছুর প্রবেশদ্বারের মালিক দুমুখো দেবতা জানুস এবং তাকে দিয়েই শুরু হত জানুয়ারি মাস। ফেব্রুয়ারিতে দেবতা ফেব্রুস আসতো মানুষকে পূতঃপবিত্র করে তুলতে, উৎসর্গ করা হত বিভিন্ন প্রাণী! তারপর শীতের তীব্রতা কমে গেলে শুরু হয়ে যেত যুদ্ধবিগ্রহ। তাই মার্চ যুদ্ধ দেবতা মার্সের মাস। প্রেমিক মার্সের পিছে পিছে এপ্রিল মাসে আসত সৌন্দর্যের দেবী এফ্রোডাইট বা আফ্রোদিতি। তখন গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি ফুটতো, চারদিক ফলেফুলে, সবুজে ভরে যেত। রোমক দেবী মায়া মে মাসে আসত সেই গাছগাছালির পরিচর্যা করতে। তার পরের মাসে আগমন দেবী জুনোর一উৎসব আর বিয়ের বার্তা নিয়ে । এরপর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর যথাক্রমে, ল্যাটিন ভাষা অনুযায়ী সপ্তম, অষ্টম, নবম এবং দশম মাস।তো তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে জুলাই, অগাস্ট গেল কোথায়? এখানেই হচ্ছে মজাটা।
কথিত আছে, রোমানদের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রমিউলাসের সময় থেকে যে-পঞ্জিকা ব্যবহার করা হতো তাতে বছর হিসেব করা হত ৩০৪ দিনে এবং ১০ মাসে। শীতের সময়টাকে কোন মাস হিসেবে ধরা হতো না অর্থাৎ জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি বলে নির্দিষ্ট কোন মাস ছিল না। আর ওদিকে জুলাই এবং অগাস্টকে ডাকা হতো প্ঞ্চম এবং ষষ্ঠ মাস বা ল্যাটিনে Quintilis এবং Sextilis বলে। পরবর্তী সময়ে এদের নামকরণ করা হয়েছিল জুলাই এবং অগাস্ট হিসেবে যথাক্রমে রোমক সম্রাট জুলিয়াস সিজার ও অগাস্টাসের নাম থেকে। শীতের শেষে যখন আকাশে প্রথম নতুন চাঁদ উঠতো তখনই মানে মার্চ মাস দিয়ে শুরু হতো রোমকদের নতুন বছর ।
খ্রিস্টপূর্ব ৭১৩ সালে, রোমান রাজা নুমা শীতের দিনগুলোতে যোগ করলেন আরও দুটি চন্দ্রমাস一জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি। এতে বছরে মোট দিনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৩৫৫। কিন্তু সমস্যা হল, পঞ্জিকাটি ঋতুচক্রের সাথে এখনো ঠিক মিলছে না। তখন নুমা আরও যোগ করলেন প্রতি দুই বছরে একটি সম্পূরক মাস। একবছর ৩৫৫ দিনে হলে পরের বছর হবে ৩৭৭ দিনে। এভাবেই তাদের চক্রাকারে আবর্তিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সম্পূরক মাসের দিনসংখ্যা নির্ধারণের দায়িত্বে-থাকা পুরোহিতেরা নিজেদের স্বার্থে ইচ্ছেমত তা নির্ধারণ করতে শুরু করলো। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালের সাথে প্রায় ১০০ দিন যোগ করলেন। আর তার ফলে সেই বছরের দৈর্ঘ্য হয়ে গেল ৪৫৫ দিন এবং সে-কারণে বছরটিকে বলা হয় বিভ্রান্তির বছর!
মনে আছে শুরুতে সেই যে মিশরীয় পঞ্জিকার কথা বলেছিলাম? জুলিয়াস সিজার মিশরে দুবছর কাটিয়ে ফিরে এসে গ্রিক এবং রোমের সেরা দার্শনিক ও গণিতজ্ঞদের নিয়ে রোমের পঞ্জিকা সংস্কারের কাজে হাত দিলেন। সৌরবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি চার বছর পরপর ফেব্রুয়ারি মাসের সাথে একদিন যোগ করে অধিবর্ষ বা leap year প্রবর্তন করলেন। সংস্কার করা সেই বর্ষপঞ্জিকেই বলা হতো জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি। এ-দিয়েই কাজ চলে যাচ্ছিল তবে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতিবছর ১১ মিনিটের ঘাটতির কারণে প্রায় ১৫০০ বছরে দেখা গেল খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইস্টারের সময় পিছিয়ে গেছে পুরো দশ দিন! তৎকালীন পোপ গ্রেগোরি থার্টিন হিসেব করে দেখলেন, প্রতি চার শতাব্দীতে তিনটি করে লিপ ইয়ার বাদ দিলে মোটামুটি সমস্যাটার একটা সমধান করা যায়। অর্থাৎ, ২০৯৬ সাল অধিবর্ষ হলেও ২১০০ সাল কিন্তু অধিবর্ষ হবে না।
সংস্কারের পর ১৫৮২ সালের অক্টোবরের ৪ তারিখে ঘোষণা দিলেন যে পরের দিন হবে ১৫ই অক্টোবর! হ্যাঁ, আপনি যদি ১৫৮২ সালের কোন ক্যালেন্ডার হাতে পান তাহলে দেখবেন সেখানে ৫ই অক্টোবর থেকে ১৪ই অক্টোবর বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে! বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সারা পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো এতে প্রায় ২৭ সেকেন্ডের একটি ঘাটতি আছে। এর উপরে আবার পৃথিবীর অক্ষের দিক পরিবর্তন, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর গতি পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রায় প্রতি ৭,৭০০ বছরে আমরা পিছিয়ে যাবো পুরো এক দিন। তাই এখন এরও সংস্কারের চেষ্টা চলছে, বেশ কিছু নতুন পঞ্জিকার প্রস্তাব উত্থাপিতও হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে একে প্রতিস্থাপন করবে আরও উন্নত কোনও পঞ্জিকা! বিভিন্ন সংস্কৃতির মতই আমাদের বাংলায়ও আছে একটি স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জি। অন্যদের মতই এরও আছে ঐতিহ্যময় ও বর্ণাঢ্য এক ইতিহাস! সেই গল্প না হয় করা যাবে আরেক একদিন!