যেন আজব এক ঘটনা ঘটলো দুই হাজার একুশের অক্টোবরের ৪ তারিখে - পৃথিবীব্যাপি কোটি কোটি মানুষ তাদের কম্পিউটার আর ফোনে বার বার ফেইসবুক লোড করার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই লোড হচ্ছে না। অনেকেই বারবার ওয়াইফাই রি-স্টার্ট করেছেন - তাতেও কাজ হচ্ছে না! - এমনই আজকের অবসেশন এবং নির্ভরতা সোশ্যাল মিডিয়ার উপর।
আমেরিকায় এখন ফেসবুক পড়তির দিকে হলেও বাংলাদেশ, ভারত বা মিয়ানমারের মত বহু দেশেই ফেসবুককে ইন্টারনেটের সমার্থকের মত ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীব্যাপি নাকি সাড়ে তিনশো কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখা থেকে শুরু করে, ব্যবসার কাজে পর্যন্ত।
কিন্তু আজকের এই উন্নত তথ্য প্রযুক্তির যুগে, কোথায় এবং কেন উধাও হয়ে গিয়েছিল ফেইসবুক ৫-৬ ঘন্টা ধরে? শুধু তো ফেসবুকই নয় তার মালিকানাধীন সব App - Instagram, WhatsApp, Messenger, Oculus ও? দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ফেইসবুক ব্যবহার করে লগইন করা বাকি সব ওয়েবসাইটগুলোরও?
চলুন, আজকে থিংকের বন্ধু জাভেদ ইকবালের কাছ থেকে জেনে নেই কীভাবে, কী ঘটেছিল, যার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে এ ধরণের বিভিন্ন সমস্যা সমস্যার তদন্ত এবং সমাধান নিয়ে।
ধরুন, আমি ঢাকার সোহরাওয়ার্দি হাসপাতাল থেকে হাতিরঝিল যাবো। আমি মহাখালী হয়ে যেতে পারি, তেজগাঁ থেকে রামপুরা হয়ে যেতে পারি, আবার তেজগাঁ হয়ে বেগুনবাড়ি হয়েও যেতে পারি।
ইন্টারনেটও কিছুটা একই ভাবে কাজ করে। আপনার ফোন বা কম্পিউটারের ভিতরেই ফেসবুক আছে মনে হলেও এগুলো থেকে ফেইসবুকে যাওয়ার পথটা কিন্তু জটিল - ফোন থেকে মোবাইল কোম্পানি বা আইএসপি, কিন্তু তার পরে সেটা কক্সবাজারের সাবমেরিন কেবল দিয়ে যেতে পারে, কুয়াকাটার সাবমেরিন কেবল দিয়ে যেতে পারে, অথবা ভারতের উপর দিয়ে টেরেস্ট্রিয়াল(terrestrial) বা ভূপৃষ্ঠের কেবল দিয়েও যেতে পারে।
প্রতিবার যখন এই ডেটা-র সামনে একাধিক পথ পড়বে, সেগুলির মধ্যে থেকে কম খরচ, সবচাইতে দ্রুত পথটা বেছে নিয়ে ডেটাকে পাঠানো হবে।
কিন্তু কীভাবে এই ডেটা জানবে কোন পথটা নিতে হবে?
এই কাজ করে রাউটার নামে এক ধরনের কম্পিউটার। এই রাউটারকে কিন্তু বাসার ওয়াই ফাই রাউটার ভাববেন না - এই রাউটারগুলিকে তার পরের গন্তব্যের খবর, সেটা কত দ্রুত, খরচ কত, ইত্যাদি প্রোগ্রাম করে দেয়া হয় - এই নির্দেশ বা কনফিগারেশন ব্যবহার করে রাউটারগুলি শতশত বা হাজার হাজার গ্রাহকের ডেটা তার পরবর্তি রাউটারে পাঠায়।
ইন্টারনেটকে একটা শহরের রাস্তাগুলোর সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে সারাক্ষণ খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। আর সেই শহরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে কোন রাস্তা খোলা, কোন রাস্তা বন্ধ, এরকম একটা ম্যাপ থাকা অপরিহার্য।
সব বড় কোম্পানি আর আইএসপিগুলি তাই নিজেদের নেটওয়ার্কে কোন পরিবর্তন হলে ইন্টারনেটের ম্যাপে সেই পরিবর্তন জানিয়ে দেয় বর্ডার গেইটওয়ে প্রটোকল বা বিজিপি-র মাধ্যমে, যাতে বাকিরা তাদেরকে খুঁজে পায়। আর নেটওয়ার্কগুলি সেই অনুযায়ী নিজেদের আশেপাশের ইন্টারনেটের ম্যাপ নতুন করে তৈরি করে নেয় রাউটারের মেমোরিতে।
হ্যাঁ, অনলাইনে যা তাৎক্ষণিক বলে মনে হয় তার পেছনে প্রতি মুহুর্তে আসলে এত কিছু ঘটে চলেছে!
কিন্তু যদি কোন রাউটার কাউকে ভুল ফোন নাম্বার দেয়ার মত নিজের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়? অথবা ম্যাপ মুছে দেয়ার মত করে নিজের সব তথ্য সরিয়ে নেয়?
তাহলে ইন্টারনেটের ম্যাপে ভুল হয়ে যাবে, আর তাকে আশেপাশের কোন নেটওয়ার্ক খুঁজে পাবে না।
ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপের ঠিক এই সমস্যাই হয়েছিল।
রাউটারের কাজেরও প্রকারভেদ আছে। কিছু রাউটারকে বলা হয় ব্যাকবোন বা মেরুদণ্ড রাউটার। মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেলে মানুষ প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। ব্যাকবোন রাউটার কাজ না করলে একটা কোম্পানিও প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।
ভুল নির্দেশ দেয়ায় ফেইসবুকের ব্যাকবোন রাউটার অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ফলে ফেইসবুকের সব কম্পিউটার কেন্দ্র বা ডেটা সেন্টার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ফেইসবুকের কিছু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে, যাতে ব্যবহারকারীদের অকার্যকর ডেটা সেন্টারে পাঠানো না হয়, এবং সেটা করা হয় বিজিপির মাধ্যমে। কিন্তু এবার সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাই কাল হলো। যখন ফেইসবুকের ডোমেইন নেইম সিস্টেম বা ডিএনএস সার্ভারগুলি দেখল ডেটা সেন্টারগুলির সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, তারা বিজিপির মাধ্যমে সারা ইন্টারনেটকে জানিয়ে দিল যে ফেইসবুকের ডেটাসেন্টারগুলি আর নেই। ফলে ইন্টারনেটের ম্যাপ থেকে মুছে গেল ফেইসবুকের ঠিকানা।
শুধু তাই না, ফেইসবুকের প্রকৌশলীরাও নিজেদের রাউটারে ও সার্ভারে যোগাযোগ করতে পারছিল না। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ফেইসবুকের কর্মচারীরা নিজেদের অফিসের দরজা পর্যন্ত তাদের আইডি কার্ড দিয়ে খুলতে পারছিল না - এই সব কারনে সমস্যাটা ঠিক করতে এত দেরী হয়েছে।
আর তাই একটা ভুল নির্দেশের কারনে একে একে ফেইসবুকের সব পরিসেবা ভেঙ্গে পড়ে - আর এভাবেই পথ হারিয়েছিল ফেইসবুকের পথিকেরা সেদিন।