করোনাভাইরাস: গুজব ও বিভ্রান্তি | Coronavirus: Myths and Facts | Think Bangla

.

করোনাভাইরাস নিয়ে গোটা বিশ্বে আতঙ্কের সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের গুজব, টোটকা, বিভ্রান্তিকর সব সমাধান। একদিকে কেউ ফুসফুস বের করে এনে সাবান দিয়ে ধোয়ার মত উদ্ভট কথা বলছেন, অন্যদিকে যে যাঁর মত, অপরীক্ষিত ওষুধ, টোটকা বা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সব পদ্ধতির কথা বলে চলেছেন। এখন ফেসবুক সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সবাই ডাক্তার বা বিজ্ঞানী বনে গেছেন। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, শ্বাসের সাহায্যে ইথানল গ্রহণ করলে করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দেশের এক মাইক্রোবায়োলজিস্ট নাকি মুরগির উপর পরীক্ষা করে এটা বের করেছেন। প্রথমত, মুরগির উপর পরীক্ষা থেকে কোনভাবেই বলা যায় না এটা মানুষের ওপর কাজ করবে কিনা; দ্বিতীয়ত, মুরগির আর মানুষের করোনাভাইরাস এক নয়; তৃতীয়ত, এভাবে ক্লিনিকাল ট্রায়াল ছাড়া ওষুধ গণহারে প্রেস্ক্রাইব করা অত্যন্ত  বিপজ্জনকও হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ শ্বাসনালীতে ইথানল বাষ্প প্রবেশে শ্বাসনালীর কোষের ক্ষতি হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে, বিশেষ করে যাঁদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। সম্প্রতি ইরানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার গুজবে অ্যালকোহল পান করে ৬০০ লোক মৃত্যুবরণ করেছেন।

 


অনেকে আবার বলেছেন ভদকা বা হুইস্কির মত এলকোহল পান করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এসবে তো এলকোহলের পরিমাণ ৪০% এর বেশি নয়। যে-এলকোহল ওয়াইপ দিয়ে ভাল করে মুছলে এই করোনাভাইরাস বা বা SARS-Cov2 মরে যায় তার মধ্যে ৭০% এলকোহল থাকে। এর চেয়ে কমে এই করোনাভাইরাস ধ্বংস হয় না। খুব করে গরম চা খেলে বা প্রচুর পরিমাণে পানি খেলে  ভাইরাস হয় মরে যায় অথবা সোজা পেটের ভেতরে চলে যায়। আর একবার পেটে চলে গেলে নাকি পেটের এসিডে ভাইরাসের দফারফা। এর সাথে শোনা যাচ্ছে  নানা ভেষজ চিকিৎসা: রসুন, আদা থেকে শুরু করে  গরম মসলা, লবণ পানি, মধু, থানকুনি পাতা পর্যন্ত কিছুই বাদ নেই! এটা ঠিক যে বিভিন্ন খাদ্য আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে যেটা এই মুহূর্তে খুব জরুরি। আর বেশি করে পানি খেয়ে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা তো সবসময়ের জন্যই ভালো। তবে এরা কোভিড-19 প্রতিরোধে আলাদা করে কোন ভূমিকা রাখতে পারে এমন কোন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। 



শোনা যাচ্ছে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন নাকি কোভিড-19 সারিয়ে দিতে পারে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে কোথাও কোথাও চিকিৎসকেরা কোভিড-19 রোগীর উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করে কিছু উপকার পেয়েছেন, কিন্তু  যথাযথ পরীক্ষা না করে কিছুতেই বলা সম্ভব না যে এতে আসলেই রোগ সারে। গবেষকরা যখন দিনরাত করোনা ভাইরাস ঠেকানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্চের ২১ তারিখে টুইটারে এসে লোকজনকে হঠাৎ এই HYDROXYCHLOROQUINE-এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশাল জ্ঞান দিয়ে দিলেন। ব্যাপারটা যতটা হাস্যকর তারচেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর! মার্চের ২৫ তারিখ অ্যারিজোনাতে এক লোকের মৃত্যু হয় একুরিয়াম পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত CHLOROQUINE খেয়ে। প্রায় একই সময়ে  নাইজেরিয়াতে CHLOROQUINEজনিত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা আচমকা বেড়ে যায়। আবার ওদিকে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অনেক জায়গায়  বিসিজি, যক্ষ্মার টিকা বা এন্টিবায়োটিক, কোভিড-19-এর নিউমোনিয়ার মত লক্ষণগুলো ঠেকাতে সক্ষম বলে একটা অতিকথন শোনা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনা ভাইরাস মিথ বাস্টার পাতায় বলা আছে, বিসিজি বা যক্ষ্মার টিকা এমনকি আমাদের চেনা অ্যান্টিবায়োটিক বা ফ্লুর ভ্যাক্সিনগুলো আসলে কাজ করবে কিনা তা আমরা এখনো জানি না। 



ইতালি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের আক্রান্তের সংখ্যার তুলনায় আমাদের উপমহাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। জানামতে এর পিছনে দুটো কারণ: সংক্রমণের ঢেউ ঐ দেশগুলোতে এসেছে আগে, এবং আমাদের দেশগুলোতে মোট জনসংখ্যার তুলনায় পরীক্ষা করা হয়েছে খুব অল্পসংখ্যক মানুষকে। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে অনেকে এই ভাবে ব্যাখ্যা করছেন, যে করোনাভাইরাস গরম আর আর্দ্র আবহাওয়াতে টিকতে পারে না, বা আমাদের জিনে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক শক্তিশালী। কাজেই এথেকে আমাদের বিপদের আশঙ্কাও অনেক কম। কিন্তু এর পক্ষে এখনো তেমন কোনো জোরদার প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং তাছাড়া, গরম অঞ্চলেও এই ভাইরাসকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। কাজেই এই কথার ওপর ভরসা করে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে এবং টেস্টিং বা ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা না করলে সামনে যে ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসছে, তাতে সন্দেহ নেই। 



কমবয়েসীরা নাকি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয় না, সুতরাং তাদের সচেতন না হলেও চলবে এমন ধারণার ভয়াবহতা কল্পনাতীত। নবজাতক থেকে বৃদ্ধ, সবাই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হতে পারেন, কমবয়েসি অনেকে মারাও গেছেন এর মধ্যে। এবং যেহেতু অনেক আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যেই এই রোগের লক্ষণ সুপ্ত থাকে তাই আপনি কমবয়েসি এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলে নিজে হয়তো বেঁচে যাবেন, কিন্তু আপনার মাধ্যমে সংক্রমিত অনেকের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। করোনাভাইরাস যেমন বয়স বাছবিচার করে না, তেমনি ব্যক্তি ও স্থানও বিচার করে না। এই ব্যক্তি খুব ভালো মানুষ, সুতরাং তার কোভিড-১৯ হবে না, কিংবা ওই জায়গাটা অত্যন্ত পবিত্র, সেখান থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াবে না, এসব চিন্তা-ভাবনা আত্মঘাতী। ভালো-মন্দ সব মানুষেরই অসুখ হয়, এবং কোনো অসুখই আপনার ভক্তি বিশ্বাস অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। কোভিড-১৯ একটি অসুখ, যা ভয়ঙ্কর মাত্রায় ছোঁয়াচে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের কাছাকাছি গেলেই আপনিও এই রোগে সংক্রমিত হবেন। আর এই সংক্রমণ হতে পারে ঘর থেকে, চায়ের দোকান থেকে, সিনেমাহল-বাজার-উপাসনালয়সহ সকল ধরণের জনসমাগম থেকে, এমনকি দুজন ব্যক্তির ছয় ফুটের কম দূরত্বে দেখা-সাক্ষাৎ থেকেও।


এই মুহূর্তে ধর্মপালন কিংবা ত্রাণ বিতরণসহ সব ধরনের সকল জনসমাগম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে একদিকে যেমন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণের ব্যবস্থা অবিলম্বে  নিশ্চিত করতে হবে, ঠিক তেমনি আবার ত্রাণ বিতরণের জন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনাসহ বিধিনিষেধ জারি করতে হবে। আর ওদিকে সাধারণ মানুষের উচিত সরকারি নির্দেশনার আশায় বসে না থেকে নিজেরাই সব ধরনের জনসমাগম বন্ধে  উদ্যোগী হওয়া। 

কারণ আপনি অপেক্ষা করলেও করোনাভাইরাস সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকে না।আসলে যে-পরিমাণ ভুল ধারণা, বিভ্রান্তি বা গুজব ছড়িয়েছে, ছোট্ট একটি ভিডিওতে তার সবগুলো তুলে-ধরা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।


আমাদের সমাজে এমনিতেই কুসংস্কারের ঘনবসতি, এই বিপদের দিনে তারাও ভাইরাসের মতো বংশবৃদ্ধি করবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো 'তথাকথিত' সুশিক্ষিত পশ্চিমি দেশগুলোতেও এ জাতীয় গুজবের এবং ক্ষতিকর সব তথ্যের কোনো কমতি নেই। এই নভেল SARS-Cov2 করোনাভাইরাসের কোনো টিকা বা ওষুধ এখনো নেই। বিজ্ঞানীরা খুব তাড়াতাড়ি করে  কিছু বের করতে পারলেও তার জন্য হয়তো এক বা দেড় বছর সময় লেগে যেতে পারে। জাপানে তৈরি SARS-এর ওষুধ এভিগান কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে বলে শোনা গেলেও এর জন্য দরকার যথাযোগ্য ক্লিনিকাল ট্রায়াল। এখন এই অবস্থায় দরকার বৈজ্ঞানিকভাবে এই বিপদের স্বরূপটা চিনে নেওয়া। এসব গুজবে কান না দিয়ে,  হোমিওপ্যাথি, কোবরেজি, হেকিমি, বনাজি বা অপরীক্ষিত সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু বিশ্বাসযোগ্য সোর্স থেকে তথ্য যোগাড় করা এবং নিয়ম মেনে সুস্থ থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। নিজে জেনে নিন এবং আত্মীয়বন্ধুসহ আশেপাশের সবাইকে বোঝান এই সব গুজব ও টোটকার বিপদের কথা। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন!



সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles