করোনাভাইরাসের আক্রমণে আজ সারা পৃথিবী কাঁপছে। এই SARS-COV2 ভাইরাস থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিড নাইন্টিন রোগে ইতোমধ্যেই সংক্রমিত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ, মারা যাচ্ছে হাজারে হাজারে। চলুন আজকে আমরা দেখে নেই এই ভয়ংকর ভাইরাস কীভাবে হাইজ্যাক করে নেয় আমাদের শরীরের কোষগুলোকে, উল্টো চালাকি করে তাদেরকেই কাজে লাগিয়ে!আকারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ভাইরাস শুধু ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচেই দেখা যায়, দেখা যায় এর গোল বলের মতো চেহারা, যার সর্বাঙ্গে স্পাইক বা কাঁটা। সব মিলিয়ে রাজার মুকুট বা ক্রাউনের মতো, সে থেকেই এর নাম করোনা। বলের কাঁটাগুলো হচ্ছে প্রোটিন, আর মেমব্রেন অর্থাৎ খোসাটা স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট দিয়ে তৈরি, এটাই ভেঙে পড়ে সাবান ব্যবহার করলে।
কিন্তু যে ভাইরাসটা সামান্য সাবানে ভেঙে পড়ে, সে কীভাবে এত মানুষের জীবনহানির কারণ হচ্ছে? আসুন জেনে নিই মারাত্মক এই অদৃশ্য শত্রু কীভাবে আমাদের শরীরকে আক্রমণ করে।আমরা জানি যে, চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এই করোনাভাইরাস। ঢুকেই সে শ্বাসনালীর কোষকে হাইজ্যাক করার কাজ শুরু করে দেয়, দিব্যি সেঁটে যায় কোষের আবরণে থাকা সূক্ষ্ণ প্রোটিনকণা ACE2-র গায়ে। এই সংযুক্ত হয়ে যাওয়াটা অনেকটা তালা-চাবির মত কাজ করে। করোনাভাইরাসের গায়ের কাঁটা চাবির মতো ঢুকে যায় এই প্রোটিনকণার ভেতরে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, বাদুড় থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে এই নভেল ভাইরাসটা। বাদুড়ের ভেতরেও একই ধরনের প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হতো বলেই সে এখন আমাদের কোষের এই ACE2 প্রোটিনকণার দরজাও খুলে ফেলতে পারে।
এবার সে নিজের আবরণটিকে আমাদের কোষের ভেতরে গলিয়ে দেয়। আর ঢুকে যাওয়া মাত্রই ভাইরাসটি তার নিজের ভেতরের, RNA-এর একটা অংশ উন্মুক্ত করে দেয়। এই RNA হলো জেনেটিক বা বংশগতীয় উপাদান, এবং এটাই হাইজ্যাক করে নেয় আমাদের কোষের ভিতরের কলকব্জাগুলো। করোনাভাইরাসের ভেতরে থাকে RNA, কিন্তু আমাদের কোষে থাকে DNA। এই DNA-র মধ্যেই লেখা আছে কোষকে কী কী কাজ করতে হবে তার তালিকা। আমাদের কোষের ভিতরে আরও আছে প্রয়োজনীয় প্রোটিন বানানোর সব মেশিনারি, যাকে এর মধ্যেই দখল করে নিয়েছে এই করোনাভাইরাস।
এর ফলে এখন যা ঘটে তা হলো, এই ভাইরাসের নির্দেশে কোষের কলকব্জাগুলো ভাইরাসের RNA-এর অনুলিপি তৈরি করতে শুরু করে দেয় । হাইজ্যাক হওয়া সেই বেচারা সংক্রমিত কোষটা এখন বানাতে থাকে ভাইরাসের প্রোটিনগুলো, তারপর একে একে তৈরি করে স্পাইক বা কাঁটাগুলোও। এক পর্যায়ে এই সব অংশ জোড়া লেগে তৈরি হয়ে যায় নতুন ভাইরাস। আর এভাবেই জন্মাতে থাকে একের পর এক ভাইরাস! কোষের ভেতরে লুকিয়ে থাকে ব’লে আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হাত থেকেও বেঁচে যায় এরা। একেকটা সংক্রমিত কোষ থেকে সৃষ্টি হতে পারে মিলিয়ন মিলিয়ন ভাইরাস।
এই নতুন জন্মানো ভাইরাসেরা শুধু যে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে তাই না, এরা এক পর্যায়ে তাদের পোষক-কোষকেও ধ্বংস ক’রে ফেলে এবং বেরিয়ে আসে সেই কোষের ভেতর থেকে। তারপর আমাদের দেহের অন্যান্য কোষগুলোকেও একে একে হাইজ্যাক করে চালাতে থাকে দুর্দান্ত এই বংশবৃদ্ধির খেলা। এরা সামনে যে কোষ পায় তাকেই আক্রমণ করে। আবার কিছু ভাইরাস ফুসফুস থেকে বেরিয়ে যায় হাঁচি-কাশির সাথে নাকমুখ দিয়ে, এবং সংক্রমিত করতে থাকে আশেপাশের বহু লোকজনকে। ভাইরাসের এই ধ্বংসলীলা থামানোর জন্য শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুরু হয় লড়াই, যার ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এ জন্যই শরীরে জ্বর আসে। রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে খুব বেশি ক্ষতির আগেই হয়তো উনি এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে যান, কিছু প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাওয়ার পরই সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি।
কিন্তু যাঁদের এই স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, যাঁদের শ্বাসযন্ত্রের কোনো অসুখ, ডায়বিটিস, হৃদরোগের মত অসুখ আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে ভাইরাসের আক্রমণ, এতো সহজে ঠেকানো যায় না। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যখন চরমে পৌঁছায়, তখন শরীরের প্রতিরক্ষাকারী কোষগুলো বিভ্রান্ত হয়ে যায়, এবং ভুল ক’রে ফুসফুসের কোষকেও আক্রমণ করতে শুরু করে। এর ফলে ফুসফুস যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি মৃত কোষ ও তরলে ভরে যায় ফুসফুসের ভেতরটা। শরীর আর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না, আক্রান্ত মানুষ শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করে যাকে বলে “Acute Respiratory Distress Syndrome”, যা কোভিড-নাইন্টিনের গুরুতর অবস্থার একটা প্রধান লক্ষণ!
এই সময় রোগীর দরকার হয় কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের বন্দোবস্ত, যা ভেন্টিলেটর যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর কোনো দেশই এরকম ভয়ঙ্কর মহামারীর জন্য প্রস্তুত ছিল না। প্রায় সব দেশেই ভেন্টিলেটরের চরম অভাব দেখা দিয়েছে।উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যে-দেশগুলো মৃত্যুর হার কমাতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তারা আসলে গোড়াতেই যেটা করা দরকার ছিলো, সেটা করেনি। যতো বেশি সম্ভব রোগীর টেস্ট করে রোগের উৎস যেসব এলাকা সেগুলোকে সনাক্ত করে কোয়ারেন্টিন করা, এবং খোলাখুলিভাবে বিপদের গুরুত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝে এবং জনগণকে বুঝিয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সেই অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
আইসল্যান্ড একটা ছোট্ট দেশ হলেও তারা বৈজ্ঞানিক সচেতনতা এবং গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য পরিচিত। সেখানে কোভিড নাইন্টিনের ব্যাপক টেস্টিং থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কোভিড-19 এর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। শুধু আইসল্যান্ডেই নয়, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সব দেশেই বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে খুব অল্প সিম্পটম বা কোনো সিম্পটমই দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, এই মারাত্মকভাবে ছোঁয়াচে ভাইরাসটি বিশাল অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেও বেশিরভাগের মধ্যেই তেমন কোনো ক্ষতি করে উঠতে পারছেনা, তাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যুদ্ধে হারিয়ে দিচ্ছে এই ভাইরাসকে।
প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তনের নিয়ম মেনে এই ভাইরাসটা যেমন একের পর এক সংক্রমণের মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এবং বংশবৃদ্ধি করতে চাচ্ছে, ঠিক একই কারণে আক্রান্ত মানুষের শরীরও এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তাহলে এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের হাতে উপায় দুটো: প্রথমত, সামাজিক দূরত্ব এবং কোয়ারেন্টিনের নিয়ম মেনে চলে এর ছড়িয়ে-পড়া বন্ধ করা এবং অন্যদিকে শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানো অর্থাৎ শরীরে শক্তসামর্থ্য রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা যাতে এই ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত হলেও তাকে আমাদের শরীর দখল করে বড় কোন ক্ষতি করার আগেই ধ্বংস করে দেয়া যায়।
আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তাদের উচিত এখনি সচেতনভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেয়া এবং অন্যদেরও এব্যাপারে যথাসম্ভব সচেতন হতে সাহায্য করা। নিজে বাঁচুন, অন্যদের বাঁচতে সহায়তা করুন - এটাই এখন টিকে থাকার একমাত্র উপায়।এই মারাত্মক ভাইরাসটি কী, কীভাবে কাজ করে এবং আমাদের এখন কী কী করা উচিত জানতে থিংক এর করোনাভাইরাস সিরিজের ভিডিওগুলো দেখুন নিচের লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করে। নজর রাখুন আমাদের চ্যানেলে। আমাদের ভিডিওগুলো যদি ভালো লাগে তাহলে সাবস্ক্রাইব করতে এবং সাথে সাথে নতুন ভিডিওর নোটিফিকেশন পেতে পাশের বেল আইকনটিতে ক্লিক করতে ভুলবেন না যেন। থিংক টিমের পক্ষ থেকে সবার সুস্থতা কামনা করছি।