আলোর চাইতেও দ্রুত চলছে স্পেইসশিপ! এক নিমেষে এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে অভিযান চালাচ্ছে মানুষ - সায়েন্স ফিকশন সিনেমার ভক্তরা নিশ্চয় এরকম অনেক কাহিনি দেখে অভস্ত্য। কিন্তু, কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?
না সম্ভব না - গণিত দিয়ে দেখানো সম্ভব যে, যা কিছুর ভর আছে তা আলোর গতিতে চলতে পারে না।
চলুন তাহলে এই ভিডিওতে আমরা সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি কেন আসলে আলোর চাইতে দ্রুত চলা সম্ভব না।
আমরা জানি, দৈর্ঘ-প্রস্থ-উচ্চতার সাথে সময়কেও একটা মাত্রা হিসেবে ধরা হয় ।
কেন?
আমরা চাইলে দৈর্ঘ বা প্রস্থে চলতে পারি। সিঁড়ি বা মই, বেলুন, প্লেন বা রকেট থাকলে আমরা উচ্চতার মাত্রাতেও চলতে পারি। কিন্তু সময়ের মাত্রায় চলাচল? শুনে হয়তো অবাক হবেন, আমরা একইভাবে সময়ের মাত্রাতেও চলছি, তবে সেটা নিজের ইচ্ছাতে নয়। আমরা চাইলেই বাম থেকে ডানে যেতে পারি, আবার ফিরেও আসতে পারি। কিন্তু সময়ে চলাচলের ওপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
কিন্তু কেমন এই সময়ে চলাচল?
এই ফ্লাইওভারটার কথা চিন্তা করা যাক। গাড়িগুলো ছুটে চলেছে, ফ্লাইওভারটা দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়, তাই না? যদি বলি, ফ্লাইওভারটা ভ্রমণ করছে? কথাটা আজব, তাই না? তবে এই ফ্লাইওভারটা নতুন কোন স্থানে যাচ্ছে না। পৃথিবীর আহ্নিক বা বার্ষিক গতি, সূর্য এবং ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে গতিপথ,বিচার করলে কিন্তু ফ্লাইওভারটি নতুন স্থানে যাচ্ছে, যদিও আমাদের কোনো স্থির অবস্থানের তুলনায় সেটি নতুন কোনো স্থানে ভ্রমণ করছে না। তবে ফ্লাইওভারটা নতুন সময়ে যাচ্ছে। একটু ভেবে দেখুন, সকাল আটটার এক ঘন্টা পরে ফ্লাইওভারটা সকাল নয়টায় থাকবে। তার আরো এক ঘন্টা পরে পৌঁছাবে সকাল দশটায় । অর্থাৎ ‘সময়ে’ ফ্লাইওভারটা স্থির না, কিছুই স্থির না। অর্থাৎ সবকিছুই আসলে সময়ে ভ্রমণ করছে। তাই সময়ও একটা মাত্রা।
সকাল নয়টা থেকে সকাল দশটা যেতে ফ্লাইওভারটার ঠিক ৩৬০০ সেকেন্ড লাগে। এই গতিটা আমরা চাইলেই বাড়াতে পারি না। আমরা এক সেকেন্ড কম সময়ে, মানে, ৩৫৯৯ সেকেন্ড সময়ে সকাল নয়টা থেকে সকাল দশটা করতে পারি না। আর যেহেতু সেটা পারি না, তার মানে সময়ের একটা সর্বোচ্চ গতি আছে।
এই ব্যাপারে আমাদের কিন্তু এখনো কোন ক্ষমতা নেই, আমাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছার কোন দাম নেই; মহাবিশ্ব আমাদেরকে কানে ধরে সময়ে ভ্রমণ করিয়ে ছাড়বেই।
এবার দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসি। যে কোন গাড়ির একটা সর্বোচ্চ গতি থাকে। স্পিড লিমিটের উপরে গাড়ি চলতে পারে, কিন্তু রাস্তা যতই খালি হোক না কেন তার ক্ষমতার বাইরে কিন্তু গাড়িটা যেতে পারে না।
ধরুন আমাদের একটা গাড়ি আছে, যেটার সর্বোচ্চ গতি ৩০০ কিমি/ঘন্টা।
গাড়িটা এই ছবির মত একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা সোজা উত্তর দিকে যেতে পারে। তখন তার পূর্ব দিকে গতি শূন্য। আবার গাড়িটা সোজা পূর্ব দিকেও যেতে পারে। তখন তার উত্তর দিকে গতি শূন্য। আর গাড়িটা যদি উত্তর-পূর্ব দিকে যায়, তাহলে তার উত্তর দিকে কিছু গতি আছে, আবার পূর্ব দিকেও কিছু গতি আছে। কীভাবে? যদি গাড়িটা এক ফুট পূর্ব দিকে যায়, তারপর বামে ঘুরে এক ফুট উত্তর দিকে যায়; আবার ডানে ফিরে এক ফুট পূর্ব দিকে যায়, তাহলে দুই দিকেই তার গতি থাকবে। দাবায় ঘোড়া যেভাবে চলে, অনেকটা সেই রকম। তাহলে কিছুক্ষন পরে দেখা যাবে, তার আসলে উত্তর-পূর্ব দিকে সরণ হয়েছে, এবং সেটার একটা গড় গতি আছে, আবার উত্তর দিকে এবং পূর্ব দিকে আলাদা আলাদা গতিও আছে, কিন্তু সেই গতিগুলি উত্তর-পূর্ব দিকের গতির চাইতে কম।
এটা আরেকটু ভেঙ্গে বলি।
গাড়িটা যদি সোজা উত্তর দিকে যায়, তাহলে উত্তর দিকে তার সর্বোচ্চ গতি ৩০০ কিমি/ঘন্টা, পূর্ব দিকে গতি শূন্য।
গাড়িটা যদি সোজা পূর্ব দিকে যায়, তাহলে পূর্ব দিকে তার সর্বোচ্চ গতি ৩০০ কিমি/ঘন্টা, উত্তর দিকে গতি শূন্য।
গাড়িটা যদি উত্তর-পূর্ব দিকে যায়, তাহলে উত্তর-পূর্ব দিকে তার সর্বোচ্চ গতি ৩০০ কিমি/ঘন্টা, উত্তর দিকে গতি ৩০০-র কম; পূর্ব দিকে গতিও ৩০০-র কম।এখানে কত কম, সেটা জানা জরুরী না, শুধু কম, সেটা বুঝলেই হবে।
আগেই বলেছি, দৈর্ঘ-প্রস্থ-উচ্চতার মত সময়ও একটা মাত্রা। বোঝার সুবিধার জন্য দৈর্ঘ-প্রস্থ-উচ্চতা মিলিয়ে শুধু একটা মাত্রার কথা মনে করি, যেটার নাম স্থান।
আমরা ঠিক গাড়িটার গতির মতই একটা রকেটের গতির ছবি কল্পনা করি, যেখানে উলম্ব বা ওয়াই অক্ষে স্থান বা স্পেইস , আর আনুভূমিক বা এক্স অক্ষে সময়ের গতি দেখানো হবে।
মনে আছে নিশ্চয়, গাড়িটা যদি সোজা উত্তর দিকে যায়, তাহলে উত্তর দিকে তার সর্বোচ্চ গতি ৩০০ কিমি/ঘন্টা হতে পারে, পূর্ব দিকে গতি শূন্য।
আমরা যদি সময়ে বা টাইমে সর্বোচ্চ গতিতে চলি, অর্থাৎ আনুভূমিক সময়ের অক্ষ ধরে, তাহলে স্থানের মাত্রায় আমাদের গতি কত হতো? ফ্লাইওভারের উদাহরণ মনে আছে? ফ্লাইওভারটা একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সময়ে ভ্রমণ করছে। একই স্থানে দাঁড়ানো মানে কিন্তু স্থানে গতি শূন্য। অর্থাৎ সময়ের সর্বোচ্চ গতিতে স্থানের মাত্রায় আমাদের গতি শূন্য হয়ে যায়। তাহলে কী দাড়ালো? সময়ের সেই বিশেষ গতিতে আমরা স্থান পরিবর্তন করতে পারবো না, এক পরমাণু পরিমানও না। সেই জন্য ফ্লাইওভারটা সময়ের সেই গতিতে একই স্থানে দাড়িয়ে থাকে।
আরেকটু দেখা যাক। যদি আমরা দেশ-কাল বা স্থান-কাল বা স্পেইস-টাইম দুইটাতেই চলি? (২য় ছবির মধ্যের কৌণিক রেখা)। যেহেতু আমরা জানি যে সময়ে চলার ব্যাপারে আমাদের কোন হাত নেই; সুতরাং যখনি আমরা নড়াচড়া করি, তখন আমরা স্পেইস বা স্থান আর টাইম বা সময় , দুইটাতেই চলছি— স্থানে নিজের ইচ্ছায়, সময়ে মহাবিশ্বের নিয়মে।
আমরা হয় সময়ে ভ্রমণ করি আর স্থানে বসে থাকি ফ্লাইওভারটার মত, অথবা স্থান ও সময়ে (স্পেইস-টাইমে) ভ্রমণ করি।
শুধু স্থানে ভ্রমণ করবো, সময়ে করবো না, এটা কি সম্ভব? আমরা যদি স্থান বা স্পেইসে আমাদের গতি বাড়াতে থাকি, অর্থাৎ আমরা উলম্বের দিকে যদি সরতে থাকি, তাহলে টাইমে/সময়ে গতি তত কমতে থাকবে। কথাটা পরিচিত মনে হচ্ছে? আলোর গতির যত কাছে আমরা যাবো, সময় তত ধীরে প্রবাহিত হবে। এভাবে গতি বাড়তে বাড়তে একটা গতিতে আমাদের সব গতি স্থান-, সময়ে আমাদের গতি শূন্য।
আবারও বলি। রকেটটা যদি শুধু স্থানের অক্ষে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিতে চলতে পারে, তাহলে সময়ের অক্ষে তার গতি কত? সময়ে তার গতি তখন শূন্য, অর্থাৎ সময় থেমে যাবে। কিন্তু সেই সর্বোচ্চ গতিটা কত?
গতি বাড়লে সময় ধীর হয়ে যাওয়া পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। আমরা প্রথমেই দেখেছি, সময়ের একটা সর্বোচ্চ গতি আছে, যেটা শুধু স্থির থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। কোন কিছু চলতে শুরু করলেই সেটার জন্য সময়ের গতি কমতে থাকে। এটা আমাদের দৈনন্দিন গতিতে, এমনকি সবচাইতে দ্রুতগামী প্লেনেও টের পাওয়া যায় না, তবে মহাকাশের স্পেইস ষ্টেশন বা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির আবর্তনের বেগ খুব সূক্ষ্ম ঘড়িতে সেটা মাপা যায়। এই কমে যাওয়া থেকে ধরে নেয়া যায়, যেহেতু স্থানে গতি বাড়লে সময়ের গতি কমে, তার মানে বাড়তে বাড়তে একটা গতিতে গিয়ে সময় থেমে যায়, শুধু স্থানের গতি থাকে। তারপরে কী হয়? আরো কী গতি বাড়ানো সম্ভব?
আমরা দেখেছি, স্থানে গতি যত বাড়ে, টাইমে গতি তত কমে, অথবা সময়ে গতি যত বাড়ে, স্থানে গতি তত কমে। এটা থেকে বোঝা যায়, স্পেইসটাইমে গতি একটা আরেকটার ওপর নির্ভর করে। একটা শূন্য হয়ে গেলে আরেকটা আর বাড়ানো সম্ভব হয় না। অনেকটা গাড়ির জ্বালানীর মত। যত দূর যাবো, জ্বালানী তত কমবে। জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে আর যাওয়া যাবে না। তাই যখন সময় স্থির হয়ে যাবে, সময়ের গতি থাকবে না, তখন আর স্থানের গতি বাড়ানো যাবে না, স্থানের গতি তখন সর্বোচ্চ।
এই গতিটাই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমা বা আলোর গতি, যার উপরে আর যাওয়া যায় না। আর ভর আছে, এমন কিছু আলোর গতিতেই যেতে পারে না।
কিন্তু এখন পর্যন্ত যা বললাম তা হয়তো আলোর গতি যে সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার তা হয়তো পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে না। আলোর গতির এই মানটি আমাদের মহাবিশ্বের স্থান-কালের গঠনের মধ্যে নিহিত। শূন্য মাধ্যমে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ যা কিনা আলোই তা আলোর গতিতে ভ্রমণ করে, এই গতিটি দুটি ধ্রুবক দিয়ে নির্ধারিত হয়। একটিকে বলি Electric Permittivity, অন্যটি Magnetic Permeability - এই ধ্রুবকদুটি আমাদের মহাবিশ্বের স্থান-কালে প্রোথিত। কিন্তু এর থেকেও একটা বড় ব্যাপার আছে। আলোর গতির বেশি গতিতে চলতে পারলে আমাদের এই মহাবিশ্বে কার্যকারণ সূত্র - যাকে ইংরেজীতে causality বলে - তা ভেঙ্গে পড়বে, অর্থাৎ কোনো ক্রিয়ার উৎস ক্রিয়াটি হয়ে যাবার পরে সংঘটিত হবে - যেমন মেসেজ পাঠানোর আগেই তা পৌছে যেতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে যে মহাবিশ্বে causality নেই সেই মহাবিশ্বে তারা, গ্যালাক্সি বা মানুষ সৃষ্টি হতে পারে না। আর এই causality যাতে না ভাঙ্গে সেজন্য প্রকৃতি এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে আলোর গতিতে পৌঁছাতে হলে আমাদের অসীম শক্তি লাগবে যা কখনই সম্ভব না ।
কিন্তু তাহলে আমাদের সায়েন্স ফিকশনের নায়ক নায়িকাদের কি অন্য গ্যালাক্সিতে ভ্রমণ সম্ভব হবে না? এই সমস্যাকে পাশ কাটানোর জন্য হাইপার-স্পেইস নামে আমাদের পরিচিত স্থানের চাইতে অন্য এক ধরনের স্থান কল্পনা করা হয়, অথবা ওয়ার্মহোল দিয়ে সময় ও স্থানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। সেগুলি এখনো সায়েন্স ফিকশনেই সীমাবদ্ধ।