কোথা থেকে এলাম আমরা? আমাদের, মানে এই ভারতীয় উপমহাদেশীয়দের, পূর্বসূরি কারা? কেমন দেখতে ছিলেন তাঁরা? আমরা ইতিহাস বলতেই বুঝি সেই ব্রিটিশ, মুঘল, তুর্কি, সেন, পাল, গুপ্ত, মৌর্য। ইতিহাস মানেই কি শুধু রাজাবাদশা, মারামারি, কাটাকাটি? কিন্তু আমাদের এই জানা ইতিহাসগুলোও তো মাত্র এক কি দুই কি খুব বেশি হলে তিন হাজার বছর আগের ইতিহাস।তার আগে? তার আগে কারা তৈরি করেছিলেন বিভিন্ন প্রাচীন জনগোষ্ঠী এবং সভ্যতা? কারা প্রথম বসতি গড়েছিলেন এখানে? ছোটবেলা থেকে আমরা মিশর বা মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে কত কিছুই না পড়ি! অথচ আমাদের নিজেদের বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা বা বাড়ির কোনার প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। অথবা জানলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে লেখা ভুলভাল ইতিহাস জানি।
আমরা শুনেছি আর্যরা এসেছিল, সেই ঘোড়ায়-চড়া মারকুটে ফর্সা আর্য। তারাই নাকি তৈরি করেছিল সেই উন্নত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু সেটাও কি ঠিক? এই তথাকথিত 'বিশুদ্ধ রক্ত' আর্যদের শুধু ভারতেই না, এদের আমেরিকা ইউরোপেও এক রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। তবে সে গল্পে একটু পরে আসছি।এতদিন আমরা ইতিহাস বলতে মূলত লিখিত ইতিহাসকেই বুঝতাম-টেনেটুনে। সেও তো মাত্র ৫ হাজার বছরেরই পুরনো ইতিহাস।সম্প্রতি বিজ্ঞানের এক অপ্রত্যাশিত শাখা জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা থেকে আমরা আরও প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে শুরু করেছি। হাজার হাজার বছরের পুরনো ফসিলের জিনোম বা DNA পড়ার প্রযুক্তি আমাদের হাতে এসেছে মাত্র গত ৫-৭ বছরে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই প্রাচীন DNA-এর গল্প থেকেই আমরা জানতে শুরু করেছি অনেক অজানা প্রাচীন ইতিহাস।
বংশগতিবিদদের সাথে এই গবেষণায় আরও যোগ দিয়েছেন প্রত্নতত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস এবং ভাষার গবেষকেরাও। কিছুদিন আগে, এই দলের ৯২ জন বিজ্ঞানী মিলে প্রাচীন সিন্ধু উপত্যকা, আফগানিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া প্রাচীন ফসিলের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন। আর এইসব প্রাচীন জিনোমের সাথে আমাদের উপমহাদেশের এখনকার প্রায় আড়াইশ গোষ্ঠীর DNA-এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে বের করে আনতে শুরু করেছেন আমাদের পূর্বসূরিদের ইতিহাস। তাহলে, আমাদের প্রজাতির "এক্কেবারে সেই শুরু" থেকেই না হয় শুরু করা যাক, তাই না? আমরা জানি, আধুনিক মানুষের প্রজাতি Homo sapiens অর্থাৎ আমাদের সবার পূর্বসূরিদের বিবর্তন ঘটে আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ বছর আগে।
এরপর ৭০/৮০ হাজার বছর আগে এই শিকারি-সংগ্রাহকরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন এবং কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই তাঁরা ভারতীয় উপমহাদেশেও বসতি গড়তে শুরু করেন।প্রায় ১২ হাজার বছর আগে পশ্চিম এশিয়ার fertile cresent বলে পরিচিত অঞ্চলে প্রথম কৃষির উদ্ভব এবং সেখান থেকেই তা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে এসময়ে বা এর একটু আগে উত্তর ভারতে ইরান থেকে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মাইগ্রেশন বা অভিবাসন ঘটে। তবে তাঁরা আমাদের উপমহাদেশে প্রথম কৃষির উদ্ভব ঘটাননি। হয়তো মেক্সিকো বা চিনের মত আমাদের এখানেও কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল আলাদাভাবে বা পশ্চিম এশিয়ার কৃষির উদ্ভাবন থেকে কিছুটা প্রভাবিত হলেও ইরানি এই জনগোষ্ঠী তা নিয়ে আসেননি।কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই ইরান থেকে আসা বিশাল জনগোষ্ঠী উত্তর ভারতীয়দের সাথে সম্পূর্ণভাবে মিশে যান।
এবং এই মিশ্র জনগোষ্ঠীর হাতেই তৈরি হয় হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সেই বিখ্যাত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা!এই গবেষণা থেকে আরও দেখা গেছে যে এদের মধ্যে এশিয়ার তৃণাঞ্চল বা স্তেপবাসী আর্যদের কোন জিনই নেই। অর্থাৎ, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রিয় তত্ত্বমতে সেই উত্তর থেকে আসা 'তথাকথিত উঁচু জাতের আর্যরা’ কিন্তু এই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা তৈরি করেননি। বরং আর্যরা আসার অনেক আগে থেকেই ভারতে মিশর, মেসোপটেমিয়া বা ক্রিটের সভ্যতার সমসাময়িক এক উন্নত সভ্যতা বিরাজ করছিল।বৃটিশ উপনিবেশিক সময়ের সেই ‘Aryan Invasion theory’ও কিন্তু ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে অনেক আগেই।তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? আর কিছুই না, সিন্ধু সভ্যতা কোন 'মহান' আর্য জাতির হাতে সৃষ্টিতো হয়ইনি, এমনকি কোন সুপারহিরো স্টাইলে এসে তারা ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস করেছিল সেই কৃতিত্বও তাদেরকে দেয়া যাচ্ছে না।
সিন্ধু সভ্যতা এই উপমহাদেশের মানুষের হাতেই তৈরি হয়েছিল আর সম্ভবত স্রেফ প্রাকৃতিক কারণে মানে সিন্ধু নদের গতিপথের পরিবর্তন বা বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে সিন্ধু সভ্যতা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এ সময়েই উত্তর থেকে আসতে শুরু করে আর্যরা এবং তারা ক্রমশ সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের সাথে মিশে যেতে শুরু করে।এদের মিশ্রণে তৈরি জনগোষ্ঠীর নাম দেওয়া হয়েছে 'উত্তর ভারতীয় পূর্বসূরি' বা 'Ancesteral North Indians', সংক্ষেপে ANI।। আর ওদিকে সিন্ধু উপত্যকার যে-মানুষেরা আর্যদের সাথে মেশার আগেই দক্ষিণে সরে যান এবং আদি ভারতীয়দের সাথে মিশতে মিশতে ভারতের দক্ষিণে এবং পূর্বদিকে বসতি স্থাপন করেন তাঁরাই হচ্ছেন দক্ষিণ ভারতীয় পূর্বসূরি বা Ancesteral South Indian সংক্ষেপে ASI।তবে ব্যাপারটা এমন নয় যে, এখান থেকে ANI এবং ASI-রা বংশগতীয়ভাবে আলাদা হয়ে গেছিল বরং এক্কেবারে উল্টো।
এরা সবাই অনবরত মিশ খেয়েছেন, তাই আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশীয়দের সবার মধ্যেই কম বেশি ANI এবং ASI-এর সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের গুটিকয়েক আদিবাসী ছাড়া ভারতীয়দের মূল জনগোষ্ঠীর সবার মধ্যেই সেই আদি আফ্রিকান এবং ইরানিদের জিন দেখা যায়।তবে, প্রায় দুই আড়াই হাজার বছর (??? সূত্র) আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতপ্রথা এবং সমজাতীয় বিবাহ-প্রথা গেড়ে বসার ফলে এই মিশ্রণ থেমে যায় এবং সে কারণেই উত্তর ভারতে বেশি ANI-এর প্রভাব আর দক্ষিণে বেশি ASI জিনের প্রভাব দেখা যায়।এছাড়াও আমাদের কিন্তু মিশ্রণ ঘটেছে তিব্বতি-বর্মি বা অস্ট্রোএশীয়ের মত আদিবাসীদের সাথে। এবং পরে আসা আরব, তুর্কি, মুঘল, ইয়োরোপীয়দের সাথেও। তবে তাদের জিনপুল কিন্তু কখনোই সেই ইরানি বা আর্যদের মত সমস্ত ভারতীয় জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়েনি।
শুধু তো তাইই নয়, বংশগতীয় গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে আমরা শুধু আমাদের প্রজাতি Homo sapiensদের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথেই মিশ খাইনি, বরং গত ৫০-৬০ হাজার বছরে নাকি আমরা Neandarthal, Denisovan-এর মত অন্য প্রজাতির মানুষের সাথেও বংশবৃদ্ধি করেছি ।“বিশুদ্ধ জাত”-এ বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী, বিশেষত হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের জন্য এই গবেষণাগুলো বেশ দুঃখের। তাদের আউট অফ ইন্ডিয়া থিওরিমতে আর্যরা ভারতের আদিম অধিবাসী এবং ভারত থেকেই তারা নাকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উন্নত সভ্যতা ছড়িয়ে দিয়েছিল।ওদিকে আবার পশ্চিমে হিটলারের উত্তরসূরি নাৎসি সাদা জাতীয়তাবাদীদের আর্যপ্রীতিও আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারাও আবার এই আর্যদের নিজেদের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করছে। এই চরম ডানপন্থী সাদা জাতীয়তাবাদীদের মতে তথাকথিত এই “বিশুদ্ধ রক্তের” সাদা আর্যরাই নাকি পারে উন্নত সভ্যতা গড়তে।অথচ ব্যাপারটা খুবই সোজাসাপ্টা, বিশুদ্ধ জাত, রক্ত বা ধর্ম বলে আসলে কিচ্ছু নেই! মানবগোষ্ঠী কখনোই স্থির থাকেনি। শুরু থেকেই তারা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, একে অপরের সাথে মিশে গেছে, বংশবৃদ্ধি করেছে।
আমরা একগাদা
‘ভ্যাজালে’ ভরা সঙ্কর ছাড়া আর কিচ্ছু নই, এবং দিনের শেষে আমরা সবাই সেই একই প্রজাতি Homo sapiens থেকেই এসেছি।