বন্যা - দীপেন দা অনেক ধন্যবাদ, আজকে আবারও আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য। আমরা গ্যালাক্সি বিশেষ করে মিল্কিওয়ে গ্যলাক্সির গঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু যেটা আপনার কাছ থেকে আমাদের জানা হয়নি, সেটা হচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সিতে আসলে কত তারা আছে? আরও একটা বিষয় হচ্ছে সূর্য নিয়ে আমরা যে দারুণ দুটো ভিডিও করেছিলাম, সেখানে আমরা দেখেছিলাম আমাদের সূর্য একটা সাধারণ মধ্যবয়সী মাঝারি আকারের তারা ছাড়া আর কিছুই না। তাহলে আমাদের গ্যালাক্সিতে বা যেকোন গ্যালাক্সিতে কী কী ধরণের তারা থাকতে পারে?
দীপেন - বিজ্ঞানের সব সমস্যার মতই আমাদের গ্যালাক্সিতে তারার সংখ্যা নিরূপণ করা একটা বড় সমস্যা। তিনটি মূল কারণ - এক নম্বর হল আমরা পুরো গ্যালাক্সিটা দেখতে পাই না, হাইড্রোজেন গ্যাস ও ধূলা অন্যদিকের তারার আলো শুষে নেয়, দ্বিতীয়ত, যাকে বলে observational bias - আমরা মূলত উজ্জ্বল তারাদের দেখতে পাই - এরা হল O, B, A, F, G টাইপ তারারা। আমাদের সূর্য হচ্ছে G টাইপ তারা। এর মধ্যে O, B, A তারা যারা আসলেই খুব উজ্জ্বল তাদের পরিমাণ শতকরা এক ভাগও নয়, অন্যদিকে F আর G তারার পরিমাণ শতকরা দশ ভাগ, কিন্তু M টাইপ তারা যাদের ঔজ্জ্বল্য সূর্যের এক দশমাংশেরও কম তাদের পরিমাণ মোট তারাদের ৭৬ ভাগ। স্বাভাবিকভাবেই অনেক পর্যবেক্ষণেই এরা অলক্ষিত থেকে যাবে।
বন্যা - তাহলে কি তারাদের শ্রেনীবিভাগ করা হচ্ছে তাদের তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে?
দীপেন - হ্যাঁ, এখানে একটা HR diagram দেখানো হচ্ছে যেখানে x অক্ষে তারাদের তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে, আর Y অক্ষে তাদের ঔজ্জ্বল্য। O টাইপ তারাদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪০,০০০ সেলসিয়াস হতে পারে এবং সূর্যের চাইতে লক্ষ গুণ বেশি উজ্জ্বল হতে পারে। এই যে আমরা তারা পৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিয়ে তারারদের শ্রেণীবিভাগ করছি O টাইপ তারার পৃষ্ঠ তাপমাত্রা হল সবচেয়ে বেশি, M টাইপের কম।
বন্যা - এত দূর থেকে আমরা তারাদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মেপে বের করি কীভাবে?
দীপেন - এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আসছেন। তারা বহুদিন হল সূর্য এবং অন্যান্য তারাদের বর্ণালী বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। অর্থাৎ আমরা যদি সূর্যের আলোকে একটা ত্রিশিরা কাচের মধ্যে নিয়ে যাই অর্থাৎ আধুনিককালে একটা ডিফ্রাকশন গ্রেডিং বলে সেই ধরণের যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাই তাহলে আলোটা বিভিন্ন ওয়েভলাইন বা তরঙ্গে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে এবং এই তরঙ্গগুলোকে দেখে আমরা বুঝতে পারব যে কী ধরণের পরমাণু মৌলিক পদার্থ থেকে এই আলোগুলো আসছে এবং তার পরিমাণটাও আমরা সেখান থেকে বের করতে পারব যে কত পরিমাণ সেই ধরণের পরমাণু রয়েছে। সেটা কি আয়োনাইজড স্টেট এ আছে নাকি তার থেকে ইলেকট্রন বের হয়ে গেছে নাকি রয়েছে এবং সেখান থেকে আমরা তারাদের তাপমাত্রা বের করতে পারি। একটা প্রশ্ন এখানে অনেকেই করে এটা কেন A b c d করা হয়নি এবং এভাবে O f g কেন করা হয়েছে । আসলে আগে A B C D ছিল পরবর্তীকালে দেখা গেল যে A b c d দিয়ে তারাদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সেই অনুক্রম অনুযায়ী যায় না এবং পরে সাহা এবং পেইন এর গবেষণা ব্যবহার করে এই জিনিসটা করে পরবর্তীকালে এবং তাতে সেই মুল অনুক্রমটা আর বজায়ে থাকে না।
বন্যা - আচ্ছা, আমরা দুটো সমস্যার কথা জানলাম, আপনি বলেছিলেন তিনটে সমস্যা?
দীপেন - এবার তৃতীয় একটা বড় সমস্যার কথা বলি। সেটা হল আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির মোট ভর আমরা যা পাই তার সঙ্গে যে পরিমাণ তারার আলো আমরা দেখি তা মেলে না। বিজ্ঞানীরা প্রথমে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার আলোকবর্ষ দূরে যে সমস্ত তারা আছে তাদের গতি বার করলেন। কেপলারের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী এই গতি থেকে ওই সমস্ত তারাদের কক্ষপথের মধ্যে যে পরিমাণ ভর আছে সেটা বার করা যায়। দেখা গেল সেই ভরের পরিমাণ হল ৭০০ বিলিয়ন সৌরীয় ভর। আরো দূরের কিছু গ্যালাক্সির গতিবেগ বিশ্লেষণ করে আর একটি গবেষণা বলছে আমাদের গ্যালাক্সির ভর আড়াই ট্রিলিয়ন সৌরীয় ভার। তবে আমি একটি রিভিউ পেপার দেখলাম যারা বিভিন্ন গবেষণা একত্রিত করে বলছে আমাদের গ্যালাক্সির ভর ১.১ ট্রিলয়ন সৌরীয় ভর।
এর মধ্যে আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাসের ভরও ধরতে হবে - সেটা হয়ত মোট ভরের পনেরো ভাগ। এদিকে M টাইপ বা লাল বামন তারার ভর তো সূর্যের অর্ধেক থেকে এক দশমাংশ এবং তাদের সংখ্যাই তো বেশি, তাহলে তো মোট তারার পরিমাণ কয়েক ট্রিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু গ্যলাক্সির ভেতরে দূরের তারার আলো শোষিত হলেও এবং আমাদের observational biasকে ধরে নিলেও চার ট্রিলয়ন বা চার লক্ষ কোটি তারা আমাদের গ্যালাক্সিতে নেই। তাহলে এত ভর আসছে কোনখান থেকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন আসছে dark matter বা কৃষ্ণ বস্তু থেকে। তারা বলছেন এই ধরণের অদেখা বস্তু আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় চার লক্ষ আলোকবর্ষ পরিমাণ জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে আছে এবং এর পরিমাণ মোট বস্তুর শতকরা ৯০ ভাগ, অর্থাৎ মোট ভরের মাত্র ১০ ভাগ হল তারাদের মধ্যে।
বন্যা - ডার্ক ম্যাটার নিয়ে আমরা শৌনকের বোসের সাথে আলোচনা করেছিলাম আগের ভিডিওতে।
দীপেন - ডার্ক ম্যাটার বেশ সমস্যাই বলা চলে। অনেক বিজ্ঞানীরা আবার ডার্ক ম্যাটার বাদ দিয়ে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা যায় কীনা এই প্রস্তাবও দিয়ে থাকেন।
বন্যা-- তাহলে কি তারা বলতে চাচ্ছে ডার্ক ম্যাটার নেই?
দীপেন-- ডার্ক ম্যাটার আছে আমরা ধরে নিচ্ছি যেহেতু আমাদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে তো এটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এটাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারছি না সরাসরিভাবে কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমরা এটাকে পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে আমরা এতার সন্ধান পাচ্ছি না। সেজন্য পদার্থবিদ্যার একটি বিশেষ শাখই রয়েছে যেটা নিউটনীয় এবং আইনস্টাইনীয় তত্ত্বকে যদি একটু বদলে আমরা ডার্ক ম্যাটারকে বাদ দিয়ে আমরা মহাবিশ্বকে ব্যখা করতে পারি কিনা। কিন্তু আমাদের আলোচনার সাপেক্ষে এবং তোমার সাথে শৈনোকের যে আলাপ হয়েছে তাতে আমরা ধরে নিচ্ছি ডার্ক ম্যাটার বা কৃষ্ণ বস্তু আছে। সেভাবেই এমরা অগ্রসর হব কারণ সেভাবেই আমরা মহাবিশ্বকে ব্যাখা করতে পারি।
বন্যা - আমাদের আশে পাশে যে সমস্ত তারা আছে তাদের মধ্যে কি M টাইপ তারার সংখ্যাই বেশি?
দীপেন - হ্যা, বেশিরভাগ M টাইপ তারা। আমি ইদানীংকালের একটা গবেষণার কথা বলি। গায়া নামে একটি ইউরোপীয় দুরবীন ২০১৩ সনে পৃথিবীর থেকে বেশ দূরে L2 নামে লাগ্রাঞ্জ বিন্দুতে স্থাপন করা হয়, এটির অন্যতম কাজ হল আমাদের গ্যালাক্সির তারাদের এবং গ্রহদের অবস্থান সূক্ষ্ণভাবে পরিমাপ করা। কিন্তু তার আগে আমি বলে নেই আমাদের গ্যালাক্সির ভর যদি ১.১ ট্রিলিয়ন হয় এবং তার মধ্যে যদি শতকরা ১০ ভাগ বস্তু হয় এবং ৯০ ভাগ কৃষ্ণ বস্তু হয় তাহলে ধরব আমি যে তাহলে ধরব যে ১১০ বিলিয়ন সৌরীয় ভর এরমধ্যে রয়েছে এবং যদি আমি তার থেকে গ্যাসের পরিমান বাদ দেই। যদি গ্যাসের ভর বাদ দেই তাহলে তাদের পরিমান হবে ৮০/৯০ ভাগ বিলিয়ন সৌরীয় ভরের মত।। কিন্তু তারমধ্যে M টাইপ যদি বিচার করি তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়াবে ৪০০ বিলিয়ন তারার মত। তবে নতুন গবেষণার সাথে এটির পরিবর্তন হতে থাকবে। কিন্তু সবকিছুরই একটা ইরর বার থাকবে যেটা সব বিজ্ঞানীরাই বলবে সেটা আমরা যখন একটা সংখ্যা দেই এই সংখ্যাটার সাথে আমরা প্লাস মাইনাস একটা কিছু যোগ করি জোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা অনেক বড় হয়ে যায়। আমি যদি বলি যে জোতির্বিদরা বলছেন তারার সংখ্যা ৪০০ বিলিয়ন প্লাস মাইনাস ১০০ বিলিয়ন এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।। আমরা হয়ত দৈনন্দিন জীবনে এত বড় ইরর বা ভুল মেনে নিব না।
বন্যা - আপনি আগে বাদামী বামনের কথা বলছিলেন, সেটা কেমন ধরণের তারা?
দীপেন - এগুলো খুবই ছোট তারা যাদের কেন্দ্রে যথেষ্ট তাপ এবং চাপ থাকে না হাইড্রোজেন ফিউশনের জন্য যদিও তারা ডয়টেরিয়াম ফিউশান করে হিলিয়াম বানাতে পারে, তবে তাদের বিকিরণটা আসে সেই তারাটি সৃষ্টির সময় যে তাপ সেটার অভ্যন্তরে আটকে পড়েছিল তার বিকিরণে। বৃহস্পতির ভরের ১৩ গুণ থেকে ৮০ গুণ ভরের বস্তুকে বাদামী বামন বা brown dwarf বলা যায়। এই শ্রেণীটা বড় গ্রহ ও ছোট তারার মধ্যে পড়ে। ৩২.৬ আলোকবর্ষের মধ্যে তারা পেয়েছেন মোট ৫৪০টি খগোল বস্তু, যার মধ্যে রয়েছে ৭৭টি গ্রহ, সেগুলো আমাদের সৌরজগতের বাইরে যাকে আমরা বহির্গ্রহ বলছি। কাজেই এই তালিকায় আছে ৪৬৩টি তারা যার মধ্যে কোনো উজ্জ্বল O বা B তারা নেই। আমাদের সূর্যের মত তারা আছে ১৮টি, M তারা আছে ২৪৯টি ও শ্বেত বামন আছে ২০টি। M তারা বা লাল বামন তারা ছাড়াও এই তালিকায় আছে L, T ও Y টাইপের বাদামী বামন (Brown Dwarf) জাতীয় ৮৫টি তারা। কাজেই আমাদের আশেপাশের অঞ্চলে আমরা যদি লাল ও বাদামী বামনদের যোগ করি তাহলে সেগুলোর পরিমাণ মোট তারাদের শতকরা ৭২ ভাগ হবে।
বন্যা - তাহলে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সিতে মোট ৪০০ বিলিয়নের মত তারা রয়েছে, কিন্তু এই সংখ্যাটা পাথরে খোদাই করা নয়। আর আমরা আকাশে যে সমস্ত তারা দেখি সেগুলো মুলত O, B, A, F, G বর্ণালীর তারা, কিন্তু খালি চোখে M, K ইত্যাদি লাল বা বাদামী বামন তারা আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। মোটামুটিভাবে এটাই কি আজকের আলোচনার সারাংশ?
দীপেন - খুব ভালোভাবে তুমি আজকের আলোচনা সংক্ষেপে বলেছ বন্যা।