বন্যা - দীপেনদা, আমরা গ্যালাক্সি নিয়ে আগের ভিডিওগুলোতে জেনেছিলাম আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির গঠন এবং তার বাহুগুলোর গঠন নিয়ে, এও দেখেছিলাম কাল্পুরুষ বাহুর এক পাশে আমাদের সূর্য এবং সৌরজগত অবস্থিত। আপনি যে স্পাইরাল ডেন্সিটি ওয়েভ নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে তারাআদের ট্রাফিক জ্যমের কথা বলেছিলেন সেটা আমার চোখে যেন গেঁথে গেছে। আজকে আমরা আপনার সাথে আরো গভীরে গিয়ে দেখে নিতে চাই আমাদের তারা, মানে সূর্য ঠিক কীভাবে ঘুরছে মিল্কি ওয়েতে, তারাদের তুলনায় আমরা ঠিক কোনদিকে ভ্রমণ করছি?
দীপেন - এই উত্তরটা বেশ জটিল, আমরা ধীরে ধীরে এই জটটা ছাড়াবো।
বন্যা - এখন পর্যন্ত যা যা আলোচনা করেছেন তার মধ্যে কোনটা জটিল ছিল না?
দীপেন - প্রথমে বলি আমরা একটা বুদবুদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যাত ঘনত্ব আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমের ঘনত্বের চেয়ে কম। এটাকে বলা হয় Local Bubble যার দৈর্ঘ প্রায় ৩০০ আলোকবর্ষ। এর গড় ঘনত্ব হচ্ছে প্রতি ঘন মিটারে মাত্র ৫০,০০০টি পরমাণু যেখানে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের গড় ঘনত্ব হল প্রতি ঘন মিটারে পাঁচ লক্ষ পরমাণু। এর সঙ্গে একতা তুলনা দিই - আমি যদি আমার দু হাত একত্রিত করি তাহলে এর ভেতরে প্রায় একশ বিলিয়ন বিলিয়ন বাতাসের অণু পরমাণু আছে।
বন্যা - কিন্তু আমাদের চারপাশে এই ঘনত্বটা কম কেন আন্তনাক্ষত্রিক মাধ্যমের ঘনত্বের চেয়ে?
মনে করা হয় গত এক কোটি থেকে দু কোটি বছরে আমাদের আশে পাশের সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে এই স্থানীয় বুদবুদটি তৈরি হয়েছে, আবার এই বুদবুদের মধ্যে অনেক ধরণের গঠন আছে, যেমন স্থানীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম যার ঘনত্ব স্থানীয় বুদবুদের চাইতে অল্প একটু বেশি।
https://apod.nasa.gov/apod/ap020217.html
বন্যা-> এখানে গতিদিকটা দেখানো হয়েছে সেতাই কি গ্যলাক্সির মধ্যে দিয়ে সূর্যের গতপথ?
এখানে সূর্যের যে গতিদিকটা দেখানো হয়েছে তাকে বলে solar apex, আরো দুটো ছবিতে আমরা চেষ্টা করব solar apex তা বোঝাতে।
ছবিঃ ছায়াপথের স্যাজিটেরিয়াস বাহু
এই ছবিটাতে আমরা দেখছি ছায়াপথের স্যাজিটেরিয়াস বাহুটিকে, গ্যালাস্কির কেন্দ্র কোনদিকে সেটিকে নির্দেশ করা হয়েছে। এছাড়া বৃশ্চিক বা Scorpius নক্ষত্রমণ্ডল ও ধনু বা Sagittarius নক্ষত্রমণ্ডলও নির্দেশ করা হয়েছে। এবার লক্ষ করুন Altair বা শ্রবণা তারাটি, এর ওপর দিকে অভিজিত বা Vega তারার কাছে হারকিউলিস নক্ষত্রমণ্ডলের একটি দিকে সূর্য সেকেন্ডে প্রায় ১৩ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে।
দেনেব, vega বা অভিজিৎ এবং Altair বা শ্রবণা এই তিনটি তারা মিলে যে ত্রিভূজ তৈরি করে তাদের গ্রীষ্মের ত্রিভূজ বলে। অভিজিৎ তারার কাছেই solar apex বা সূর্যের গতিমুখ দেখা যাচ্ছে।
বন্যা - তাহলে কি গ্যালিক্সের মধ্যে এটাই আমাদের গতির মুখ
কিন্তু এখানেই জিনিসটা একটু জটিল হয়ে পড়ে। এই যে ১৩ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে সূর্যের গতি বললাম তা হলে স্থানীয় তারাদের গড় গতির তুলনায় সূর্যের গতি - অর্থাৎ Local Standard of Rest তার তুলনায়। এই LSR আবার গ্যলাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে। এটাকে আমি এই ভাবে ব্যাখ্যা করি আপনি একটি বড় জাহাজের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছেন, আপনি এক কেবিন থেকে আর এক কেবিনে যাচ্ছেন, আপনার কোনো ধারনাই নেই জাহাজটি সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এই solar apexটি হল আপনি জাহাজের মধ্যে যে কেবিনের দিকে যাচ্ছেন সেই দিকটি আর পুরো জাহাজটি হল LSR বা local standard of rest।
বন্যাঃ Local Standard of Rest এর গতিবেগ কত?
সেটির গতিবেগ হল সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে, কিংবা সূর্য হারকিউলিস মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে ১৩ কিলোমিটার বেগে ছুটছে সেগুলো সবই LSR-এ নিমজ্জিত, অর্থাৎ LSR জাহাজ গ্যালাক্সির চারদিকে ঘুরছে। এবং এই মুহূর্তে এটির গতিমুখ হচ্ছে সিগনাস বা হংস তারকামণ্ডলীর দিকে।
এই ছবিটাতে এই ব্যাপারটা হয়তো কিছুটা স্পষ্ট হবে। এখানে Local System of restটা হচ্ছে বাক্সটা, আর এই বাক্সটা গ্যালাক্সির চারদিকে ২২০ কিলোমিটার সেকেন্ডে ভ্রমণ করছে। এর ফলে একবার কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরে আসতে ২২৫ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর লাগে এবং মনে করা হয় সূর্যের জন্মের পরে সূর্য কেন্দ্রের চারদিকে ২০ থেকে ২৫ বার ঘুরে এসেছে।
বন্যাঃ মানে আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরে এসেছি ২০-২৫ বার?
বন্যা - তাহলে তো আমরা এই বাহুগুলোও বহুবার পার হয়েছি।
দীপেন - বিজ্ঞান এমন একটা জিনিস যে নতুন তথ্যে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়। গত সপ্তাহে আমি বলেছিলাম তার জন্মের পরে সূর্য বহুবার অনেক বাহু পার হয়েছে। কিন্তু এই সপ্তাহে একটি গবেষণা আমার চোখে পড়ল। আমাদের গ্যালাক্সির একটি corotation radius আছে, সেটা কী? বাহুগুলো একটা নির্দিষ্ট কৌণিক গতিবেগ নিয়ে ঘোরে। কেন্দ্র থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যের তারাদের গতি বাহুর গতির চাইতে বেশি হয় ও সেগুলো বাহুগুলোকে অতিক্রম করে যায়, ওই corotation radiusএর বাইরের তারাদের গতি কম হয়, সেক্ষেত্রে বাহুগুলো তারাদের অতিক্রম করে। এই দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তারারা বাহুদের পার হয়ে যায়। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে কেন্দ্র থেকে সূর্যের অবস্থানের দূরত্ব ও corotation radius একই, অর্থাৎ সূর্য একটি বাহুর সাথেই ঘুরছে, এই ক্ষেত্রে পার্সিয়াস ও সাজিটেরিয়াস বাহুর মধ্যে যে স্থানীয় বা কালপুরুষ বাহু বলছি তার সাথেই সে ঘুরছে। এর মানে এই নয় যে সূর্য যখন জন্ম নিয়েছে তখনও অবস্থাটা এরকম ছিল, কিন্তু গত ২ বিলিয়ন বছর ধরে অবস্থাটা এরকম এবং এই সময় ধরে কোনো বড় বাহু অতিক্রমের ঘটনা ঘটেনি। তবে এটাই শেষ কথা নয়।
বন্যাঃ সূর্য কি আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির তলেই থাকে? নাকি তল থেকে ওঠা নামাও করে ভ্রমণের সময়?
গ্যালাক্সির চারদিকে সূর্যের গতির ব্যাপারে আর একটা গতির কথা উল্লেখ করতে হবে সেটা হল আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির তলের ওপরে ও নিচে সূর্য ওঠানামা করে - ওপর নিচ বলছি যদিও ওপর নিচ বলে কিছু নেই - এর পর্যাবৃত্তকালটা হচ্ছে মোটামুটি ৮০ মিলয়ন বছর, অর্থাৎ সূর্য যতদিনে কেন্দ্রের চারদিকে একবার ঘুরে আসে ততদিনে তিনবার সে এই তলে ওঠা নামা করে। ৩৫০ আলোকবর্ষ ওপরে ওঠে আবার নিচে তলে নেমে ৩৫০ আলোকবর্ষ নিচে নামে। তবে আমাদের গ্যালাক্সির তলটা ঠিক কোথায় হতে পারে আমরা জানিনা, বর্তমানে সূর্য সেই তল থেকে কিছুটা ওপরে আছে, অনেকের মতে আমরা ৩ মিলিয়ন বছর আগে এই তল পার হয়েছি।
গ্যালাক্সির মধ্যে সূর্যের ভ্রমণ নিয়ে আর একটা কথা বলে শেষ করি। সূর্য যখন কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে সে আসলে একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘোরে আর এই বিন্দুটা গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারদিকে ঘোরে। এই বিন্দুটিকে আমরা LSR বা Local Standard of Rest ভাবতে পারি। এই বিন্দুর চারদিকে সূর্যের উপবৃত্তাকার পথের ব্যাপ্তি ১৫০০ আলোকবর্ষ মত হতে পারে এবং কেন্দ্রের চারদিকে একবার ঘোরার সময় সূর্য এই বিন্দুর চারদিকে দেড় বার ঘুরে আসে। কিন্তু ঘুরে একই বিন্দুতে আসে না।
বন্যা - দীপেনদা আজকে সত্যি আমার মাথা ঘুরছে। এতদিন আমি অনেক ভাবতাম যে জীবনের চারদিকে ঘুরছি আমি, আজ বুঝলাম আমি তো নস্যি, পৃথিবী, গ্রহ, সূর্য, তারা, গ্যালাক্সি সবাই ঘুরছে, বিভিন্নভাবে ঘুরছে। ঘোরাটাই মহাজাগতিক নিয়ম, আজকে থেকে আমার ঘোরা নিয়ে আর দুঃখ করবো না। এরা সবাই আসলে আমার মতই বেচারা!
https://www.syfy.com/syfywire/the-suns-motion-reflected-in-the-galaxy
দীপেন - আমরা তো শুধু গ্যালাক্সির মধ্যে সূর্যের ঘোরা দেখলাম, আর আমাদের গ্যালাক্সি যে ছুটছে সেটা নিয়ে তো কথাই বলিনি। সে তো আর এক কাহিনি।