মাতৃগর্ভে মানবশিশু গড়ে ওঠে কীভাবে?

.

আমরা দশ মাস দশ দিন গর্ভধারণের কথা শুনি প্রায়ই অথচ এই হিসাবটা ভুল -  আসলে সময় লাগে ২৮০ দিন বা নয় মাস দশ দিন। আর শুধু এটাই তো না, গর্ভধারণ থেকে শুরু করে অর্থাত ডিম্বানু এবং শুক্রাণুর নিষিক্ত হওয়া বা ফার্টিলাইজেশন থেকে শুরু করে মানব শিশুর জন্ম পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটা নিয়েই আমাদের অনেকের তেমন সুষ্পষ্ট ধারণাই নেই।  আজকের ভিডিওতে আমরা জেনে নেব এক্কেবারে প্রথমে মায়ের গর্ভে ভ্রূণ তৈরি থেকে শুরু করে তা কিভাবে একটি মানব শিশুতে পরিণত হয়! 

আমরা থিংকের পিরিয়ড বা মাসিক নিয়ে ভিডিওটিতে দেখেছিলাম মেয়েদের শরীরে সাধারণত দুটি ডিম্বাশয় বা ওভারি থাকে, যা দুইটি ডিম্বনালী বা ফেলোপিয়ান টিউব দিয়ে জরায়ুর সাথে যুক্ত থাকে। ছেলেদের শুক্রাণুর মত মেয়েদের ডিম্বাণু ক্রমাগতভাবে তৈরি হয়না। সাধারণত প্রতিটি মেয়ে শিশু জন্মায় দুইটি ডিম্বাশয়ে প্রায় দশ লক্ষ অর্ধ-প্রস্তুত ডিম্বাণু নিয়ে।

আমরা এও দেখছিলাম যে প্রতি মাসে এখান থেকে একটি ডিম্বানু  ফার্টিলাইজেশন বা নিষিক্তকরণের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে।  ঋতুচক্রের ১৪ দিনের দিকে ডিম্বাণুটি ডিম্বাশয় থেকে বেরিয়ে  ডিম্বনালি দিয়ে জরায়ুর দিকে যাত্রা শুরু করে যাকে বলে ওভুলেশন। এই অবস্থায় ডিম্বাণুটি ১২ থেকে ২৪ ঘন্টা বাঁচবে, সুতরাং নিষিক্ত হতে হলে এই ২৪ ঘন্টার মধ্যেই হতে হবে। 

ওদিকে সাধারণত যৌন মিলনের সময় পুরুষের দেহ থেকে কয়েক কোটি শুক্রাণু বের হয়ে দীর্ঘ এক কঠিন যাত্রা শুরু করে মেয়েটির সেই ডিম্বানুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য।  কিন্তু মেয়েটির যোনির অ্যাসিডিক পরিবেশে এবং রোগ প্রতিরোধকারি সিস্টেমের আক্রমণে তার বেশির ভাগই যাত্রাপথে মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে তাদের পার হতে হয় সার্ভিক্স বা জরায়ুর মুখের সরু অংশ। এই সার্ভিক্স সাধারণত বন্ধ থাকে কিন্তু  মেয়েদের মাসিক ওভ্যুলেশনের সময় কয়েক দিনের জন্য খোলে। জরায়ুর ভেতরের পেশিগুলোর সংকোচনের ফলে শুক্রাণুগুলো এগিয়ে যেতে থাকে ডিম্বানুর দিকে। এরপরে সেগুলোর অর্ধেক ঢোকে খালি ডিম্বনালীর ভেতরে, আর বাকি অর্ধেক ঢোকে অন্যটিতে যেখানে অভ্যুলেশনের সেই বিশেষ সময়ে ডিম্বানুটির থাকার সম্ভাবনা থাকে। এই ডিম্বনালীতেও আরো হাজার হাজার শুক্রাণু মারা যাওয়ার পরে বেঁচে থাকে মাত্র কয়েকশ' শুক্রাণু। । 

এখানে মাত্র কয়েক ডজনের মত শুক্রাণু সাতার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবচাইতে আগে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। যে শুক্রাণুটা আগে পৌছায়, সেটার এক ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে ডিম্বাণুর বাইরের দেয়াল গলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। আর এর পরপরই,   ডিম্বাণুটা তার বাইরের দেয়ালের ধরন পালটে দেয়, যাতে আর কোন শুক্রাণু ঢুকতে না পারে।

খুব বিরল পরিস্থিতিতে একটার বদলে দুটো ডিম্বাণু বের হয়ে আসতে পারে। সেই ক্ষেত্রে দুটি শুক্রাণু দুটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করবে এবং ফলে জন্ম নিতে পারে জমজ বাচ্চা। এই ক্ষেত্রে বাচ্চার লিঙ্গ আলাদা, অর্থাৎ ভাই-বোন জন্মাতে পারে, আবার একই লিঙ্গের বাচ্চাও জন্মাতে পারে, এবং তাদের চেহারাতেও তফাৎ থাকতে পারে।

যাই হোক, ডিম্বাণুর ভেতরে সেই শুক্রাণুটি? 

সেটা ডিম্বানুর ভিতরে ভেঙ্গে গিয়ে নিজের ভিতরের ২৩টি ক্রোমোজোম সহ জেনেটিক উপাদান দিয়ে একটি প্রোনিউক্লিয়াস তৈরি করে। ডিম্বাণুও ২৩টি ক্রোমোজোমের প্রোনিউক্লিয়াস তৈরি করে। তারপর এই দুটি আদি নিউক্লিয়াস জোড়া লাগে, বাবার ২৩টি ও মায়ের ২৩টি ক্রোমোজোম মিলে তৈরি হয় ৪৬ ক্রোমোজোমের পূর্ণ নিউক্লিয়াস। এই মুহুর্ত শিশুর চুলের রঙ, চোখের রঙ, এগুলি নির্ধারিত হয়ে গেল। 

কিন্তু শিশুর লিঙ্গ? তা কীভাবে  নির্ধারিত হয় সেটা তো থিংকের ভিডিও সন্তান ছেলে বা মেয়ে হয় কার কারণে?' তেই দেখেছেন।   

সেই নিষিক্ত জাইগোটটি কিন্তু তখন একটি মাত্র কোষ। সেটি জরায়ুর দেয়ালে প্রোথিত হয়ে বিভাজিত হতে শুরু করে যাকে আমরা বলি ব্লাস্টোসিস্ট। বিভাজনের সময় সাধারণত ভাগগুলি একসাথে লেগে থাকে ও একটি ভ্রূণে পরিণত হয়। 

কিন্তু বিরল কিছু ক্ষেত্রে ব্লাস্টোসিস্টটি সম্পূর্ন আলাদা দুই বা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়, তখন প্রতিটি ভাগ থেকে একটি করে ভ্রূণ তৈরি হয় এবং সবকিছু ঠিক থাকলে জমজ বাচ্চারা জন্মায় যারা একই লিঙ্গের হয় এবং দেখতেও তারা প্রায় একই রকম হয়। 

ডিম্বাণু যে শুধু ডিম্বনালীতে নিষিক্ত হতে হবে, এমনও না। সিরিঞ্জ দিয়ে ডিম্বাণু বের করে ল্যাবরেটরিতে নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে জাইগোট তৈরি করা যায়। এ থেকে জন্ম নেয়া শিশুকেই বলা হয়  টেস্ট টিউব বেবি। তারপর সেই জাইগোটকে তিন থেকে পাঁচ দিন ল্যাবে বিভাজিত হয়ে ভ্রূণে পরিণত করা হয় এবং উপযুক্ত পরিস্থিতিতে মায়ের জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। ডিম্বাণু যার, জরায়ুটাও তার হতে হবে এমন কোন কথাও নেই। যদি অন্য কোন মহিলার শরীরে এই জাইগোট প্রোথিত করা হয়, তাহলে সেটাকে বলা হয় সারোগেসি আর সেই মহিলাকে বলা হয় সারোগেট বা প্রতিভূ মা। 

যাই হোক, সপ্তাহখানেক জরায়ুর দেয়ালে লেগে থাকার পর ব্লাস্টোসিস্টটি ডিম্বাণুর দেয়াল বা জোনা পেলুসিডা ভেদ করে বের হয়ে আসে, এবং এন্ডোমিট্রিয়ামের ভেতরে মিশে যায়। গর্ভবতী হওয়ার ১২ দিন পরে অ্যামনিওটিক স্যাক নামে থলির মত একটি আস্তরণ তৈরি হয়, যার ভেতরে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড নামে এক ধরনের তরলে ভ্রূণটি ভাসতে থাকে। এই থলির ভেতরেই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্ল্যাসেন্টা বা গর্ভফুল তৈরি হয় যা জরায়ুতে শিশুকে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং শিশুর রক্ত ​​থেকে বর্জ্যগুলি অপসারণ করে।  

প্রথম আট সপ্তাহে শিশুটির শরীরের আভ্যন্তরীণ সব অঙ্গগুলি তৈরি হয়। 

তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড অন্ত্র আর হৃদপিণ্ড তৈরি হতে থাকে। পা আর হাতেরও দেখা পাওয়া যায় এই সময়ে।

পঞ্চম সপ্তাহে হৃদপিণ্ড নিয়মিত স্পন্দিত হতে থাকে। চোখ আর কানে এবং  মাথায় স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হতে শুরু করে। 

ছয় সপ্তাহে ফুসফুস তৈরি হতে থাকে, ভ্রূণটির শরীরে রক্তপ্রবাহ শুরু হয়। এ সময়ে শরীরের ভেতরের কংকালটাও আকার নেয়া শুরু করে, আর স্নায়ুতন্ত্রের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের পাঠানো সংকেত পাঠানোও শুরু হয়।

সাত থেকে আট সপ্তাহে  চুল, লোম ও স্তনবৃন্ত দেখা দেয়। মুখ, ঠোট কনুই আর পায়ের আঙ্গুলও এই সময়ে আলাদা করে চেনা যায়। 

 নয় থেকে বারো সপ্তাহে পরিপাকতন্ত্র কিছুটা কাজ শুরু করে। মাথাটা ভ্রূণের প্রায় অর্ধেক আয়তন দখল করে রাখে। বারো সপ্তাহর পরে আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে শিশুটির লিঙ্গ জানাও সম্ভব হয়।

তেরো থেকে ষোল সপ্তাহের মধ্যে মাথা হালকা চুলে ঢেকে যায়। এই সময়ে হাড়গুলিও শক্ত হতে থাকে, এবং ভ্রূণটি নিজে থেকে হাত পা নাড়াতে পারে।  

১৭ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে মস্তিষ্ক দ্রুত বাড়তে থাকে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে এই সময় হৃদপিন্ডের স্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়।  

২১ থেকে ২৪ তম সপ্তাহের ভেতর ভ্রূণটি হাত মুঠো করতে পারে, এবং ফুসফুসের কোষগুলি পরিণত হয়ে অ্যালভিওলি তৈরি করে। তবে চোখ তখনো বন্ধ থাকে।

২৫ থেকে ২৮ তম সপ্তাহে ভ্রূণটির দৈর্ঘ হয় প্রায় ১৫ ইঞ্চি। তখন এটি চোখের পাতা খুলতে বা বন্ধ করতে পারে।মস্তিষ্কের ক্ষমতা আরো দ্রুত বাড়তে থাকে এবং স্নায়ুতন্ত্র শরীরের কিছু কাজও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই সময়েই আঙ্গুলের ছাপ চূড়ান্ত হয়ে যায়। এই সময়ের দিকেই  সাধারণত ভ্রূণের মাথা নিচের দিকে ও পা উপরের দিকে হয়ে যায়।

 ২৯ থেকে ৩২ সপ্তাহে স্নায়ুতন্ত্র শরীরের ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ফুসফুস নিয়মিত ওঠানামা করতে থাকে, যদিও তখনও বাতাসের বদলে তরল দিয়ে ফুসফুস ভর্তি।

অনেকে ভাবেন, মা এর শরীরের রক্তই ভ্রূণটির শরীরে প্রবাহিত হয়, কিন্তু সেই ধারনাটা ভুল। গর্ভফুল ফিল্টারের মত কাজ করে এবং শুধু অক্সিজেন ও পুষ্টি ভ্রূণে যায়। আবার নাড়ির মাধ্যমেই ভ্রূণটির শরীরের কার্বন ডাই অক্সাইড ও কোষের বর্জ্য পদার্থ গর্ভফুল হয়ে মায়ের রক্তে মেশে। মায়ের রক্তের সাথে তা পরিশোধিত হয় এবং মায়ের  নিশ্বাসের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়ে যায়। 

তেত্রিশ থেকে আটত্রিশতম সপ্তাহে শরীরের হালকা লোম দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে। হাত মুঠো করার ক্ষমতাও বাড়ে। কানের লতি সম্পূর্ন হয়।  এই সময়ে মায়ের শরীর থেকে বিভিন্ন অ্যান্টিবডি ভ্রূণটির শরীরে যায় যাতে  জন্ম নেয়ার পরে শিশুর কিছু রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা থাকে।

আটত্রিশতম সপ্তাহে ভ্রূণটিকে পরিপূর্ন ধরা হয় এবং সেটি জন্মের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে, এবং আর এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে শিশুটির জন্ম হয়। শেষ হয় জাদুকরী এক পথচলার প্রথম অধ্যায়, শুরু হয় জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles