মহাদেশ কীভাবে ভাঙছে, গড়ছে? ৭টি মহাদেশ ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে | Plate Tectonics | Think Bangla

.

আমাদের পায়ের নীচের মাটি স্থির নয়। এই বিশাল মহাদেশগুলোকে জগদ্দল, নিরেট বা স্থির  মনে হলেও, তারা কিন্তু ক্রমাগতভাবে সরছে, খুব ধীরে, আমাদের আঙুলের নখ যে-গতিতে বাড়ে ঠিক সেরকম ধীর গতিতে। তাই আমরা সাধারণত তা বুঝতেও পারি না। কিন্তু তাদের এই ধীর সঞ্চালন থেকেই পৃথিবীর বিস্তীর্ণ মহাদেশগুলো ভাঙছে, গড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ভূখণ্ড, পর্বতমালা, মহাসমুদ্র, মহাদেশ আবার নিশ্চিহ্নও হয়ে যায় বহু জনপদ। আর সেই সাথে ঘটছে ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত বা সুনামির মত ভয়ংকর সব প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ, যা অনবরত বদলে দিচ্ছে আমাদের পৃথিবীর চেহারা। যেমন ধরুন ভারতীয় উপমহাদেশ এখন যেখানে দেখছেন, সেখানে ছিল না ৭ কোটি বছর আগেও। আর ১৪ কোটি বছর আগে সে ছিল এখনকার আফ্রিকা মহাদেশের সাথে যুক্ত। মহাদেশগুলোর এই সরতে-থাকা বা নড়াচড়াটা ব্যাখ্যা করা হয় প্লেট টেক্টনিক্স বা পাত সঞ্চালন তত্ত্ব দিয়ে। ভূবিজ্ঞানের একটি মৌলিক তত্ত্ব এই পাত সঞ্চালন। একে বুঝতে হলে আমাদের পায়ের নিচের মাটি ভেদ করে ঢুকতে হবে ভূগর্ভের ভিতরে। 

  

থিংকের 'হিমালয় কীভাবে বদলে দিল পৃথিবী'  ভিডিওটা প্রকাশের পর অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন মহাদেশগুলোর এই ক্রমাগত সঞ্চালন নিয়ে একটা ভিডিও বানাতে। চলুন তাহলে, থিংকের বন্ধু ভূবিজ্ঞানী, এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইডের আর্থ সাইন্সের প্রফেসর ড. নাইজেল হিউজের সাথে জেনে নেওয়া যাক এই পাত সঞ্চালনের কাহিনি। তিনি তাঁর কর্মজীবনের একটা বিশাল অংশ কাটিয়েছেন হিমালয় পর্বতমালায় কাজ করে। 


১৯১৫ সালে বড্ড ঝামেলায় পড়ে গেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ভেগনার কন্টিনেন্টাল ড্রিফট বা মহাদেশীয় সঞ্চারণের প্রকল্পটা প্রস্তাব করে। বিজ্ঞানমহলে তাঁকে রীতিমত 'পাগল-ছাগল' বলে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে-সময়ে। উনি বলেছিলেন, হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত মহাদেশগুলো জিগ‘স পাজলের বিভিন্ন অংশের মত খাঁজে খাঁজে মিলে যাচ্ছে। না, কোন আঞ্চলিক বা ছোটখাটো মিল নয়। এক্কেবারে বিশাল মহাদেশীয় আকারের মিল দেখা যাচ্ছে খালি চোখেই। এই দেখুন না, ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বের এই স্ফীত অংশের সাথে আফ্রিকার মাঝখানের পশ্চিমাংশ কিভাবে মিলে যাচ্ছে, বা এর ঠিক উপরে, আফ্রিকার উত্তর পশ্চিমাংশের সাথে ফ্লোরিডা থেকে কানাডার কতটা মিল। আবার ওদিকে গ্লসোপটেরাসের মত ফার্ন তো পায়ে হেঁটে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে পারবে না। তাহলে কিভাবে এই বিলুপ্ত ফার্নের ফসিলের দেখা মিলছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া এমনকি এন্টার্কটিকা পর্যন্ত? বা  ধরুন, ক্যাঙ্গারুর মত মারসুপিয়াল প্রাণীর ফসিলের দেখা মিলছে শুধু অস্ট্রেলিয়ায় নয়, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এন্টার্টিকায়? এগুলো থেকে বোঝা যায় এই মহাদেশগুলো একসময় একসাথে ছিল এবং পরবর্তী কালে সরে গেছে। ঠিক একই রকম মিল দেখা যায় মহাদেশগুলোর শিলাস্তর এবং প্রাচীন আবহাওয়ার মধ্যেও। ভেগনার এরকম বেশ কিছু প্রমাণ দিলেও পৃথিবীপৃষ্ঠের মত এত কঠিন, বড় এবং ভারি জিনিস ঠিক কিভাবে সরছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তখনো দিতে পারেননি। 


এর প্রায় ৪ দশক পরে, ভূবিজ্ঞানীরা আটলান্টিক মহাসমুদ্রের নিচে, মাঝখান বরাবর, প্রায় ১০ হাজার মাইলের চেয়ে বেশি লম্বা আগ্নেয়গিরির পর্বতমালা আবিষ্কার করলেন। এরই একটা অংশ চলে গেছে আইসল্যান্ডের ওপর দিয়েও। দেখা গেল, এই পর্বতমালার মাঝখানের যে উঁচু মধ্য আটলান্টিক ridge বা ভূশিরার কাছের সমুদ্রপৃষ্ঠ সেটা সবচেয়ে নতুন লাভা দিয়ে তৈরি। আর দু'দিকে যত দূরে যাওয়া যায় ততই বাড়তে থাকে এই সমুদ্রপৃষ্ঠের বয়স। এখান থেকেই দেখা গেল, পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে ভূশিরার ফাটল দিয়ে উত্তপ্ত লাভা বেরিয়ে এসে সমুদ্রপৃষ্ঠ তৈরি করছে। একদিকে আফ্রিকান ও ইউরেশিয়ান প্লেট এবং অন্যদিকে আমেরিকান প্লেটগুলো আটলান্টিকের সমুদ্রতলকে দু'দিকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে যার ফলে ইউরোপ, আফ্রিকা আর ওদিকে আমেরিকা মহাদেশগুলো ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর গভীরে আসলে কী ঘটছে যার ফলে এরকম বিশাল সঞ্চালন ঘটতে পারে? 

 

পৃথিবীর ভেতরে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোর ক্ষয়ের কারণে ভীষণরকমের তাপের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেই সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে, যখন বিভিন্ন ধরনের গ্রহাণুর সম্মেলনে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল আমাদের এই গ্রহ, তখন তাদের শক্তিও পৃথিবীর গভীরে আটকা পড়ে যায়। এদের থেকে ক্রমাগত হারে তাপ বের হচ্ছে এখনো। এই তাপশক্তি পৃথিবীর গভীরের ম্যান্টেলের মধ্য দিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে কনভেকশন কারেন্ট বা পরিচলন স্রোতে। ব্যাপারটাকে অনেকটা হাঁড়িতে ডাল গরম করার মত ভাবতে পারেন। হাঁড়ির নিচের আগুনের তাপ তরল ডালের মধ্যে কনভেকশান স্রোত সৃষ্টি করে ওপরে উঠে আর  নিচ থেকে উত্তপ্ত ডাল ক্রমাগত উপরে উঠে আসতে থাকে এর সাথে। আর ওদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাইরের স্তর মানে লিথোস্ফেয়ার যার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তা কিন্তু নিরেট নয়, বরং ১৫ থেকে ২০টি ছোট বড় টেকটনিক প্লেট বা পাতে বিভক্ত এবং এই পাতগুলো তাদের নিচের সেই গলিত, পাথরের স্তর বা ম্যাগমার ওপর ধীরগতিতে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে ম্যান্টেলের ভিতর থেকে সেই উত্তপ্ত বস্তু লিথোস্ফিয়ারের বা দুটো পাতের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে থাকে মহাদেশীয় বা সামুদ্রিক, টেকটনিক পাতগুলোকে। আর এভাবেই অনবরত ঘটে পাতের সঞ্চালন। 


এই সঞ্চালন মূলত তিনভাবে ঘটতে পারে, আর এর মাধ্যমে তৈরি হয় তিন ধরনের বাউন্ডারি বা সীমা। প্রথমটা হচ্ছে, ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারি, বাংলায় বললে বিমুখগামী সীমা। একটু আগে আটলান্টিক মহাসমুদ্রের গভীরে যে-দুটো পাত দুদিকে সরতে দেখলাম তারা এই বিমুখগামী সীমার একটা ভালো উদাহরণ। আইসল্যান্ডে খালি চোখে দেখা যায় এই টেকটনিক পাত, যেখানে দুটো পাত ক্রমাগতভাবে দু'পাশে সরে গিয়ে মাঝখানে বিশাল এক ফাটল তৈরি করছে। আর ২০০৫ সালে যখন আফ্রিকার রিফট ভ্যালিতে ফাটল দেখা দিল তখন আমরা এই বিমুখগামী সীমা তৈরির প্রক্রিয়াটা দেখতে পেলাম একদম চোখের সামনে! এখন প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবী তো আয়তনে বাড়ছে না। সেক্ষেত্রে পাতগুলো যদি এভাবে সরতে থাকে, তাহলে শেষমেষ সেগুলো যাবে কোথায়? সেটা বোঝা যাবে বাকি দুধরনের সঞ্চালন সম্পর্কে জানলে। 


কোন কোন সময় পাতগুলো সরতে সরতে একে অন্যের নিচে ঢুকেও যায়, যেমন ধরুন, অপেক্ষাকৃত ভারি সামুদ্রিক পাত যখন ঢুকে যায় মহাদেশীয় পাতের নীচে তাকে বলা হয়  কনভারজেন্ট বাউন্ডারি, বাংলায় অভিসারমুখী সীমা। এভাবেই দক্ষিণ আমেরিকার পাতের নিচে নাজকা পাতের অধোগমনের ফলে গড়ে উঠেছে সুবিশাল আন্দিজ পর্বতমালা। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ও কিন্তু বার্মা প্লেটের নিচে ভারতীয় প্লেটের ঢুকে যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে। অভিসারমুখী সীমায় যে সবসময় একটি পাত অন্য একটি পাতের নিচে চলে যাবে তাও কিন্তু নয়।  যদি দুটি মহাদেশীয় পাতের ধাক্কা লাগে, তাহলে কেউ কারুর নিচে যেতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে, দুটি পাতের ক্রমাগত সংঘর্ষে সংযোগস্থল ওপরে উঠে যেতে থাকবে। হ্যাঁ, আমরা হিমালয়ের ভিডিওতেও দেখেছিলাম কিভাবে এই প্রক্রিয়াতেই উৎপত্তি ঘটেছে হিমালয়ের মত এত বড় পর্বতমালার এবং বড় বড় সব ভূমিকম্পের। এছাড়াও আরেক ধরনের সীমা আছে যেখানে দুটো পাত একে অপরের সাথে সমান্তরালভাবে সরতে থাকে যার নাম ট্রান্সফর্ম বাউন্ডারি, বাংলায় পরিবর্তক সীমা। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রিয়াস ফাটল। এই ফাটলের দুদিকের ভূমি সরতে সরতে আজ থেকে দুকোটি বছর পরে, বর্তমানে লস এঞ্জেলস শহর সান ফ্রানসিসকো শহরের পাশে চলে আসবে। 


এ-প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি। যে-মহাসাগরের নাম দেওয়া হয়েছিল 'প্রশান্ত', তার নিচে প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে একটা “রিং অফ ফায়ার” বা “অগ্নিবলয়” আছে। আমরা পাত সঞ্চালনের যে তিন ধরনের সীমার কথা উল্লেখ করলাম, তার প্রত্যেকটাই আছে এর মধ্যে। আর আমাদের এই গ্রহে যত ভূমিকম্প হয় তার বেশিরভাগই ঘটে প্রশান্ত মহাসাগরের এই অগ্নিবলয়ের মধ্যেই। সাধারণত যেখানে পাতগুলো মেলে সেখানে সঞ্চালনের ফলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। কিন্তু আবার অনেক সময় পাতের মাঝখানেও ভূমিকম্প ঘটতে পারে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ ভেঙে উঠে আসতে পারে লাভার স্রোত। এদের  বলে হট স্পট। হাওয়াইয়ের দ্বীপপুঞ্জ তৈরি হয়েছে ঠিক এভাবে, সেখানে এখনো প্রশান্ত মহাসগরের বুক চিরে সক্রিয় লাভা বেরিয়ে আসছে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে অনবরত ভাঙছে, গড়ছে সমুদ্রতল আর আমাদের মহাদেশগুলো। পৃথিবী একটি গতিশীল গ্রহ এবং এর মূল কারণ হল এই টেকটনিক পাতের সঞ্চালন। সৌর জগতের অন্য কোনো গ্রহে টেকটনিক পাত আছে বলে আমাদের জানা নেই। এই সঞ্চালন পৃথিবীকে চিরনবীন করে রেখেছে, পুরনো মাটিকে অনবরত পৃথিবীর গভীরে চালনা করে তাকে আবার গলিয়ে নতুন করে উপহার দিচ্ছে আমাদের। পৃথিবীপৃষ্ঠের এই রসায়ন বায়ুমণ্ডলের ওপরও প্রভাব ফেলছে, আর সেই প্রভাবে জীবন্ত হয়ে উঠছে আমাদের পৃথিবীর জীবজগত। 

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles