নীলনদ আর
পিরামিড,
বলার সাথে
সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সাদা কাপড়ে মোড়ানো হাজার বছরের পুরনো অদ্ভুতদর্শন
মৃতদেহ,
যেন যেকোনো
মুহূর্তেই জেগে উঠবে তারা।
গল্প সিনেমার
বদৌলতে মমি সম্পর্কে জানে না এমন কাউকে মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু কাদের
মৃতদেহের মমি এগুলো?
কেন এবং কিভাবে এই মৃতদেহগুলোকে এত নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করতো যে
কয়েক সহস্রাব্দ পরেও এসে গবেষকরা অটোপসি করতে এবং ডিএনএ স্যাম্পল নিতে পারেন? কী তাদের রহস্য?
আসুন আজকে
থিংকের এই ভিডিওতে জেনে নেই প্রাচীন রহস্যময় মমিগুলোর বিস্ময়কর ও রোমাঞ্চকর গল্প।
মমি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে একটা ছোট্টো অনুরোধ, ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকশন পেতে
নীচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
থিংক বাংলার 'পিরামিডের রহস্য' ভিডিওতে আমরা মিশরের সম্রাট, ফারাও বা ফেরাউন এবং তাদের সমাধিসৌধ এই
পিরামিড নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এই ফারাওদের দেখা হত দেবতাদের অবতার হিসেবে যাঁরা
মৃত্যুর পর চিরস্থায়ীভাবে দেবতায় পরিণত হবেন। মৃত্যুর পরে মিশরীয় এই সম্রাটদের সেই
অনন্ত যাত্রা যেন মসৃণ হয় এবং তাঁরা অন্যদেরও সেখানে পৌঁছুতে সাহায্য করতে পারেন
সেজন্যই ছিল এত আয়োজন! তাই এই ফারাওদের মমি যত যত্ন করে সংরক্ষণ করা হতো অন্যদের
ক্ষেত্রে তা করা হতো না।
বেশ সময়সাপেক্ষ এই মমিকরণ প্রক্রিয়ার প্রথমে দেহ পানি এবং লবণ দিয়ে ধুয়ে
হৃৎপিণ্ড বাদে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরিয়ে ফেলা হত, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, যকৃত, অন্ত্র, বৃক্ক সব৷ কেননা তাঁরা
বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পরে হৃৎপিণ্ডই হবে পথ প্রদর্শক। পচনরোধের জন্য দেহের ভেতরে
বিভিন্ন ভেষজ উপকরণ দিয়ে সেলাই করে Natron
নামক একটি লবণে চুবিয়ে রাখা হত প্রায় সত্তরদিন পর্যন্ত। এরপর দেহের সমস্ত
পানি শুকিয়ে ভেতরে কাঠের গুঁড়ো ভরে সারাদেহে তেল ও রেসিন লাগিয়ে কয়েকপ্রস্থ লিনেন
কাপড় দিয়ে জড়ানো হত । জীবন্ত দেখানোর জন্য লাগানো হত পরচুলা ও নকল চোখ। একাধিক
কফিনের ভেতরে রাখা হত মমিকৃত মৃতদেহ, সেইসাথে সমাধিতে দিয়ে দেয়া হত স্বর্ণ, অলংকার, খাদ্য, পানীয়সহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় সব সামগ্রী, এমনকি দাসদাসীদের হত্যা করে তাদের দেহ
পর্যন্ত
যোগ করা হতো
সেখানে।
দেবতারূপী
মিশরীয় সম্রাটদের সমাধিকক্ষগুলো দেখা হত অতি পবিত্র স্থান হিসেবে যার ধারে কাছে
যাওয়াও ছিল বিশাল এক পাপ। ওল্ড কিংডমের বেশ কিছু সমাধিকক্ষে লেখাও থাকতো বিভিন্ন অভিশাপ:
মিশরের
পিরামিডের ভিতরে ,
মরুভূমিতে ও উপত্যকায় পাওয়া গেছে অসংখ্য মমি এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত জীবদ্দশায় নামডাকহীন, মাত্র ১৯ বছর বয়সী এক সম্রাট তুতেনখামেন!
১৯২২ সালে খননকাজ চলছিলো মিশরীয়
উপত্যকায়। হঠাৎ একজন শ্রমিক দৈবক্রমে খুঁজে পান একটি সুড়ঙ্গপথ এবং সেখানেই
আবিষ্কৃত হয় বিশাল একটি সমাধিক্ষেত্র - ভ্যালি অফ কিং বা রাজউপত্যকা।
তুতেনখামেনের সমাধিকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে এই খননকার্যের পৃষ্ঠপোষক Carnarvons
সেই দলের নেতা
হাওয়ার্ড কার্টারকে জিজ্ঞেস করেন,
'কার্টার, তুমি কি কিছু দেখতে
পাচ্ছো?'
কার্টার তখন মোমের আলোয় ভেতরে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে সেই বিখ্যাত উত্তর দেন,
'Yes, wonderful things.'
হ্যাঁ, এই কক্ষে ছিলো সোনার মূর্তিসহ প্রায় ৫০০০-এর উপরে অমূল্য
সব জিনিসপত্র। আর মমিটি রাখা ছিলো ২০০ পাউন্ডেরও বেশি ওজনের নিরেট সোনার কফিনে।
পর্বতের গভীরে
গোলকধাঁধার মত অসংখ্য সুড়ঙ্গ পার হয়ে উপত্যকার একদম মাঝখানে তুতেনখামেনের সমাধি, মাটি থেকে প্রায় ২৬ ফিট নীচে। এজন্যই অন্য
সমাধিগুলো কবর লুটেরাদের হাতে পড়লেও তুতেনখামেনের সমাধিটি ছিলো সুরক্ষিত।
কিন্তু এরপরেই ঘটতে থাকে নানা ভূতুড়ে ঘটনা। কার্টারের পোষা পাখিকে খেয়ে
ফেলে গোখরা সাপ। প্রচার হয় - এটি তুতেনখামেনের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর বদলা ও
সতর্কবার্তা। এর ছয় সপ্তাহ পরে দাঁড়ি কামানোর সময় গাল কেটে ফেলেন কারনারভন, সে থেকে ইনফেকশন হয়ে
পরবর্তীতে মারা যান তিনি। পত্রিকায় বড় বড় ছাপা হয় অভিশাপ্ত মৃত্যর
খবর। শার্লক হোমসের লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও বললেন,
পুরোহিতরা নিশ্চয়ই অতিপ্রাকৃতিক কোন শক্তিকে পাহারায় রেখেছে। ব্যস, ভয় ঢুকে যায় মানুষের
মনে।
কিং তুতের মমি নিয়ে প্রায় চল্লিশ বছর কাজ করা বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক জাহি
হাওয়াজও তাঁর আত্মীয়দের মারা যাওয়া বা বাচ্চাদের মমিগুলোর তাঁকে স্বপ্নে তাড়িয়ে বেড়ানোর
মত নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাও ফলাও করে প্রচার করা হয়।
কিং তুতের পিতৃপরিচয় নিয়েও আছে রহস্য! ভ্যালি অফ কিংস থেকে প্রায় চারশ' কিলোমিটার দূরে আমারনায় একটি মন্দিরের
ধ্বংসাবশেষে পাওয়া যায় তাঁর পিতার পরিচয়, যার নাম আখেনআতেন। এই আখেনআতেন ও তাঁর
স্ত্রী নেফারতিতি সেই সময়ের বহু-ঈশ্বরবাদিতাকে পরিত্যাগ করে, আতেনিজম নামে নতুন একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রবর্তন করেন।
বিশ বছরের শাসনশেষে মৃত্যুর পরে তাঁকে পথভ্রষ্ট আখ্যা দেয়া হয়, ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়, শাসকদের নাম থেকে তাঁকে
বাদ দেয়া হয় - এই কারণেই তুতেনখামেনের
পিতৃপরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুতেনখামেন আবার সেই আগের ধর্ম ফিরিয়ে আনেন এবং নাম
তুতেনআতেন থেকে তুতেনখামেন করেন।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুসারে এই আখেনআতেন থেকেই একেশ্বরবাদিতার জন্ম এবং এর
সাথে যোগসূত্র থাকতে পারে প্রফেট মোজেসের! কেননা আখেনআতেনের Great Hymn to the Aten এর সাথে ওল্ড
টেস্টামেনের book of psalm এর psalm-104
এর পাওয়া যায় অবিশ্বাস্য মিল!
তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অভিশাপ কি সত্যিই ছিলো? না থাকলে এতগুলো লোকের
মৃত্যু কি নিছক কাকতাল মাত্র? মজার কথা হচ্ছে, প্রথম কবরে প্রবেশকারী
২৬ জনের মধ্যে মাত্র একজন মারা যান প্রথম বছরে, তিনি কারনাভন। বাকী
অনেকেই আরও বহু বছর স্বাভাবিকভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন, দলের প্রধান হাওয়ার্ডও
বেঁচে ছিলেন ষোলো বছর। নানা দেশ থেকে বহু দর্শনার্থী আসে এবং এঁদের মধ্যে শুধু
যাদেরই মৃত্যু হয়েছে তাঁদেরটাই প্রচারিত - এভাবেই হয়তো সৃষ্টি হয় বিভিন্ন মিথ এবং
কুসংস্কারের!
এই যেমন ধরুন না, আমাদের দেশে ফারাওদের বিশাল উচ্চতা নিয়ে যে জনশ্রুতি আছে, আদতে তাঁদের গড় উচ্চতা
ছিল আমাদের থেকেও কম! সবচেয়ে লম্বা ছিলেন রামেসিস ২, উচ্চতা ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে অনেকেই এসবের জন্য দায়ী করেছেন বহুকাল ধরে বদ্ধ
অবস্থায় থাকা সমাধিক্ষেত্রগুলোর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়াকে।
এর সাথে জ্বালানি হিসেবে যুক্ত হয়েছে নানা উপকথা, কল্পকাহিনী ও সিনেমা।
তবে বাস্তবতা এবং মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন ফারাওয়ের
সমাধিতে অভিশাপের কথা উল্লেখ থাকলেও তুতেনখামেনের সমাধিতে কোন অভিশাপের চিহ্ন
পাওয়া যায়নি, শুধু তাইই নয় এতদিন ধরে গবেষনা চলেছে, সম্প্রতি এর ডিএনএ
বিশ্লেষণও করা হয়েছে। আর তাছাড়া জনশ্রুতি আছে, কার্টার নিজেও নাকি গুজব
ছড়াতে সাহায্য করেছিলেন যেন লুটপাট করতে কেউ না আসে।
গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে শত শত গবেষক মমি নিয়ে কাজ করেছেন এবং করে
যাচ্ছেন। আমরা জানতে পারছি তাঁদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভাস, রোগ-ব্যাধি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, এমনকি
জেনেটিক্সসহ নানা অজানা তথ্য! আপনিও চাইলে মিশর গিয়ে নিজ চোখে দেখে
আসতে পারেন সহস্রাধিক বছরের পুরনো এই মৃতদেহগুলো, যা শুধু মিশর কেন, মানবসভ্যতার ইতিহাসেরই
এক বিস্ময়কর নিদর্শন!